×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • বন্দি কোথায়, পাঁচ বছর পরেও নোটই তো উড়ছে

    শিবপ্রিয় দাশগুপ্ত | 11-11-2021

    প্রতীকী ছবি।

    ব্যাঘ্রাচার্য বৃহল্লাঙ্গুলের ভাষণে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘মুদ্রা মনুষ্যদিগের পূজ্য দেবতাবিশেষ। মানুষগণ রাত্রিদিন ইঁহার ধ্যান করে, এবং কিসে ইঁহার দর্শন প্রাপ্ত হইবে, সেই জন্য সর্ব্বদা শশব্যস্ত হইয়া বেড়ায়। এমন কাজই নাই যে, এই দেবীর অনুগ্রহে সম্পন্ন হয় না। পৃথিবীতে এমন সামগ্রীই নাই যে, এই দেবীর বরে পাওয়া যায় না। এমন দুষ্কর্ম্মই নাই যে, এই দেবীর উপাসনায় সম্পন্ন হয় না। এমন দোষই নাই যে, ইঁহার অনুকম্পায় ঢাকা পড়ে না। এমন গুণই নাই যে, তাঁহার অনুগ্রহ ব্যতীত গুণ বলিয়া মনুষ্যসমাজে প্রতিপন্ন হইতে পারে; যাহার ঘরে ইনি নাই-তাহার আবার গুণ কি? যাহার ঘরে ইনি বিরাজ করেন, তাহার আবার দোষ কি?’ এই মুদ্রাই এই সময়ের টাকা বা নোট। এই টাকার প্রতি আগ্রহ, নগদ টাকা হাতে রাখা, সবেতেই মানুষের আগ্রহ নোটবন্দির পরেও ক্রমেই বাড়ছে বই কমছে না।

     


    2016-র 8 নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী 5001000 টাকার নোট এক কথায় সারা দেশে বাতিল ঘোষণা করলেন। এর কারণ ছিল কালো টাকা উদ্ধার করা, সন্ত্রাসবাদের মদতে নগদ টাকার লেনদেন বন্ধ করা ও দেশকে সার্বিকভাবে ডিজিটাল লেনদেনে নিয়ে যাওয়া। অর্থনীতিবিদরা সে দিনই বলেছিলেন, এ ভাবে কালো টাকা উদ্ধার করা যায় না। তখন সরকারের তরফে বলা হয়েছিল, না, এ ভাবেই কালো টাকা উদ্ধার করা যায়। কিন্তু নোটবন্দির সময় যখন ব্যাঙ্কে বাতিল নোট জমা দিয়ে অন্য নোট নেওয়া শুরু হয় তার পর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসেবই বলেছিল, যে পরিমাণ বাতিল টাকা জমা পড়েছে তার পুরোটাই সাদা টাকা, কালো নয়। অথচ কেন্দ্রের শাসকদল গলা ফাটিয়ে বলেছে যে এই পদক্ষেপ প্রথম করে দেখালেন নরেন্দ্র মোদী। এই পথেই সারা দেশকে ই-কমার্স নামক একটা ব্যবস্থায় আনা হবে। উদ্ধার হবে কালো টাকা। বন্ধ হবে সন্ত্রাস।

     

    আদপে কি এই তিন প্রতিশ্রুতি রক্ষা হল? না, হয়নি। আজ নোটবন্দির পাঁচ বছর পর হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, তা হয়নি। যে সমস্ত কারণে নোটবন্দি করা হয়েছিল তার কোনওটাই সঠিক ভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। অর্থনীতিবিদরা সে দিনও নোটবন্দিকে হঠকারী সিদ্ধান্ত বলেছিলেন, আজও বলছেন। তবে পার্থক্য একটাই, শুরুতে তথ্য ছিল না বলে নোটবন্দি হঠকারী সিদ্ধান্ত বলে মানতে চায়নি দেশের সরকার। তবে আজ নোটবন্দির 5 বছর পর বিজেপি সরকার মানছে যে, সে দিনের চাইতে আজ দেশের বাজারে নগদের পরিমাণ ও মূল্য অনেক পরিমাণে বেশি আছে। এটা সরকারি তথ্য বলছে। তাই এই তথ্যকে উপেক্ষা করে আজ আর 2016-র 8 নভেম্বরের মতো বলা যাচ্ছে না, নোটবন্দি ভারতের মতো দেশের পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। তাই এখন বিজেপি সরকার বলছে, শুধু ভারতেই নয়। নোটের পরিমাণ বেড়েছে সারা দেশে। কারণ, করোনা।

     


    অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নোটবন্দির আগে ভারতের যা জিডিপি তার 40 থেকে 45 শতাংশ আসত অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে। এই ক্ষেত্রে পুরো লেনদেনটাই হত নগদ টাকায়। নোটবন্দি ঘোষণার পর এই অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে জিডিপিতে আমদানি এখন 20 থেকে 25 শতাংশ কমেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া-ও এই একই তথ্য দিচ্ছে। নগদে যাঁরা লেনদেন করতেন তাঁদের মধ্যে সব্জি, মাছ, পোশাক বিক্রেতা যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন ফুটপাথের ছোট মাপের ব্যবসায়ী, যাঁরা এগরোল, চাউমিন, রুটি, পরোটা, ঘুগনি বিক্রি করতেন। ছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রের ছোট ছোট উৎপাদক সংস্থা, যারা মহাজনের কাছ থেকে ঘণ্টা হিসাবে সুদে টাকা ধার করে ব্যবসা করত। আবার দিনান্তে টাকা শোধ করে দিত। ব্যাঙ্কভিত্তিক লেনদেন ছাড়াও এই নগদ টাকার দ্বারা পরিচালিত প্যারালাল বা সমান্তরাল অর্থনীতি ছিল দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধির একটা বড় হাতিয়ার, বলছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অজিতাভ রায়চৌধুরী। তাঁর মতে, একটা নোটবন্দির সিদ্ধান্তে এই প্যারালাল ইকোনমি তাসের ঘরের মতো এক ঝটকায় ভেঙে পড়েছিল। বহু মানুষের পেশা, জীবন, জীবিকা বিপর্যস্ত হয়েছিল এই নোটবন্দির সিদ্ধান্তে। আখেরে কিন্তু ভারতের অর্থ ব্যবস্থায় সেই বৈপ্লবিক, সামুদ্রিক পরিবর্তন নরেন্দ্র মোদীর সরকার আনতে পারেনি, যেটা বলা হয়েছিল।

     


    আমরা যদি সে দিনের দিকে তাকাই এবং আজকের সঙ্গে সেই নোটবন্দির দিনের তুলনা করি, তা হলেই কেন্দ্রীয় সরকারের নোটবন্দির বাস্তব চিত্রটা দেখতে পাব। 2016-র 8 নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন নোটবন্দির কথা ঘোষণা করলেন, দেশের মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার সময় দিলেন না। তার ঠিক চার দিন পরে বাজারে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল 17.74 লক্ষ কোটি টাকা। 2021-এর 29 অক্টোবর বাজারে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে 29.17 লক্ষ কোটি টাকা। এই পরিসংখ্যানই বলছে নোটবন্দি করে দেশের আর্থিক লেনদেনকে পুরোপুরি ডিজিটাল করা যায়নি, উল্টে নগদ লেনদেন গত পাঁচ বছরে অনেকটাই বেড়েছে। সরকারি হিসাব বলছে ভারতের যা জিডিপি তার 14.5 শতাংশ নগদ লেনদেন এখনও হয়। সরকারি তথ্য বলছে 2019-এর 1 নভেম্বর দেশের বাজারে নোটের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে 2 লক্ষ 84 হাজার 451 কোটি টাকা হয়। করোনার প্রভাবে 2020-র 30 অক্টোবর এই নগদ টাকা বা নোটের পরিমাণ বাজারে বেড়ে হয় 4 লক্ষ 57 হাজার 59 কোটি টাকা। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দেওয়া তথ্য বলছে, 2019-20 অর্থবর্ষে ব্যাঙ্ক নোট অর্থাৎ টাকার মূল্য ও পরিমাণ বাজারে বেড়েছিল যথাক্রমে 14.7 শতাংশ ও 6.6 শতাংশ। 2020-21 অর্থবর্ষে ব্যাঙ্ক নোট, অর্থাৎ টাকার মূল্য আরও বেড়ে হয়েছে যথাক্রমে 16.8 শতাংশ ও 7.2 শতাংশ।

     


    কেন তা হলে নোটবন্দির পরেও বাজারে নগদ টাকার মাধ্যমে লেনদেন বাড়ল? সরকারের এই প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা, করোনা আবহে মানুষ নগদ টাকা হাতে রেখে লেনদেন করতে চেয়েছেন। নগদ টাকা হাতে রাখার ফলে ভরসা পেয়েছেন সাধারণ মানুষ। তাই নগদ লেনদেন ও বাজারে নগদ টাকার পরিমাণ ও মূল্য দু'টোই বেড়েছে। তবে এরই মধ্যে ডিজিটাল লেনদেনও যে হয়েছে, সেই তথ্যও সরকারের তরফে সামনে আনা হয়েছে। তবে গত অর্থবর্ষে দেশে জিডিপি-র সঙ্কোচন হওয়ার ফলে তার নিরিখে বাজারে নোটের অনুপাত বেশি দেখা যাচ্ছে বলেই কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য। কেন্দ্র বলছে, নোটের মাধ্যমে লেনদেন যেমন বেড়েছে তেমনই ডিজিটাল লেনদেনও বেড়েছে।

     

    আরও পড়ুন: দেশপ্রেম ষোলো আনা, তবু পুষ্টিহীন দেশ

     

    যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অজিতাভ রায়চৌধুরীর মতে, নোটবন্দি না করেও ডিজিটাল লেনদেন শুরু করা যেত। ধাপে ধাপে নগদ থেকে ডিজিটালের দিকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নিয়ে যাওয়া যেত। সেটা না করে নোটবন্দির মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত বহু মানুষের বহু উদ্যোগকে পথে বসিয়েছে। মানুষকে আতঙ্কিত করে ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড় করিয়েছে এই নোটবন্দি। এর ফলে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বহু অসংগঠিত ক্ষেত্রের ব্যবসায়ী যাঁরা উৎপাদক নন, জিনিস এক জায়গা থেকে কিনে অন্য জায়গায় বিক্রি করতেন, নোটবন্দি তাঁদের চিরতরে পথে বসিয়েছে। পাশাপাশি, মধ্যবিত্তদের একটা অংশ আবার ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে এই সময়ের মধ্যে নিজেদের নিয়ে এসেছেন। তবে সেটা সরকার যতটা ঘোষণা বা লক্ষ্যমাত্রা রেখেছিল ততটা হয়নি। তা ছাড়া করোনা মানুষকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। মানুষের চাকরি, পেশা, কাজ চলে গেছে। তাই যাঁর যতটুকু অর্থ তিনি সেটা হাতে রেখেই কাজ চালানোর উপর ভরসা করেছেন। আমরা তখন শুনেছিলাম, সন্ত্রাস রুখতে নগদের লেনদেন কমানো জরুরি বলে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন। এখন বাজারে 2016-র 8 নভেম্বরের তুলনায় অনেক অনেক বেশি নগদ টাকার লেনদেন চলছে। তাই ওয়াকিবহাল মহল এখন এই আবহে সন্ত্রাসের হিসাব জানতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে।

     


    তাই দেখা যাচ্ছে যতই চেষ্টা হোক সেই ব্যাঘ্রাচার্য বৃহল্লাঙ্গুলের কথাই ঠিক। মানুষ কিন্তু সেই নগদ টাকাতেই এখনও ভরসা রেখে চলছেন। ডিজিটালে ভরসা আগামী দিনে বাড়লেও এখন সেটা নগদ লেনদেনের তুলনায় অনেকটাই কম। নোটবন্দি করে দেশটাকে রাতারাতি ডিজিটাল লেনদেনে যে নেওয়া, কালো টাকা উদ্ধার করা ও নগদ লেনদেন কমিয়ে সন্ত্রাস হ্রাস করা তাই অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রধানমন্ত্রীর কষ্টকল্পিত ভাবনাই হয়ে রইল। সরকারি তথ্যও তাই বলছে। আর বাস্তব? বাস্তব বলছে, ভরসা সেই নগদেই। 


    শিবপ্রিয় দাশগুপ্ত - এর অন্যান্য লেখা


    কলকাতায় সার্কাসের তাঁবু উধাও। একসময় শহরে শীতের বার্তা নিয়ে আসত এই সার্কাসের তাঁবু।

    নেতাজির 125তম জন্মদিন নিয়ে কমিটি, প্রধানমন্ত্রী চেয়ারম্যান, নেই কোনও বৈঠক।

    অস্তিত্ব রক্ষায় মরিয়া সিপিএম বিজেমূল ভুল বলে মেনেও যেন মানতে পারছে না।

    প্রকৃতির ক্যানভাসে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মণীশ মিত্রের দেবী মঙ্গলকাব্য

    ‘প্লাসমোডিয়াম ওভাল’, করোনার পাশাপাশি নতুন সমস্যা!

    মৃত্যুর ঘটনাটাকেই অস্বীকার করে তার দায়িত্ব থেকে হাত মুছে ফেলছে কেন্দ্র রাজ্য সমস্ত সরকার

    বন্দি কোথায়, পাঁচ বছর পরেও নোটই তো উড়ছে-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested