"পুরুষতন্ত্র লক্ষ্য রাখার চেষ্টা করেছে যাতে শিক্ষা ভূমিকা বদলে দিয়ে নারীকে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী ক'রে না তোলে।’ উনিশ শতকের ভারতীয় নারীদের প্রসঙ্গে লেখা হুমায়ুন আজাদের ‘নারী' প্রবন্ধের সঙ্গে আজকের স্নাতকোত্তর (Post Graduate) পৌলমী বসু কোথাও যেন নিজের মিল খুঁজে পাচ্ছেন। মফঃস্বলে বড় হয়ে ওঠা পৌলমী কলেজ পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার (Higher Education) জন্য কলকাতায় আসে। প্রেসিডেন্সির উঁচু দেওয়ালগুলি তাঁকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল কোভিডের (Covid) জন্য লকডাউন (Lockdown) যেন তাঁর কাছ থেকে সেই স্বপ্নগুলোকে কেড়ে নিতে চাইছে।
গত বছর কোভিডের কারণে দেশ জুড়ে যখন লকডাউন চলছে তখন পৌলমীকে বহরমপুর (Berhampore) থেকে কলকাতা (Kolkata) আসতে হয় ইউজিসি-র (University Grant Commission) এনটিএ (National Testing Agency) পরীক্ষা দিতে। কয়েক মাস আগেও যে শহরে ছিল তাঁর নিত্যদিনের বাস সেই শহরের পথ যে এতটা দুর্গম সদ্য এমএ পাশ করা পৌলমী সেটা বুঝতেই পারেননি। হঠাৎ করেই তাঁর মনে হতে লাগল তিনি যেন উনিশ শতকের বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ে যাঁর অন্দরমহল থেকে বেরনো নিষেধ।
এমএ পাশ করার পর থেকেই পৌলমী ইউজিসি-র এনটিএ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। পিএইচডি করার স্বপ্ন তাঁর আজকের নয়, বহু দিন ধরেই তিনি এই স্বপ্নকে বাস্তব করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে তাঁর মনে হয়েছিল, বহরমপুর থেকে এসে কলকাতার প্রেসিডেন্সির মতো একটি এলিট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করাটাই হয়তো তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে। কিন্তু না, উল্টে প্রেসিডেন্সির পরিবেশ ও শিক্ষা পৌলমীকে কলকাতা ও বহরমপুরের মানসিক দূরত্ব মেটাতে সাহায্য করেছিল। এই মাত্র 200 কিমির দূরত্ব যে লকডাউনের কারণে কার্যত কয়েক যুগে ব্যবধানে পরিণত হবে তা পৌলমী ভাবতেই পারেননি।
আরও পড়ুন:সরকারি চাকরির পরীক্ষা? গ্রাম এখনও বৈষম্যের শিকার
2020-র লকডাউনে গোটা দেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ। ইউজিসি-র পরীক্ষা পড়েছিল অক্টোবরের 9তারিখে। পৌলমীকে তার আগের দিন বাসে করে কলকাতায় আসতে হয়। থাকতে হয় কোনও একটি হোটেলে। পরের দিন পরীক্ষা দিয়ে আবার বাসে করে ফিরে যেতে হয় বহরমপুর। ভাবছেন, এ আর এমন কী! গ্রাম মফঃস্বলের এমন কত ছেলেমেয়েই তো রোজ কলকাতায় আসছে আর যাচ্ছে। গত বারের লকডাউনে দূরপাল্লার বাসের চিত্রটি এক বার ভেবে দেখুন তো! ধারণক্ষমতা 50 জনের, অথচ এর প্রায় তিন গুণ যাত্রী নিয়ে চলেছিল বাসগুলো, ভাড়া ছিল দ্বিগুণ। ভিড় বাসে করোনার ভয়কে উপেক্ষা করে দ্বিগুণ খরচ করে কলকাতায় এসে পরীক্ষা দেওয়া, হোটেলে থাকা কটা পরিবারের সাধ্যের মধ্যে পড়ে?
কিন্তু, মফঃস্বলের ছেলেমেয়েদের কথা ভাবে কে?
মফঃস্বল অথবা গ্রাম থেকে এক দিন আগে কলকাতায় এসে পরীক্ষা দেওয়া খরচসাপেক্ষ বিষয়। করোনা পরিস্থিতির জন্য দুর্মূল্যের বাজারে যখন পরিবারের আয় কমছে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে পৌলমীর প্রথম বার মনে হয়েছিল তিনি যদি ছেলে হতেন তা হলে হয়তো জীবনটা একটু হলেও সোজা হত। পৌলমীর কথায়: “একটি ছেলে যখন গ্রাম অথবা মফঃস্বল থেকে শহরে পরীক্ষা দিতে আসে তখন সে সহজেই একটি রাত স্টেশনে কাটিয়ে দিতে পারে, আমরা মেয়েরা তা পারি না। কারণ মেয়েদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নিরাপত্তা ও পরিবারের সম্মান। রোজকার জীবনযাত্রায় সমাজ যে এখনও কতটা পুরুষতান্ত্রিক তা করোনা যেন আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।”
2021-এ আবার যখন ইউজিসি-র পরীক্ষা হয় তখন পরীক্ষাকেন্দ্রের অগ্রাধিকার অনুযায়ী দূরত্ব কম হওয়ায় পৌলমী কলকাতার বদলে কল্যাণীকে বেছে নেন। কিন্তু তাঁর পরীক্ষাকেন্দ্র পড়ে বাঁকুড়ায়। 2021-এর এনটিএ পরীক্ষা পৌলমীর আর দেওয়া হয়নি। পৌলমীর মতো এমন কত শত মেয়ে হয়তো ভাবছে তাঁর জীবনে শিক্ষা হয়ত উনিশ শতকের ‘কিঞ্চিৎ শিক্ষা' হয়েই থেকে যাবে। উনিশ শতকের বাংলার উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীদের মতো তাঁদেরও হয়তো থেকে যেতে হবে ‘পুরলক্ষ্মী', ‘পুরনারী' ও অন্দরমহলের ‘অন্তঃপুরিকা' হয়ে।
গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়ার সপরেও বেঁচে ফিরে রফিজা নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখে মেয়েকে ঘিরে।
উত্তর কলকাতার সবচেয়ে পুরনো বাড়ি বর্তমানে যা রাষ্ট্রীয় সৌধ হিসেবে পরিচিত তাকে কেন্দ্র করে স্বাধীনত
ধর্মীয় বিশ্বাস কখনওই জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হতে পারে না
দেশের মহানগরগুলিতে নারী সুরক্ষার জন্য গঠিত নির্ভয়া তহবিলের টাকায় শহরে শুধুমাত্র আলো দেখা যায়।
আধুনিক পেশাদার জীবনের দাবি মেনে ক্রমশ মেয়েদের পোষাকে পকেট চালু হচ্ছে, এমনকী শাড়িতেও
মানব সভ্যতায় সঙ্কট ও প্রয়োজনই সর্বদা আবিষ্কারের জন্ম দিয়েছে, কোভিড আবারও তা প্রমাণ করল।