×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • লা দোলচে ভিটা: এক মহাকাব্যিক বিশৃঙ্খলা

    সোমনাথ গুহ | 15-02-2021

    প্রবাদপ্রতিম পরিচালক ফেদেরিকো ফেলিনির ‘লা দোলচে ভিতা’ (মধুর জীবন) ছবির একটি দৃশ্য।

    পঞ্চাশের দশকের রোম। স্বচ্ছ নীলাভ আকাশ। মুক্ত বিহঙ্গের মতো দুটি হেলিকপ্টার উড়ছে। চারিদিকে প্রাচীন রোমের ধ্বংসাবশেষ, গগনচুম্বী খন্ডহার যন্ত্রপাখির আওয়াজে আকৃষ্ট হয়ে পিলপিল করে ছেলেপুলে দৌড়চ্ছে। একটি হেলিকপ্টারে হস্ত প্রসারিত যীশু যেন আহ্বান করছেন বঞ্চিত ও নিপীড়িতকে তাঁর বুকে আশ্রয় নেওয়ার জন্য। সেটার পিছনে দ্বিতীয়টিতে কালো চশমা পরিহিত, সুদর্শন, অভিজাত মার্চেলো, যার অর্ধেক শরীর শূন্যে ভাসমান। নীচে সূর্য্যস্নানরতা, স্বল্পবসনা কিছু তনয়া তাকে দেখে চমকিত! এ কে? দুই শতাব্দ বাদে কি আবার ফিরে এল ইতালির আর এক ইন্দ্রিয়লিপ্সু, সুপুরুষ ক্যাসানোভা! তারা উল্লাসে মার্চেলোর দিকে হাত নাড়ে। সে তাদেরঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়, ফোন নাম্বার চায়, কানফাটা আওয়াজে হারিয়ে যায় কথা। রোম, তার প্রিয় শহর, এক নিরীহ অরণ্য, যেখানে অনায়াসে আত্মগোপন করে থাকা যায়। আদপে এ এক নৈরাজ্যের জগত, যেখানে অরাজকতাই নিয়ম, যা সেলুলয়েডে রচনা করে এমন এক আখ্যান, যাতে পাপ-পুণ্য, শুভ-অশুভ, গৃহস্থ-পতিত, সাধনা-সম্ভোগ, সেকালের যীশু ও বিংশ শতাব্দীর মার্চেলো, সব মিলেমিশে একাকার।

     

    প্রবাদপ্রতিম পরিচালক ফেদেরিকো ফেলিনির ‘লা দোলচে ভিতা’ (মধুর জীবন) ছবিতে স্বাগত। সর্বকালের অন্যতম সেরা হিসাবে বন্দিত এই ছবিটির ষাট বছর পূর্ণ হল। করোনাকালের মধ্যে পরিচালকের জন্মশতবার্ষিক এই সবে অতিক্রান্ত হল। এই ছবির নির্মাণকালে ফেলিনি চলচ্চিত্র জগতে পরিচিত। তাঁর 1954-র ছবি ‘লা স্ত্রাদা’ সেরা বিদেশি ছবি হিসাবে একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। এই ছবিতে ‘মধুর জীবন’ নেই, আছে দারিদ্র, রুটিরুজির সন্ধানে উদয়াস্ত পরিশ্রম এবং তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন, দৈত্যকায় জাম্পানো, যে তার ভালবাসা ব্যক্ত করতে না পেরে কেঁদে আকুল হয় সমুদ্র সৈকতে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের দশক, ইতালির অর্থনীতি বিধ্বস্ত, বেকারি, দারিদ্র, খাদ্যাভাব ক্রমবর্ধমান।

     

    পঞ্চাশের দশকের দ্বিতীয় অর্ধ থেকে চাকা ঘুরতে শুরু করল। সারা দেশ জুড়ে, বিশেষ করে উত্তর ইতালিতে এক আলোড়নকারী, অর্থনৈতিক উল্লম্ফন ঘটে গেল। বাজার নানাধরনের বাহারি পণ্যে ভরে গেল। এইসব পণ্যের বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনে প্রকাশনা শিল্পে জোয়ার আসল। 1954-য় টেলিভিশনের আগমনে সেই জোয়ার আরও ত্বরান্বিত হল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক নব্য খানদানি শ্রেণর উদ্ভব হল, যারা গ্রাম থেকে আগত, শিকড়হীন, ঝাঁ চকচকে নতুন শহরগুলিতে আগমন করে যারা চমকে গেছে। তারা দিশাহীন। সিঁড়ি বেয়ে সমাজের ওপরতলায় উঠতে তারা বেপরোয়া, নির্দয়। তাদের কোন নৈতিকতা নেই, কার প্রতি আনুগত্য নেই, কোন মূল্যবোধের পরোয়া করে না তারা বৈভব, বিলাসিতা, স্বেচ্ছাচারিতা, লাম্পট্যে তারা ভাসমান। ‘লা দোলচে ভিতা’য় কোন গল্প নেই, উচ্ছৃঙ্খল, আত্মবিলাস, নৈতিক অধঃপতনের এ এক মহাকাব্যিক কাহিনি

     

    ফেলিনির আরও কিছু কাহিনীচিত্রের মতো এই ছবিতেও বিশাল সেট, বিপুল সংখ্যক কলাকুশলী, ক্যামেরার অনন্য, উদ্ভাবনী কারিকুরি। সেই সময়ের রোমে প্রতিটি রাত উৎসব, উল্লাসের রাত। শহরের প্রতিটি বার, রেস্তোরাঁ, হোটেল, পতিতালয় লোভে লালসায় জ্ঞানশূন্য জনতায় উপচে পড়ছে। সেখানে বারাঙ্গনা আছে, যাজকও আছে। কামার্ত নারী পুরুষ সেখানে পরস্পরের সঙ্গে জোঁকের মতো লেগে থাকে। লাস্যময়ী নারী দড়ি ধরে ঘূর্ণির মতো বেলাগাম পাক খায়। ক্লাউন তার দলবল নিয়ে চটুল বিনোদন উপস্থাপন করে উপার্জনের চেষ্টা করে। মার্চেলোর মতো সাংবাদিকরা ঘুরঘুর করে। খবর সংগ্রহ করা তাদের বাহানা, তারাও এই গণবেলেল্লাপনার অংশীদার। ফটোগ্রাফারের ঢল চারিদিকে, তুচ্ছ কিছু ঘটলেই তারা ঝাঁকে ঝাঁকে সেখানে ঝাপিয়ে পড়ে। তাদের হাতে বেঢপ প্রাচীন বক্স ক্যামেরা, তাতে লাগানো কুড়লের মতো ভীতিময় ফ্ল্যাশবাল্ব। তারা কেউকেটাদের গাড়ির সামনে শুয়ে পড়ে, লাফ দিয়ে চলন্ত যানে উঠে পড়ে, ঝুলে পড়ে দরজা ধরে তারা অদম্য, নাছোড়বান্দা; ইতালির বিখ্যাত পাপারাজ্জি! রাতশেষে মার্চেলো এক উচ্চাকাঙ্খ অভিনেত্রী ম্যাডেলেনার সঙ্গে এক বারবনিতার ঘরে সেঁধিয়ে যায়। ঠিক ওই সময়েই শহরের আর এক প্রান্তে তার বাগদত্তা এমা তার প্রেমিক হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তায়, আতঙ্কে অতিরিক্ত মাদক সেবন করে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে মার্চেলো বারবার তাকে ভালবাসার শপথ নেয়। আবার তাকে ভর্তি করেই ম্যাডেলেনাকে ফোন করে

     

    এই ভাবে রাত যায়, ভোর হয়, আবারও রাত হয়এক আমেরিকান অভিনেত্রীর আগমন শহরে আলোড়ন সৃষ্টি করে। অভিজাত হোটেলে রূপসী সিলভিয়ার নাচ, তার শরীরবৈভব মাতিয়ে দেয় জনতাকে। পুরুষরা শিকারি সারমেয়র মতো ঘিরে থাকে তাকে সর্বত্র। তার প্রেমিক বেজা মুখে একটা সংবাদপত্র পড়ার ভান করে শেষ রাতে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে সিলভিয়া হাজির হয় রোমের বিশ্বখ্যাত ত্রেভি ফাউন্টেনের সামনে, তার পেছনে সদা উপস্থিত মার্চেলো। ধূসর পাথরে ঘেরা ঝরনার স্বচ্ছ জলে, কালো পোশাকে সিলভিয়া এক অবিস্মরণীয় যৌন আবেদনের ফ্রেম সৃষ্টি করে, যা মার্চেলো উপেক্ষা করতে পারে না। এইভাবে নানা আলেখ্য সৃষ্টি হয়। কোথায় একটি অলৌকিক কান্ড ঘটে গেছে, ম্যাডোনাকে দেখা গেছে। সেই ঘটনাস্থল উচ্চকোটি মানুষের স্ফূর্তির জায়গা হয়ে ওঠে। মেলা বসে যায় চারিদিকে। শ্বেতবস্ত্রে আচ্ছাদিত একটি মৃতদেহর সামনে যাজক নতজানু হয়ে তার পরলোকে যাত্রা সুগম করে। শৃঙ্খলাবদ্ধ সমাজে নিরাপদ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেয়ে, একটি যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবন অনেক শ্রেয়।

     

    মার্চেলোর বন্ধু স্টেইনারের সুন্দর সাজানো পারিবারিক জীবন। তার সুন্দরী স্ত্রী, ফুটফুটে দু’টি বাচ্চা। সে একজন ব্যতিক্রমী চরিত্র। স্টেইনার লেখক, সে সদ্য কেনা একটি সংস্কৃত ব্যাকরণ বই মার্চেলোকে দেখায়। তাকে লেখালেখি করতে উৎসাহিত করে। এমা স্টাইনারের পরিবার ও তাদের পরিচ্ছন্ন, রুচিশীল নিবাস দেখে মুগ্ধ। সে এই জীবন কামনা করে। মার্চেলো যেন যাজকের কথাই পুনরুচ্চারণ করে। এই সংসার, ঘড়ির কাঁটার মতো মাপা ঝুঁকিহীন গৃহস্থ জীবন তার নয়, সে বীতশ্রদ্ধ এই জীবনে। তুমুল ঝগড়া হয় তাদের। এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমাকে জোর করে নামিয়ে দিয়ে সে চলে যায় আবার ভোরের আলো ফোটার সঙ্গেঙ্গে তাকে নিতে ফিরে আসে। অভাবিত ভাবে স্টেইনার তার দুই শিশুকে হত্যা করে নিজে আত্মঘাতী হয়। বিধ্বস্ত মার্চেলো স্বগতোক্তি করে সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল, আমাদের জীবনযাপন তাকে আতঙ্কিত করেছিল। লেখক আর সে হয়ে উঠতে পারে না, গড্ডলিকা প্রবাহে ভেসে গিয়ে হয়ে যায় একজন বিজ্ঞাপন সংগ্রহকারী (অ্যাডম্যান)। সারা রাত ধরে মদ্যপান, নারীসঙ্গের ফলে সে ক্লান্ত, অবসন্ন এক সমুদ্র সৈকতে। ছবি শুরু হয়েছিল যীশুর মূর্তি দিয়ে, শেষ হল ধীবরদের জালে ধরা পড়া একটি কুৎসিত বিশালাকায় প্রাণী দিয়েসেটি মৃতপ্রায়, কিন্তু চোখ পিটপিট করছে। নেশায় বিহ্বল মার্চেলো এটা কি দেখছে? একটি সংকীর্ণ খাঁড়ির ওপারে এক কিশোর, তার নিষ্পাপ চেহারা, নির্মল হাসি, সে কিছু বলে মার্চেলোকে- সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজ যা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বিভ্রান্ত মার্চেলো নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে তার দিকে। ওই সরলতায় কি আছে মুক্তির হাতছানি?


    সোমনাথ গুহ - এর অন্যান্য লেখা


    শেষ পর্যন্ত এবারের ভোটে মুসলিম ভোট বাংলায় মমতার ঝুলিতেই যাবে।

    সরকার বিরোধিতা করলে উইচ-হান্ট কিন্তু চলছেই

    পীড়নকারী, হত্যাকারী পুলিশের শাস্তি হয়নি কোনও আমলেই।

    যোগীর শাসনে উত্তরপ্রদেশে সরকার মসজিদ ভাঙছে,ত্রাসে সিঁটিয়ে সংখ্যালঘুরা ।

    প্রচার মাধ্যম পাল্টালেও পুরনো দিনের ভোটচিত্র ও রাজনীতির স্লোগানের সঙ্গে আজকের অনেকই মিল।

    আইনের শাসনের চেয়ে বেশি আইন বহির্ভূত ভয় দেখানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোকে।

    লা দোলচে ভিটা: এক মহাকাব্যিক বিশৃঙ্খলা-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested