তিন দশক আগে প্রকাশ্য দিবালোকে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে উত্তরপ্রদেশে আবার মসজিদ ভাঙা শুরু হয়েছে। ঘটনাগুলো চুপিসারে ঘটছে, বাইরের কেউ জানতে পারছে না। স্থানীয় মানুষ প্রশাসন ও শাসক দলের গুন্ডা বাহিনীর ভয়ে মুখ খুলছেন না। স্থানীয় মিডিয়াও ভয়ে বা অন্য কারণে ঘটনা চেপে যাচ্ছে। কেউ এগোতে চাইলেও একটা বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন খাড়া করার জন্য সাক্ষী বা প্রমাণ পাচ্ছেন না। লন্ডনের ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় মসজিদ ভাঙার ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর সেটি সবার নজরে আসে। 17 মে রাজ্যের বারাবাঁকি জেলার রাম সানেহি ঘাট তেহসিলের প্রশাসন এলাকার ‘মসজিদ গরিব নওয়াজ আল মারুফ’ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। ঠিক দু'মাস আগে এই মসজিদে শেষবারের জন্য নমাজ পড়া হয়। পুলিশ তারপর ধর্মস্থানটি ঘিরে ফেলে ও সেখানে ঢোকা বন্ধ করে দেয়। দু দিন বাদে এলাকার মানুষ বিক্ষোভ দেখায়। প্রবীণ মানুষেরা যুক্তি দেন এটি একশো বছরের পুরানো মসজিদ যেখানে রোজ পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়া হয়। প্রশাসন কোনও কর্ণপাত করে না। পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে এবং অঞ্চলে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।
মার্চ মাসের গোড়ায় রাজ্য সরকার ঘোষণা করে যে জানুয়ারি, 2011-র পর রাস্তার ওপরে নির্মিত সব ধর্মীয় কাঠামো ভেঙে ফেলা হবে। 2011-র জানুয়ারির আগে যে কাঠামোগুলি নির্মিত হয়েছে সেগুলিকে স্থানন্তরিত করা হবে। 15 মার্চ মসজিদ কর্তৃপক্ষকে স্থানীয় প্রশাসন শো-কজ করে। মসজিদের পক্ষ থেকে যাবতীয় কাগজপত্র প্রশাসনের কাছে জমা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ছিল 1959-এর ইলেকট্রিক বিল, ওয়াকফ বোর্ডের ইস্যু করা রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, এবং 1991-র একটি জমি জরিপ করার নথি। এছাড়া মসজিদ যে কোনওভাবেই রাস্তায় অবস্থিত নয় সেটা প্রমাণ করার জন্য ছিল বিভিন্ন ম্যাপ। কিন্তু এর পরেও প্রশাসনের কাছ থেকে কোনও সদুত্তর না পেয়ে মসজিদ কমিটি এলাহাবাদ হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়। আদালত তাঁদের পিটিশন খারিজ করে দেয় এবং আশ্বস্ত করে যে, প্রশাসন মসজিদ ভেঙে ফেলার কোনও নোটিস দেয়নি, খালি আপনাদের ডকুমেন্টস দেখতে চেয়েছে। এতদসত্ত্বেও প্রশাসন মসজিদ বন্ধ রেখে দেয় এবং তাঁদের নথিপত্র সম্পর্কে নিরুত্তর থাকে। অবশেষে 24 এপ্রিল এলাহাবাদ হাইকোর্ট কোভিড মহামারীর কারণে 31 মার্চ অবধি সমস্ত ধরনের অবৈধ কাঠামো ভেঙে ফেলার ওপরে স্থগিতাদেশ দেয়। কিন্তু আদালতের সেই নির্দেশ অগ্রাহ্য করে তার আগেই স্থানীয় প্রশাসন মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় এবং পুরো ধ্বংসস্তূপ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় এলাকার মুসলিম মানুষ আতঙ্কে চুপসে যায়, শাসকের গুন্ডা বাহিনীর সরব এবং সবল উপস্থিতির কারণে তাঁরা কোনও প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারেননি। গার্ডিয়ানের সাংবাদিক যখন জেলাশাসককে ঘটনাটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি ওই এলাকায় কোনও মসজিদের অস্তিত্বের কথাই অস্বীকার করেন। উল্টে তিনি সাংবাদিককে বলেন যে, তাঁর নিশ্চয়ই কোনও ভুল হচ্ছে, ওখানে কখনও কোনও মসজিদ ছিল না। ওখানে যেটা ছিল সেটা হচ্ছে একটা অবৈধ কাঠামো, যেটা নাকি নিরাপত্তার কারণে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আদালতের নির্দেশ সম্পর্কে তিনি কোনও মতামত দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।
এই হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের শাসনাধীন উত্তরপ্রদেশ, যা একটি দুর্বৃত্ত রাজ্যে পরিণত হয়েছে। এখানে শাসক দলের আশ্রিত বিভিন্ন দুষ্কৃতিদের কথাই আইন। পুলিশ-প্রশাসন তাদের আজ্ঞাবহ মাত্র। এদের দাপটে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা এখানে রীতিমতো কোণঠাসা, আতঙ্কিত। তাঁদের ক্ষেত্রে সংবিধানের কোনও অস্তিত্ব নেই, মহামান্য আদালতের নির্দেশও মূল্যহীন। গত বছরের 5 আগস্ট যে দিন অযোধ্যায় প্রধানমন্ত্রী রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, তার আগের দিন রাতে সেখান থেকে 350 কিলোমিটার দূরে মাহোবা জেলার একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চলে, রাতের অন্ধকারে চুপিসারে একটি মসজিদ ধ্বংস করা হয়। বেশ কিছু দিন ধরেই সেখানে 86 নম্বর জাতীয় সড়ক চওড়া করার কাজ চলছিল। মসজিদ কমিটির সঙ্গে প্রশাসনের এই ব্যাপারে কথা চলছিল এবং কমিটি মসজিদ অংশত ভেঙে দিয়ে এর জন্য জায়গা ছাড়তেও রাজি ছিল। আলোচনা চলাকালীনই মসজিদ কমিটিকে না জানিয়ে দুম করে এই ধর্মস্থান গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। মাহোবা জেলা বুন্দেলখন্ড অঞ্চলের মধ্যে পড়ে, যেখানে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক পরম্পরাগত ভাবে সৌহার্দ্যপূর্ণ, সেখানে বলপূর্বক একটি মসজিদ ভেঙে দেওয়া সবাইকে বিস্মিত করেছে। যেটা অত্যন্ত লক্ষণীয়, বজরং দল এই মসজিদ হটানোর জন্য রীতিমতো আন্দোলন শুরু করে দিয়েছিল। 86 নম্বর জাতীয় সড়ক জুড়ে তারা প্রচার শুরু করে দেয়, ‘মেদিনা মসজিদ হটাও, মাহোবা বাঁচাও’। তারা হুমকি দেয় 5 আগস্টের আগে যদি মসজিদ ভাঙা না হয়, তাহলে তারা বৃহত্তর আন্দোলন শুরু করবে। তারা যুক্তি দেয় বিকাশের স্বার্থে একটু দূরে একটি মন্দির যদি রাস্তা সম্প্রসারণের কারণে অংশত ভাঙা যেতে পারে, তাহলে মসজিদ কেন ভাঙা যাবে না। ঘটনা হচ্ছে স্থানীয় অঞ্চলের মুসলিমরাও মসজিদ ভাঙতে আপত্তি করেনি, শুধু কতটা ভাঙা হবে এই নিয়ে আলোচনা চলছিল। যখন আঞ্চলিক একটি পত্রিকা থেকে এই ঘটনা সম্পর্কে পুলিশকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তারা বলে, আপনাদের কিছু ভুল হচ্ছে, এখানে কোনও মসজিদ ছিল না। অঞ্চলের এএসপি মহিলা সাংবাদিককে বলেন, কেউ তো এই ঘটনা সম্পর্কে আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছে না, আপনি কেন এটা নিয়ে পড়ে আছেন!
এই ঘটনাগুলো যে পরিকল্পিত ভাবে কোনও নির্বাচন জেতার লক্ষ্যে মেরুকরণ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে এমনটাও নয়। আসলে 2014 সালে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই উত্তরপ্রদেশে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। 2017 সালে যোগী আদিত্যনাথ গদিতে আসীন হওয়ার পর থেকে এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রভাব ও দাপটের কারণে মুসলিমদের সম্পর্কে ঘৃণা, বিদ্বেষ এখন বিপুল সংখ্যক সংখ্যাগুরু মানুষের মধ্যে একটা স্বাভাবিক প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসলিম মানুষের ওপর দমনপীড়ন এখন স্বাভাবিক একটা বিষয়, এটা কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা বলে ধরা হয় না। কিছুদিন আগেই যেমন একটি সতেরো বছরের গরিব ঘরের ছেলেকে পুলিশ পিটিয়ে মেরে ফেলল। লকডাউনের কারণে সংসারে হাঁড়ি চড়ে না। তাই ছেলেটি আনাজ বিক্রি করছিল, নিষ্ঠুর প্রশাসন এই সামান্য কারণে তাঁর জীবনটাই কেড়ে নিল। আর একটি ঘটনায় মোরাদাবাদ জেলায় মহম্মদ শাকির নামে এক ব্যক্তি, যিনি মাংস বেচাকেনার ব্যবসা করেন, তাঁকে ‘ভারতীয় গোরক্ষক বাহিনী’ নামে একটি গোষ্ঠী বেধড়ক মারধর করে। তারা প্রথমে শাকিরের কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা দাবি করে। কিন্তু তিনি তা দিতে অস্বীকার করলে তাঁকে মারধর করা শুরু হয়। শাকির এদের বিরুদ্ধে এফআইআর করলেও কাউকেই গ্রেপ্তার করা হয়নি। মজার ব্যাপার হচ্ছে পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে শাকিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। অভিযোগ কিন্তু গো-হত্যা নয়, তাঁর দোষ হচ্ছে কোভিডের সময় তিনি প্রাণী হত্যা করে সংক্রমণ ছড়িয়েছেন।
চার বছর আগে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকেই যোগী আদিত্যনাথ সরকার দমনপীড়নের এক অভূতপূর্ব প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ আইন করে পুলিশের হাতে লাগামছাড়া ক্ষমতা অর্পণ করা, লাভ জিহাদ বন্ধ করার নামে মুসলিম সম্প্রদায়কে টার্গেট করা, কোনও প্রতিবাদে সামিল হলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, খুন-ধর্ষণের ক্ষেত্রে রাজ্যের উচ্চবর্ণদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা এবং সর্বোপরি মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর চূড়ান্ত বিদ্বেষমূলক আচরণের তারা এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অন্যান্য রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলিও তাদের দেখানো পথে হাঁটছে। কোভিড নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও এই সরকারের ভূমিকা শোচনীয়। কৃষক আন্দোলনের কারণে বিশেষ করে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে বিজেপির জনপ্রিয়তা তলানিতে। এসবেরই প্রভাব সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সম্প্রতি একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে যোগী সরকারের ভাবমূর্তি এবং কার্যকলাপ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। সভায় ‘কোর্স কারেকশন’-এর কথা বলা হয়েছে। 2022-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে সেটা আর কতদূর সম্ভব, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
নিজের ভাষায় ফিল্মের গল্প বলেন কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরার শিরোপা পাওয়া পায়েল কাপাডিয়া।
যোগীর শাসনে উত্তরপ্রদেশে সরকার মসজিদ ভাঙছে,ত্রাসে সিঁটিয়ে সংখ্যালঘুরা ।
কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংস্থাগুলি সোশাল মিডিয়ায় যে ভুয়ো ভিডিও প্রচার করে থাকে, সেগুলোকেই তারা প্রামাণ্য
বইটির প্রকাশনা থেকে ব্লুমসবেরির সরে যাওয়া তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করে।
এটা পরিষ্কার কেন্দ্রীয় সরকার করোনা মহামারীর সুযোগ নিয়ে সমস্ত বিরোধী স্বর স্তব্ধ করার চেষ্টা করছে
গুজরাতে ধর্ষণকারীদের মুক্তি দিয়ে বিজেপি-র স্বাধীনতার অমৃত পান