অবশেষে ডাক্তার কাফিল খান ছাড়া পেলেন। গত বছর 12 ডিসেম্বর উনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে নাগরিকত্ব আইন বিরোধী একটা ভাষণ দিয়েছিলেন। এর পরিণামে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের বিশেষ টাস্ক ফোর্স 29 জানুয়ারি তাঁকে মুম্বাই থেকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাঁর ভাষণ হিংসা ও ঘৃণা ছড়িয়েছে, যা সমাজে বিভেদ এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। এই অভিযোগ সত্ত্বেও 10 ফেব্রুয়ারি তিনি জামিন পান এবং 14 তারিখ তাঁর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু উত্তরপ্রদেশ সরকার জাতীয় নিরাপত্তা আইন (এনএসএ) প্রয়োগ করে তাঁর মুক্তি আটকে দেয়। এনএসএ, 1980 একটি দানবীয় আইন। এর দ্বারা কী কারণে কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে পুলিশ অভিযুক্তকে সেটা জানাতে বাধ্য নয়। 24 ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্তকে আদালতে হাজির করাতে হবে এইরকম কোনও বাধ্যবাধকতা নেই; তাঁকে আইনি সাহায্য দেওয়া হবে এইরকম কোনও দায়ও এই আইনে নেই। তাঁর মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠন রাস্তায় নামার পর এবং তাঁর বৃদ্ধা মায়ের নাছোড়বান্দা প্রচেষ্টার ফলে অবশেষে সাত মাস বাদে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তাঁকে জামিন দেয়। কোর্ট রায় দেয়, এনএসএ-তে তাঁকে যে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তা বেআইনি। যে বক্তব্যের জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাতে প্রাইমা ফেসি বা আপাতদৃষ্টিতে এমন কিছু নেই যা হিংসা বা ঘৃণার উদ্রেক করতে পারে। উল্টে আদালত বলে, কাফিল খান হিংসার বিরুদ্ধে এবং জাতীয় ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষা করার কথা বলেছেন। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বিচারক বলেন আলিগড়ের জেলাশাসক যিনি তাঁকে গ্রেপ্তার করার আদেশ জারি করেছিলেন, তিনি কাফিল খানের বক্তব্যের নির্বাচিত কিছু অংশ পাঠ করেছেন এবং নির্বাচিত কিছু বাক্যের উপর জোর দিয়েছেন। বক্তব্যের সার কথাটা বোঝার চেষ্টা করেননি। এনএসএ-এর এই লাগামছাড়া প্রয়োগের কারণে একজন বিশিষ্ট নাগরিককে সাত মাস জেলে নরকযন্ত্রণা পোহাতে হল।
কাফিল খানের কাছে অবশ্য এই অভিজ্ঞতা নতুন কিছু নয়। তিনি এর আগেও প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতির শিকার হয়েছেন। 2017 সালের আগস্ট মাসে গোরখপুরের বাবা রাঘবদাস মেডিক্যাল কলেজে শিশুমৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে উনি শিরোনামে চলে আসেন। উনি ওই হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। যদিও ঘটনার সময় ওনার ডিউটি ছিল না। কিন্তু অক্সিজেনের অপ্রতুলতার খবর পেয়েই উনি সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে চলে যান। নানা জায়গা থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার এনে অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু উনি এবং তাঁর সহকর্মীদের যাবতীয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও 70 জন শিশু মারা যায়। অভিযোগ ওঠে যে, বহুবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও বকেয়া টাকা না পাওয়ায় সরবরাহকারীরা অক্সিজেন দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এও অভিযোগ ওঠে যে অতি প্রভাবশালী এবং সক্রিয় একটি চক্র এই অক্সিজেন সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত আছে এবং এতে প্রচুর টাকার লেনদেন হয়ে থাকে। অন্য কোনও দেশ হলে ডাক্তার খান তাঁর প্রচেষ্টার জন্য হয়তো পুরস্কৃত হতেন, কিন্তু গোরখপুরে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে তিনি "হিরো’ হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এবং তাঁকে জেলে পুরে দেওয়া হয়। প্রায় নয় মাস তাঁর বিচার শুরু হয়নি, একদিনও তাঁকে আদালতে শুনানির জন্য নিয়ে যাওয়া হয়নি। নিরুপায় হয়ে তিনি একটি খোলা চিঠি লেখেন যেটা সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়ে যায়। আদালত নড়েচড়ে বসে এবং তিনি জামিন পান। আদালত বলে উত্তরপ্রদেশ সরকার তাঁর বিরুদ্ধে আনা কোনও অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ দেখাতে পারেনি। নির্দেশ দেয় তিন মাসের মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগের তদন্ত করে তাঁকে চাকরিতে পুনর্বহাল করতে হবে। ডাক্তার খান আজ অবধি তাঁর চাকরি ফিরে পাননি, এমনকী সাসপেনশনের সময়কার টাকাও পাননি। ওনার সঙ্গে যা হয়েছে তা একটা দৃষ্টান্তস্বরূপ। একজন নিরপরাধ, সংবেদনশীল মানুষকে আইন এবং ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করে হেনস্থা করা, কারাবন্দি করা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ধরনের সমস্ত ঘটনা লিখতে গেলে একটা মহাভারত হয়ে দাঁড়াবে!
দমনমূলক আইনের বাড়বাড়ন্ত আমাদের দেশে
একদা রাওলাট অ্যাক্টের কারণে দেশ উত্তাল হয়েছিল, যার পরিণামে জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ড। স্বাধীনতার পরেও বিরোধী মতকে দমন করা এবং সেটাকে দেশ, সমাজের জন্য বিপজ্জনক তকমায় ভূষিত করার প্রবণতা বহাল থেকেছে, যার পরিণামে 1950-এর ‘প্রিভেনটিভ ডিটেনশন অ্যাক্ট’, সত্তর দশকের কুখ্যাত ‘মিসা’, 1980-র ‘এনএসএ’। এর মধ্যে ‘টাডা’, ‘পোটা’-র মতো সন্ত্রাস দমনকারী আইন এসেছে এবং বাতিল হয়েছে, যদিও এমন নয় যে পূর্বোক্ত আইনগুলির দ্বারা সন্ত্রাস দমন করা যেত না। এছাড়া ব্রিটিশ আমলের ‘সিডিশন অ্যাক্ট’ তো আছেই। দেশ বিরোধী কার্যকলাপ আটকানোর জন্য এই আইন। এনএসএ-এরও কিন্তু অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব বিঘ্নিত করছে এই ধরনের কার্যকলাপ রোধ করা। তবুও ‘সিডিশন আইন’ স্বাধীন ভারতে থেকে গেছে এবং সম্প্রতি জেএনইউ-র প্রাক্তন নেত্রী শেহলা রশিদকে কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি সম্পর্কে বৈরীমূলক টুইট করার জন্য এই আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই আইন জামিনযোগ্য নয়। এর ফলে শেহলার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত হয়েছে এবং পুলিশ প্রশাসন চাইলেই তাঁকে যখন তখন শমন পাঠাতে পারে।
এনএসএ, সিডিশন আইন যদি দানবীয় হয় তো ইউএপিএ (আনল’ফুল অ্যাক্টিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট) তো অতিদানবীয়। 1967 সালে এই আইন চালু হওয়ার পরে তা গত অর্ধশতাব্দী ধরে বহুবার সংশোধিত, সংযোজিত হয়েছে এবং এখন সমাজে একটা ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। 2019-এর জুলাইয়ে এই আইন আরও ক্ষুরধার হয়ে ওঠে, যখন সংযোজন করা হয় যে সরকার কোনও বিচার ছাড়াই একজন ব্যক্তিকে, কোনও সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত না হলেও, সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা করতে পারে এবং ইউপিএতে গ্রেপ্তার করতে পারে। এই আইনবলে কোনও অভিযোগ ছাড়াই কাউকে অন্তত 180 দিন আটকে রাখা যায়, প্রয়োজন হলে যার মেয়াদ আরও বাড়ানো যায়। ইউএপিএ-তে জামিন পাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য, তদন্ত শ্লথ গতিতে এগোয়। মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় অসম্ভব। এর পরেই 2018-এর 1 জানুয়ারি ‘এলগার পরিষদ’ সংঘটিত ভীমা কোরেগাঁও ঘটনায় যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাঁদের সবাইকে এই আইনের আওতায় আনা হয়। এঁরা অনেকেই যেমন সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নওলাখা, সোমা সেন প্রমুখ যাঁরা নিবিষ্ট ভাবে আদিবাসী ও নিপীড়িত মানুষের সেবায় নিবেদিত ছিলেন তাঁরা কিন্তু কোনও নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাই এঁদের উপর ইউএপিএ প্রয়োগ করা সমস্যা হচ্ছিল; অতঃপর ওই সংযোজন। মহারাষ্ট্রে উদ্ধব ঠাকরে সরকার ক্ষমতায় আসার পর এঁদের কয়েকজনকে জামিন দেওয়ার একটা উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। তৎক্ষণাৎ মামলা মুম্বাই পুলিশের এক্তিয়ার থেকে এনআইএ-র কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর তো খোলামকুচির মতো দিল্লি দাঙ্গা, জামিয়া মিলিয়া, ভীমা কোরেগাঁও ইত্যাদি ঘটনায় যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের প্রায় সবার উপরেই ইউএপিএ চাপানো হয়েছে। কাশ্মীরের আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত ফটোগ্রাফার মাসরাত জাহরাও বাদ যাননি।
ভীমা কোরেগাঁও পুণে থেকে 28 কিমি দূরের একটি ছোট শহর, যেখানে 1818-এর 1 জানুয়ারি নিম্নবর্ণ সম্প্রদায় মাহার সেনা পুষ্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রবল প্রতাপশালী পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও-এর সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করেছিল। এই দিনটিকে মাহাররা ব্রাহ্মণদের নিপীড়ন ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি স্মরণীয় দিন হিসাবে পালন করেন। এই দিনটির 200 বছর পূর্তিতে এলগার পরিষদ দু’দিন সভা সমাবেশ করে, যার উপর হামলা হয় এবং সারা রাজ্য জুড়ে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। পুণে পুলিশের বক্তব্য হিংসাত্মক কার্যকলাপের মাধ্যমে সরকারকে উৎখাত করতে মাওবাদীরা এই সমাবেশ সংঘটিত করেছিল এবং প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করাও এঁদের পরিকল্পনায় ছিল। এলগার পরিষদের নেতৃত্বে আছেন দু’জন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক জাস্টিস বিজি কলসে পাতিল এবং পিবি সাবন্ত। তাঁরা অভিযোগ করেন যে, দলিত সমাবেশের উপর দক্ষিণপন্থীরা হামলা করেছিল কিন্তু পুলিশ প্রশাসন তাদের ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় ছিল। তাঁরা প্রকাশ্যে বারবার বলেছেন যে, এই সমাবেশের উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা। তাঁরা আরও বলেছেন এই ঘটনার জন্য যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁদের প্রায় কেউই এলগার পরিষদের সঙ্গে কোনওভাবে যুক্ত নন এবং এঁদের গ্রেপ্তারের আগে সংগঠকরা তাঁদের নামও জানতেন না। একই সঙ্গে বলেছেন তাঁরা নিজেরা বামপন্থী এবং মনে করেন যে বা যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাঁরা একই আদর্শে বিশ্বাস করেন। সংগঠকদের স্বীকারোক্তি সত্ত্বেও 12 জন বিশিষ্ট নাগরিক- অধ্যাপক, আইনজীবী, গবেষক, লেখক- পুলিশের উপরোক্ত অভিযোগের কারণে প্রায় দু’বছর ধরে কারাবাস করছেন। এখনও অবধি এঁদের কোনও বিচার হয়নি। আর হবেই বা কীভাবে, অভিযোগের কোনও প্রমাণই তো নেই। তাই অনির্দিষ্টকালের জন্য জেলে ফেলে রাখো, যাতে কারাবাসই শাস্তিতে পরিণত হয়।
এই মামলায় অভিযুক্ত অন্তত 8 জন ষাটোর্ধ্ব এবং নানা অসুখে ভুগছেন। করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর কারাগার খালি করার কথা বলা হয়। কিন্তু একই সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হয়, যে বা যাঁরা কোনও বিশেষ আইনে অভিযুক্ত তাঁদের কোনও ছাড় দেওয়া হবে না। মহারাষ্ট্রে মহামারী ভয়ানক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, কারাগারগুলিতেও সংক্রমণ ছেয়ে গেছে। এই সময় সিপিএম নেত্রী বৃন্দা কারাট অমিত শাহকে চিঠি লিখে জানান, যেভাবে ভীমা কোরেগাঁও মামলার বন্দিদের- যাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই অসুস্থ- গাদাগাদি করে জেলে রাখা হচ্ছে তা অত্যন্ত অমানবিক। তাঁদের জামিনের আবেদন যথাশীঘ্র মঞ্জুর করার জন্য তিনি অনুরোধ করেন। মানবাধিকার কর্মী গৌতম নওলাখার সঙ্গে যে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে সেটারও তিনি প্রতিবাদ করেন। এনআইএ-এর একটি দল তাঁকে মুম্বাইয়ে তুলে নিয়ে যায় যখন দিল্লির একটি আদালতে তাঁর জামিনের আবেদন শুনানির অপেক্ষায় ছিল। বলাই বাহুল্য নেত্রীর অনুরোধে কোনও কাজ হয় না। সুধা ভরদ্বাজ যিনি ডায়েবেটিস এবং হাইপারটেনশনের রোগী, তিনি দু’বার স্বাস্থ্যের কারণে জামিনের আবেদন করেছেন। দু’বারই তা অগ্রাহ্য করা হয়েছে। সোমা সেন আর্থারাইটিসের রোগী। তাঁরও জামিনের আবেদন নাকচ হয়েছে। উল্টে বলা হয়েছে, কোভিডকে অজুহাত করা হচ্ছে। সফুরা জারগর, শাহিনবাগের নেত্রী, যখন অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কারণে জামিনের আবেদন করেছিলেন, তখন সরকারি উকিল যুক্তি দিয়েছিলেন যে এর আগে বহু বন্দিনীর কারাগারে গর্ভপাত হয়েছে, তাতে কোনও অসুবিধা নেই। পরে উপরতলার কারও অঙ্গুলিহেলনে আদালত করুণা দেখায় এবং সফুরা জামিন পান। একাশি বছরের বরেণ্য কবি ভারভারা রাও জেলে কোভিড আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে কর্তৃপক্ষ গড়িমসি করে। এর বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়, রাও-এর পরিবার আবেদন করে, কারাগারে ভারভারা রাওকে হত্যা করবেন না। কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সুস্থ হওয়ার পর পত্রপাঠ জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর পরিবারের জামিনের আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়। শোনা যায় আসামে গুয়াহাটি জেলে কৃষক নেতা অখিল গগৈ কোভিড পজিটিভ হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। সেখানে জেলের অবস্থা এত খারাপ যে 1200 বন্দি দু’দিন ভুখা হরতাল করে। তার পরে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। অধ্যাপক জি.এন.সাইবাবা, মাওবাদী যোগের কারণে যাবজ্জীবন কারাবাসে দণ্ডিত। তিনি একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ, 90 শতাংশ শারীরিক ভাবে অক্ষম, হুইলচেয়ারে আবদ্ধ। জেলের অন্যান্য বন্দিরা তাঁকে খাইয়ে দেন, শৌচাগারে যেতে সাহায্য করেন। তাঁর মা ক্যানসারের রোগী ছিলেন। জুলাই মাসে তিনি মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য কয়েক দিনের জামিন চান; জামিন অগ্রাহ্য হয়। মা 1 আগস্ট প্রয়াত হন। মার শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকার জন্য 4 আগস্ট আবার তিনি জামিনের আবেদন করেন, আবার তা নাকচ করা হয়। দু’বারই হায়দ্রাবাদ পুলিশ নাকি জানিয়েছে তাঁর কয়েক দিনের জন্য বাইরে আসাটাও বিপজ্জনক। আমরা একজন 90 শতাংশ শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ, সে যত বড় ‘সন্ত্রাসবাদী’ই হোক, তাঁর সম্পর্কে কথা বলছি! সরকার কত অমানবিক হতে পারে এবং ইউএপিএ আইনের কতটা অপব্যবহার হতে পারে এটা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
সরকার বিরোধিতা করলে উইচ-হান্ট কিন্তু চলছেই
জুলাই মাসে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হানি বাবুকে একই ঘটনার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি বর্ণাশ্রম-বিরোধী আম্বেদকার পন্থী একজন সমাজকর্মী। এছাড়া তিনি জি.এন.সাইবাবা মুক্তি কমিটির আহ্বায়ক। সম্প্রতি ভীমা কোরেগাঁও ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী অধ্যাপক পার্থসারথি রায়কে মুম্বাইয়ে ডাকা হয়েছে। করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই তিনি সরকারের কোভিড নিয়ন্ত্রণ নীতির কঠোর সমালোচক। 2012 সালে নোনাডাঙ্গায় বস্তি উচ্ছেদের ঘটনায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অতীতে তাঁর গতিবিধির উপর সরকারের নজরদারির অভিযোগ আছে। তিনি জীবনে ভীমা কোরেগাঁও যাননি, ওইখানে যে দলিত সমাবেশ হয়েছিল, তাঁর সংগঠকদের সঙ্গেও তাঁর কোনও পরিচয় নেই। ওই সমাবেশকে কেন্দ্র করে সারা মহারাষ্ট্র জুড়ে যে হিংসা ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটা তিনি সংবাদপত্র থেকেই জানতে পেরেছিলেন। অধ্যাপক রায় এনআইএ-কে জানিয়েছেন যে, তিনি যেহেতু কোভিড নিয়ে গবেষণায় নিবিড় ভাবে যুক্ত তাই তাঁর নিজের পক্ষে এবং অন্যদেরও সুরক্ষার কারণে তিনি মুম্বাই যেতে অপারগ। তিনি ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমে তাঁকে জেরা করার অনুরোধ জানিয়েছেন। অধ্যাপক কে.সত্যনারায়ণ এবং বর্ষীয়ান সাংবাদিক কে.ভি.কুর্মানাথকে একই ঘটনার জন্য তলব করা হয়েছে শুধুমাত্র তাঁরা ভারভারা রাওয়ের জামাই বলে। তাঁরাও ওই ঘটনায় বিন্দুমাত্র জড়িত নন। তাঁরা মুম্বাই যান এবং প্রায় দশ ঘণ্টা জেরার পর তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কয়েক দিন আগে এনআইএ (ন্যাশানাল ইনভেস্টিগেটিভ এজেন্সি) ‘কবির কলা মঞ্চ’ নামক দলিতদের একটি সাংস্কৃতিক দলকে মাওবাদীদের একটি ছায়া সংগঠন বলে দেগে দেয় এবং তাদের তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। এই এনআইএ 2008 সালে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের পর এক মাসের মধ্যে গঠিত হয়। এই সংস্থার মুখ্য কাজ সন্ত্রাস দমন করা। এখন সেটাকে রিয়া চক্রবর্তী মাদকদ্রব্য পাচারের সঙ্গে যুক্ত আছেন কিনা সেটা সন্ধান করতেও ব্যবহার করা হচ্ছে!
উপরোক্ত সব ঘটনাই অদলীয় বামপন্থী কর্মী, সংগঠন সংক্রান্ত। এবার দেখা যাক বিভিন্ন রাজ্যে ইডি (এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট), সিবিআই, আয়কর দপ্তরকে বিরোধী দল ভাঙতে, মন্ত্রিসভা উল্টে দেওয়ার জন্য কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের এই রাজ্যেই অভিযোগ আছে সিবিআইয়ের জুজু দেখিয়ে কতিপয় নেতাকে দলবদল করতে বাধ্য করা হয়েছে। দলবদলের পর টাকাপয়সা নয়ছয়ের যাবতীয় অভিযোগ ধামাচাপা পড়ে গেছে। রাজস্থানে শচীন পাইলটের বিদ্রোহের কারণে কংগ্রেস সরকার যখন টালমাটাল, তখন ইডি মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলোটের দাদা অগ্রসেন গেহলোটের বাড়ি তল্লাশি করে। অভিযোগ তিনি একটি সার কেলেঙ্কারিতে যুক্ত ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মিডিয়াকে জানান যে, বিভিন্ন সরকারি সংস্থা তাঁর আত্মীয় এবং সহকর্মীদের উপর নানা অজুহাতে চাপ সৃষ্টি করছে। মহারাষ্ট্রে যখন সরকার গড়া নিয়ে অনিশ্চয়তা চলছিল তখনও ইডি পুরনো কেস খুঁড়ে বার করে অজিত পাওয়ারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। বলা হয়েছিল অজিত ‘মহারাষ্ট্র স্টেট কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক’-এর একটি 25,000 কোটি টাকার ঘোটালায় যুক্ত ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ‘বিদর্ভ ইরিগেশন ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন’-এও টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ উঠে এসেছিল। যদিও রাজ্যের দুর্নীতি-বিরোধী সংস্থা বহু আগেই তাঁকে এই অপবাদ থেকে মুক্তি দিয়েছিল। উদ্যোগপতিরাও রাষ্ট্রের এই আইনি বা বেআইনি আক্রমণের শিকার হন। ‘কাফে কফি ডে’ নামক সংস্থাটি খুব সঙ্গত কারণেই কফি পান করাটাকে একটা মধ্যবিত্ত ফ্যাশনে পরিণত করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। 2019-এর জুলাই মাসে এই সিসিডি-র প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক ভি.জি.সিদ্ধার্থ কর্ণাটকের নেত্রাবতী নদী থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। সুইসাইড নোটে তিনি লেখেন যে, তিনি দেনাগ্রস্ত ছিলেন এবং আয়কর দপ্তর তাঁকে হেনস্থা করে এবং এক ডিজি তাঁর উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেন। কংগ্রেস এই দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর জন্য আয়কর দপ্তরকে দায়ী করে এবং তারা আরও অভিযোগ করে যে ইউপিএ আমলে যে কোম্পানিগুলি লাভজনক ব্যবসা করছিল, সেগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে যার ফলে অনেকের চাকরি চলে গেছে।
1039 জন বিজ্ঞানী ও শিক্ষায়তনের সঙ্গে যুক্ত বিশিষ্টজনেরা ভীমা কোরেগাঁও মামলায় এনআইএ-এর তদন্ত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা এক বিজ্ঞপ্তিতে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এই সংস্থা সরকারের সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার জন্য তদন্তকে বিশেষ দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই সংস্থা যাঁরা ওই ঘটনায় হামলার জন্য দায়ী, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা তো নেয়ইনি উল্টে যাঁরা সেখানে উপস্থিতই ছিলেন না, সেই সব মহামান্য নাগরিকদের নানা অছিলায় গ্রেপ্তার করে তাঁদের উপর ইউএপিএ চাপিয়ে দিয়েছে। ‘আর্বান নক্সাল’ যাঁদের বলা হচ্ছে তাঁরা আসলে বিক্ষোভে মুখর বুদ্ধিজীবী, যাঁদের অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্দি করে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তাঁরা এই নাগরিকদের অবিলম্বে মুক্তির দাবি করেছেন এবং যাঁরা ভীমা কোরেগাঁও-এ হিংসা ছড়িয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এঁদের এই আবেদন কতটা কাজে দেবে সন্দেহ আছে। এর আগে নোয়াম চমস্কি সহ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষরাও এঁদের মুক্তির জন্য আবেদন করেছিলেন, কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। শরদ পাওয়ার বলছেন ভীমা কোরেগাঁও ঘটনা তদন্তের জন্য রাজ্য সরকার এসআইটি (স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম) তৈরি করবে, আসল দোষী কারা তাদের খুঁজে বার করা হবে। এনআইএ-এর তদন্ত কোন পথে যাচ্ছে সেটা নিয়ে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ডিসেম্বর, 2019-এও তিনি মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তারকে অন্যায় এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ বলেছিলেন। কেন্দ্র ও মহারাষ্ট্র সরকারের সম্পর্ক এখন আদায় কাঁচকলায়। ভীমা কোরেগাঁও ঘটনা এবং সেই মামলায় বন্দিরা কি তাতে একটা নতুন মাত্রা যোগ করতে চলেছেন?
সরকারের থেকে জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা কৃষকের অন্যায্য দাবি নয়, হকের পাওনা
হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির গণহত্যার আহ্বানে সরকার নীরব থাকলে নাৎজি জার্মানির স্মৃতি ফিরে আসতে বাধ্য।
প্রায় আশি বছর আগে গ্যাবো-মার্সেদেস রূপকথার সূচনা।
প্রচার মাধ্যম পাল্টালেও পুরনো দিনের ভোটচিত্র ও রাজনীতির স্লোগানের সঙ্গে আজকের অনেকই মিল।
বইটির প্রকাশনা থেকে ব্লুমসবেরির সরে যাওয়া তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করে।
স্থানীয় আদিবাসীদের উপর প্রবল প্রভাবের কারণেই স্ট্যান স্বামীকে সরানো রাষ্ট্রের দরকার ছিল।