গত 16 সেপ্টেম্বর প্রখ্যাত সমাজকর্মী হর্ষ মান্দারের পরিচালিত কিছু সংস্থায় আয়কর দপ্তর হানা দিয়েছে। প্রাক্তন আমলা মান্দারের ক্ষেত্রে এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। 2002 সালে গুজরাত দাঙ্গার পর তিনি প্রশাসনিক পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং পুরোদমে সমাজকল্যাণমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। সেই সময় থেকেই তিনি সরকারের চক্ষুশূল। বারবার তাঁর বাড়ি, অফিসে সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি নানা ছুতোয় তল্লাশি চালিয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারের নানাবিধ অভিযোগ। তিনি নাকি সিএএ-এনআরসি আন্দোলনে হিংসা ছড়িয়েছেন, বিভিন্ন সমাবেশে তিনি নাকি প্ররোচনামূলক বক্তব্য রেখেছেন; দিল্লি ‘দাঙ্গা’র ষড়যন্ত্রেও তিনি নাকি যুক্ত ছিলেন। অতীতে তাঁর দু’টি অনাথ আশ্রমে ‘জাতীয় শিশু অধিকার কমিশন’ শিশু নির্যাতনের অভিযোগে হানা দিয়েছিল। এবারও এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) প্রায় সারা দিন ধরে এই দু’টি আশ্রমে তল্লাশি চালায়। প্রায় 600 জন বিশিষ্ট ব্যক্তি সরকারের এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা করেন। এঁদের মধ্যে আছেন রোমিলা থাপার, জঁ দ্রেজ, অরুণা রায়, আনন্দ পট্টবর্ধন ও কবিতা কৃষ্ণন।
এখন আয়কর হানার মরসুম চলছে। এর ছয় দিন আগেই বলিউড অভিনেতা সোনু সুদের বিভিন্ন অফিস ও বাড়িতে পরপর তিন দিন আয়কর বিভাগের অফিসাররা তল্লাশি চালান। তাঁরা অভিনেতার বিরুদ্ধে লখনউয়ের একটি আবাসন সংস্থার সঙ্গে চুক্তিতে কর ফাঁকির অভিযোগ এনেছেন। আমরা জানি সোনু সুদ তাঁর সেবামূলক কাজের জন্য বিখ্যাত। করোনা মহামারীর বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি দুঃস্থ মানুষদের অকাতরে সাহায্য করে গেছেন। সাম্প্রতিক অতীতেও বিজেপি তাঁর কার্যকলাপের প্রশংসা করেছে। অভিযোগ দিল্লির আম আদমি পার্টির সরকারের ‘দেশ কি মেন্টর’ প্রোগ্রামের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডার হওয়ার পর থেকেই তিনি প্রশাসনের রোষানলে পড়ে যান। এই একই সময়ে ‘হিন্দু আইটি সেল’ নামক একটি সংস্থা সাংবাদিক রানা আয়ুবের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে। তাদের অভিযোগ কোভিডে আক্রান্তদের জন্য তিনি যে প্রতিষ্ঠানগুলি চালান, তাতে অর্থনৈতিক গড়মিল রয়েছে। প্রসঙ্গত এই রানা আয়ুব হচ্ছেন সেই অকুতোভয় সাংবাদিক, যাঁর সাড়া জাগানো বই ‘গুজরাত ফাইলস’ গুজরাতের দাঙ্গায় তৎকালীন রাজ্য সরকারের চূড়ান্ত পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা বিশ্বের সামনে উন্মোচিত করেছিল।
সরকার এই ধরনের অসমসাহসী সাংবাদিক এবং সংবাদ সংস্থাকে ভয় পায়। তাই ধমকে চমকে তাঁদের দমন করার চেষ্টা করে, কলাটা মূলোটা দিয়ে তাঁদের বশে আনার চেষ্টা করে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে তারা ডিজিটাল পোর্টাল নিউজক্লিকের অফিসে হানা দিয়েছিল। জুন মাসে হানা দেয় নিউজলন্ড্রির অফিসে। এই দু’টি পোর্টাল সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলন, কৃষক আন্দোলনের সংবাদ ধারাবাহিক ভাবে পরিবেশিত করেছে, সরকারের বিভিন্ন নীতির সমালোচনা করেছে, প্রভাবশালী কর্পোরেটদের বিরুদ্ধে খবর করেছে। পরিণাম ইডি, আয়করের হানা। সেপ্টেম্বর মাসে পুনরায় এই দু’টি সংস্থার অফিসে হানা দেওয়া হয়। জুলাইয়ে হিন্দি সংবাদপত্র দৈনিক ভাস্কর এবং উত্তরপ্রদেশের একটি টিভি চ্যানেল ভারত সমাচারের অফিসে দীর্ঘ সময় ধরে তল্লাশি হয়েছে। দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাত, উত্তরপ্রদেশে সংবাদপত্রের প্রায় তিরিশটি অফিসে অফিসাররা হানা দেয়। এই দু’টি সংস্থাই ওই রাজ্যে মহামারীর সময় প্রশাসনের শোচনীয় ভূমিকা ধারাবাহিক ভাবে উদঘাটিত করেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসে দৈনিক ভাস্করের সম্পাদক ওম গৌরের প্রতিবেদন ‘দ্য গ্যাঞ্জেস ইজ রিটার্নিং দ্য ডেড...’ বিশ্বের দরবারে কোভিড মোকাবিলায় উত্তরপ্রদেশ সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা উন্মোচিত করে দিয়েছে। এর ফলে রাজ্য সরকার ওই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সংবাদপত্রকে যেমন সরকারের বশংবদ এজেন্সি দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে, তেমনই বিজেপির সাম্প্রদায়িক অ্যাজেন্ডাকে যারা নস্যাৎ করার লাগাতার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচার করা হচ্ছে। অপইন্ডিয়া পোর্টালটি সম্পর্কে অতীতে এখানে আলোচনা হয়েছে। এই পোর্টাল বুক ফুলিয়ে বলে তারা লিবেরাল মিডিয়ার বিরোধী এবং তারা বিজেপি ও হিন্দুত্বের মতাদর্শকে সমর্থন করে। সম্প্রতি এরা কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইংরাজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফকে একটি ‘অতিবাম’ প্রচার মাধ্যম হিসাবে অভিহিত করেছে (অপইন্ডিয়া-09/09/2021)। আনন্দবাজার গোষ্ঠীর ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকা, বাজার অর্থনীতির ধারক ও বাহক, সমস্ত ধরনের বামেরা যাঁদের এক সময় ‘সিআইএ-র দালাল’ বলে গালি দিত (এখনও কেউ কেউ দেয়), তাদেরকেই কিনা বলা হচ্ছে অতিবাম! এক্ষেত্রে জুতসই প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, কত্তা এইডা শুনলে তো ঘুড়ায়ও হাসব! অপইন্ডিয়ার অভিযোগ বেহালার অক্সফোর্ড মিশনের মতো বিভিন্ন মিশনারিরা কলকাতায় ধর্মান্তকরণ করছে এবং টেলিগ্রাফ পত্রিকা ধ্রুপদী সঙ্গীতের মাধ্যমে তাঁদের হয়ে প্রচার করছে। এই মিশনারিরা যে ধর্মান্তকরণ করছে, সেটার কোনও প্রমাণ কিন্তু তারা দেখাতে পারেনি। এই ধরনের কুৎসা, ভিত্তিহীন ঘৃণা-প্রচারে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, বিজেপি আমলে এটাই দড়।
ইডি এবং আয়কর দপ্তরের হানা, তল্লাশির কিছু নিয়মকানুন আছে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক যে, উপরোক্ত ক্ষেত্রগুলিতে এই দু’টি দপ্তরের অফিসাররা বারবার এইসব নীতি লঙ্ঘন করেছেন, তাঁরা তাঁদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। প্রথমত আয়কর অফিস বলছে এগুলি ‘সার্ভে’, রেইড বা তল্লাশি নয়। আইটি আইনের ধারা 133 (A) অনুযায়ী ‘সার্ভে’-তে যে নির্দিষ্ট কারণে তদন্ত করা হচ্ছে, শুধু সেই বিষয় সংক্রান্ত তথ্যই অফিসাররা অভিযুক্তদের থেকে সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু নিউজলন্ড্রির সিইও অভিনন্দন শেখরি অভিযোগ করেছেন যে, তাঁর ব্যক্তিগত মোবাইল, ল্যাপটপ এবং অফিসের দু’টি কম্পিউটার থেকে তথ্য ডাউনলোড করা হয়েছে। এইভাবে সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত ও পেশা সংক্রান্ত তথ্য অফিসাররা হস্তগত করেছেন, যা ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরোধী। দ্বিতীয়ত, এজেন্সিগুলি হানার শুরুতেই সমস্ত কর্মচারীর মোবাইল কেড়ে নেয়, যার ফলে বাইরের সঙ্গে তাঁদের সংযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। যাঁরা বাড়ি থেকে কাজ করছিলেন, তাঁরা বারবার চেষ্টা করেও অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হন। তৃতীয়ত, সিইও শেখরিকে তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করে তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকরা। চতুর্থত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তল্লাশি চলাকালীনই অফিসাররা ঘোষণা করে দেন যে, এই সংস্থাগুলি ভুয়ো লেনদেনে যুক্ত আছে। এর অর্থ বিচার তো অনেক পরের ব্যাপার, কোনও প্রমাণ পাওয়ার আগেই তাঁরা সংস্থাকে দোষী সাব্যস্ত করে দেয়। এটা দিল্লি দাঙ্গা বা ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্তদের যে ভাবে মিডিয়া ট্রায়াল করে বিচারের আগেই দোষী ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে, সেটার সমতুল্য। যেমন দৈনিক ভাস্করে তল্লাশি চলাকালীন ‘সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যক্সেস’ ঘোষণা করে দেয় যে, এরা 2200 কোটি টাকার ভুয়ো লেনদেনে যুক্ত। একইভাবে নিউজক্লিকে তল্লাশির সময় ইডি জানিয়ে দেয়, এই সংস্থা 30.51 কোটি টাকা বেআইনি ভাবে বিদেশে পাঠিয়েছে।
আরও পড়ুন: টুঁটি চেপে ধরার পরেও আশা জেগে থাকে
এটা অন্যায়, অপরাধ! তথ্য বলছে মার্চ, 2011 থেকে জানুয়ারি, 2020 পর্যন্ত ইডি এইরকম 1700টি তল্লাশি করেছে, যার মধ্যে তদন্ত হয়েছে 1569টি ক্ষেত্রে, শাস্তি হয়েছে মাত্র 9টি ক্ষেত্রে, শতাংশের হিসাবে যা প্রায় 0.5 শতাংশ। তাহলে আগ বাড়িয়ে কীভাবে তারা এই সংস্থাগুলির সম্মানহানি করছে? কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার পড়ে ইডির হানাদারি বেড়েছে। 2012 সালে 99টি, 2017 সালে 450টি, 2019-এ লাফ দিয়ে বেড়ে সেটাই 670টি। একই বছরে আয়কর বিভাগের করা তল্লাশির সংখ্যা 570টা, যার মধ্যে মাত্র 20 শতাংশ ক্ষেত্রে শাস্তি হয়েছে (ওয়্যার-03/03/2020)।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিজেপি ইডি, আয়কর দপ্তর, সিবিআই ইত্যাদি সংগঠনকে মিডিয়ার কন্ঠরোধ এবং নাগরিক আন্দোলনকে দমন করার জন্য ব্যবহার করছে। এমনকি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতো একটি প্রতিষ্ঠান আজ সরকারের অঙ্গুলিহেলনে চলছে। আজ কোনও বিজেপি নেতার বাড়ির সামনে বোমা পড়লে এনআইএ-কে দিয়ে তদন্ত করানো হচ্ছে, অথচ NIA গঠন করা হয়েছিল সন্ত্রাসবাদ দমন এবং জাতীয় নিরাপত্তা যাতে বিঘ্নিত না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য। বিচার ব্যবস্থাও পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েছে। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় বিচারকরা সরকারি আইনজীবীর বয়ানের ওপর ভরসা করে, প্রমাণ, অভিযোগের বিন্দুমাত্র যাচাই না করে নির্দ্বিধায় ভুয়ো অভিযোগে ধৃত সমাজকর্মীদের জামিন বাতিল করে দিচ্ছে। বিজেপি কেন সমস্ত প্রতিষ্ঠান নিজেদের লোক দিয়ে চালানোর চেষ্টা করছে, তারা কেন এত ভীত? সরকারি প্রচারের ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা বেলুন কি ক্রমশ চুপসে আসছে?
সরকার বিরোধিতা করলে উইচ-হান্ট কিন্তু চলছেই
এই ধরণের অপরাধের তালিকায় উত্তর প্রদেশের নাম শীর্ষে (15.3 শতাংশ)।
প্রশাসক প্যাটেলকে দিয়ে মুসলিম প্রধান লক্ষদ্বীপের স্বাতন্ত্র্য ধ্বংস করতে চায় বিজেপি।
জনজীবনকে ধ্বংস করে উন্নয়নের মোড়কে দেউচা পাঁচামিকে পুঁজিপতিদের মুক্তাঞ্চল করতে চাইছে তৃণমূল সরকার।
উত্তরপ্রদেশে আইনের প্রয়োগ অখন নাগরিকের ধর্মের উপর নির্ভর করে।
প্রচার মাধ্যম পাল্টালেও পুরনো দিনের ভোটচিত্র ও রাজনীতির স্লোগানের সঙ্গে আজকের অনেকই মিল।