রাজনৈতিক প্রচার বিশেষ করে নির্বাচনী বাকযুদ্ধ কি কোনওদিনও শ্রুতিমধুর ছিল? আজকে কোনও মন্ত্রীর বিশাল বপু নিয়ে যখন বিদ্রুপ করা হয়, কারও পদবি নিয়ে যখন মঞ্চে সুর করে ছড়া বাঁধা হয়, নানা ভাবে প্রকাশ্যে বা অন্তরালে যখন নেত্রী ও তাঁর পরিবারের গুষ্টির তুষ্টি করা হয়, তখন আমরা অবাক হয়ে ভাবি রাজনীতির মান এতটাও নীচে নামতে পারে! এটা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে যা ছিল, তার চেয়ে নেতানেত্রীদের মন্তব্য, ভাষণ আরও অশোভন, কদর্য হয়েছে। ভাষার মান, শব্দচয়নের অধোগতি লজ্জাজনক বললেও কম বলা হয়। কিন্তু এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, ষাটের দশকে রাজনৈতিক প্রচার তখনকার দিনের নিরিখে খুব ভদ্র বা শালীন ছিল। দেশভাগের পর বাংলার রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় ধরে যুযুধান দুই পক্ষ কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি বা তাদের নেতৃত্বে জোট। কমিউনিস্টরা ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করছে। 1952 সালের11% ভোট, পাঁচ বছর বাদে বেড়ে প্রায় 34% হয়েছে। তখন তাঁদের সংগ্রামী স্লোগান,
চাষ করে আর কাটে ধান
জমির মালিক সেই কিষাণ।
কমিউনিস্টদের উত্থানে কংগ্রেস তখন সন্ত্রস্ত। তাঁদের পাল্টা স্লোগান শালীনতার মাত্রা ছাড়ায়,
লাল সুতো নীল সুতো
কমিউনিস্টদের মারো জুতো।
কিংবা,
মাটির তলায় পাখির বাসা,
কমিউনিস্টদের ভোটের আশা।
1962-র চিন-ভারত যুদ্ধের পর কমিউনিস্টরা কোণঠাসা, সর্বত্র তাঁদের চিনের দালাল বলে গাল দেওয়া হচ্ছে। এই সময় কংগ্রেসের সম্পাদক দোর্দণ্ডপ্রতাপ অতুল্য ঘোষ যিনি বিরোধী দলগুলির সৌজন্যে জনস্মৃতিতে ‘কানা অতুল্য’ নামে অধিক পরিচিত। তখন রাজ্যে আকাল, চারিদিকে প্রবল খাদ্যাভাব। খাদ্য আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। আমরা সবাই জানি ফরাসি বিপ্লবের সময় রানী মেরি আঁতোয়ানেৎ বুভুক্ষু চাষিদের বলেছিলেন, ‘পাঁউরুটি নেই, ওরা কেক খাচ্ছে না কেন!’ একই ঢংয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের অবাক প্রশ্ন, ওরা কাঁচকলা খাচ্ছে না কেন। বাজারে তখন টাটকা বেগুন পাওয়া যেত না, সবই কানা বেগুন। কমিউনিস্টরা সুযোগ পেয়ে গেল, তারা প্রত্যাঘাত করল,
ইন্দিরা মাসি বাজায় বাঁশি
অতুল্য বাজায় ঢোল,
আয় প্রফুল্ল খেয়ে যা
কানা বেগুনের ঝোল।।
1964-তে কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হয়ে গেল। 1967 এবং 1969-এ পরপর দু’টি ক্ষণস্থায়ী যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হল। তারা নিয়মিত রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনার কথা তুলতেন। তখন কংগ্রেস স্লোগান লিখল,
কেন্দ্রের নামে দিয়ে দোষ,
সাধু সাজে জ্যোতি বোস।।
এই সময় ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেসের প্রবল প্রতাপশালী বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের বিতাড়িত করে উল্কার মতো উঠে এলেন। রাজন্যভাতা বিলোপ, ব্যাঙ্ক, কয়লা খনির জাতীয়করণ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সখ্যের কারণে তাঁর একটা সমাজতান্ত্রিক ভাবমূর্তি তৈরি হল। সিপিএম বিদ্রুপ করে স্লোগান লিখল,
ইন্দিরা গান্ধীর সমাজতন্ত্রের অংশীদার,
টাটা, বিড়লা, সিংহানিয়া আর 75টি পরিবার।
সিপিআই কিন্তু ইন্দিরার এই সোভিয়েত ঘনিষ্ঠতায় বিগলিত। তারা 1971-এর নির্বাচনে ইন্দিরা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধল। তখন কংগ্রেসের প্রতীক গাই বাছুর। সিপিএম একটা স্মরণীয় স্লোগান রচনা করল,
দিল্লি থেকে এল গাই,
সঙ্গে বাছুর সিপিআই।।
এর পরেই এসে গেল মহাবিতর্কিত, মহাচর্চিত, রক্তক্ষয়ী নকশাল আন্দোলন। ‘বন্দুকের নলই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস’ স্লোগান তখন গ্রাম শহর কাঁপাচ্ছে। তাদের বহু স্লোগানের মধ্যে অনবদ্য একটি হচ্ছে,
পুলিশ তুমি যতই মারো
মাইনে তোমার একশো বারো।
সেই অভুতপূর্ব দমনপীড়নের সময়ে সরাসরি রাষ্ট্রবিরোধী এই স্লোগান শত্রুর চোখে চোখ রেখে কথা বলার সামিল। তাঁরা আওয়াজ তুললেন, ‘সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করো।‘ মুক্তি আসল আরেক বাংলায়, ভুমিষ্ঠ হল স্বাধীন বাংলাদেশ। লোকের মুখে মুখে তখন একটাই গান,
শোনো, একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।
বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।।
বারো কোটি দেবদেবীর সঙ্গে আরও এক দেবী সংযোজিত হলেন, দিকে দিকে কংগ্রেসিরা ঘোষণা করলেন তাঁদের নেত্রী ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’। জরুরি অবস্থার প্রাক্কালে দেবকান্ত বড়ুয়া নির্লজ্জ চাটুকারিতার অনন্য নজির স্থাপন করলেন, যখন তিনি আওয়াজ তুললেন,
ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা!
তারপর এই রাজ্যে শুরু হল ৩৪ বছরের সুদীর্ঘ বাম শাসন। দেওয়ালে তখন জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের ডাক, ‘রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা’র দাবি। কার্ল মার্ক্সও ফিরে এলেন:
মার্ক্সবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ ইহা বিজ্ঞান।
যে কোনও নির্বাচন এলেই তখন তাৎক্ষণিক ও প্রাসঙ্গিক ইস্যু ছাড়া যে বিষয়টি অবশ্যই বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হত তা হল, ’72 থেকে ’77-এর কংগ্রেসি অত্যাচার ও 1100 সিপিএম কর্মী খুন হওয়ার কাহিনি। ধীরে ধীরে বিপ্লবের ডাক ফিকে হয়ে এল, ‘বামফ্রন্ট সরকার, সংগ্রামের হাতিয়ার’ স্লোগানটাও একঘেয়ে হয়ে এলো। অর্থনৈতিক উন্নতি থমকে গেল। এই সময়ই ‘উন্নততর বামফ্রন্ট’ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করে নতুন করে মানুষের মধ্যে প্রাণসঞ্চারের প্রচেষ্টা শুরু হল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হলেন এই উন্নততর বামফ্রন্টের মুখ এবং কাকতালীয়ভাবে নতুন শতাব্দীর দু’বছর আগে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম এবং নির্বাচনী রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রমরমা শুরু। দল গঠনের মাত্র তিন বছরের মধ্যে 2001-এর নির্বাচনে 60টি আসন ও প্রায় 31% ভোট পেয়ে তিনি প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী হয়ে গেলেন। তাঁদের জনপ্রিয় স্লোগান, ‘হরে কৃষ্ণ হরে হরে/তৃণমূল ঘরে ঘরে’, যেটা এখন বিজেপি হাইজ্যাক করেছে।
সমর্থকরা যাতে চিহ্নিত না হয়ে যান, তাই তৃণমূল মন্ত্র দিল,
চুপচাপ ফুলে ছাপ।
স্বাধীনতার পূর্বে চল্লিশের দশকের ‘মহিলা আত্মরক্ষা বাহিনী’ থেকে পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলার রাজনীতিতে মহিলারা চিরকালই সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু এই প্রথম একজন মহিলা বিরোধী দলের নেত্রী হয়ে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলেন। এটা লক্ষণীয় যে ঠিক এই সময় থেকেই রাজনীতিতে শিষ্টাচার ধীরে ধীরে অন্তর্হিত হতে শুরু করল। এর দু’টি কারণ হতে পারে। আমাদের সমাজ ঘোরতর ভাবে পিতৃতান্ত্রিক, আমাদের রাজনীতিও তাই। সেজন্যই মণিকুন্তলা সেন, কনক মুখার্জি, গীতা মুখার্জির মতো নেত্রীরাও তাঁদের দলে পার্শ্বচরিত্র হয়েই রয়ে গেছেন। নকশাল মেয়েদের আত্মত্যাগ অবিস্মরণীয়, কিন্তু কোনও মহিলা উচ্চতম নেতৃত্বে জায়গা পাননি বা পেতে দেওয়া হয়নি। মমতা এসে এই স্থিতাবস্থাটাকে ঘেঁটে দিলেন। দ্বিতীয়ত, তাঁর অনুগামীরা মূলত নিম্নশ্রেণী, নিম্নবর্ণের মানুষ। তাঁদের কথাবার্তায় কোনও পালিস নেই, ভাষা সেই অর্থে ‘ছোটোলোকি’। বাংলার রাজনীতিতে ‘ভদ্রলোক’দের মৌরসিপাট্টা ভাঙার জন্য তাঁরা মরিয়া, উদ্ধত, বেলাগাম। যত্রতত্র গালাগাল দেওয়ার জন্য দলে নেত্রীর এক ছায়াসঙ্গিনী কুখ্যাত হয়ে গেলেন, যিনি আবার এবারের ভোটে দলের মনোনয়ন না পেয়ে সেদিন রাতেই দল বদলের ইচ্ছাপ্রকাশ করেছেন। এঁদের এই ভাষিক হামলা বামেদের বিচলিত করে দিল এবং তাঁদের কথাবার্তাতেও প্রভাব ফেলতে শুরু করল। সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা বিচারপতি অমিতাভ লালার প্রতি কামান দাগলেন, ‘লালা তুই বাংলা থেকে পালা’। আবার জননেত্রীকে সিপিএমের দুই বর্ষীয়ান নেতা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ, কদর্য ভাষায় আক্রমণ করে বসলেন। মানুষ শিউড়ে উঠলেন। তাঁরা পরে ক্ষমা চান, কিন্তু সিপিএমের ভাবমূর্তি এতে ধাক্কা খায়। অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থা থেকে উতরানোর জন্য সিপিএম নীতি প্রণয়ন করল,
কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ।
কৃষিজমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে পাল্টা স্লোগান পড়ল,
বুদ্ধের জমানায়, উন্নয়ন হবেই হবে,
ধনী আরও ধনী হয়ে
গরিবের হাড় চিবিয়ে খাবে।।
এসে গেল 2011-র নির্বাচন, ‘পরিবর্তন’ -এর ডাক। ‘মা, মাটি, মানুষ’ 34 বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটাল। ক্ষমতায় আসার পর নেত্রী সমর্থকদের সতর্ক করলেন, ‘বদলা নয় বদল চাই’। কিন্তু 2013 সাল এবং 2018-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যকে ‘বিরোধীশূন্য’ করার তাগিদে সিপিএম কর্মীদের ওপর হিংসাত্মক আক্রমণ সত্তরের দশকের সেই স্লোগানটির কথা মনে পড়িয়ে দিল, ‘নির্বাচনে শাসক পাল্টায়, শোষক পাল্টায় না’। নারীদের প্রতি আচরণেও দেখা গেল একই গল্প। রাজ্যের নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডের ওপর বেনজির আক্রমণ হল। তমলুকের প্রবল প্রতাপশালী বিধায়ক ও মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী, যিনি আজ বিজেপির নয়নের মণি, তিনি হুমকি দিলেন, ‘পিপীলিকার পাখা ওড়ে মরিবার তরে’। তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী তাঁর চেহারা নিয়ে অশালীন মন্তব্য করলেন। এমনকি প্রতিহিংসা নেওয়ার হুমকি দেওয়া হল সেই ঋজু, ব্যক্তিত্বসম্পন্না আইপিএস অফিসারকে।
এখন ডিজিটাল প্রচারের যুগ। প্রথম দফার ভোটের মাত্র কুড়ি দিন বাকি, কিন্তু শহরের দেওয়ালগুলো এখনও খাঁখাঁ করছে। পোস্টার, লিফলেটিং তো প্রায় দেখাই যায় না। পাড়ার অলিগলিতে ছোট সর্পিল মিছিলও উধাও। এখন সোশাল মিডিয়ায় ধামাকা হচ্ছে। সিপিএমের ব্রিগেডের আগে তো ‘টুম্পা সোনা’ বাজার কাঁপাল,
টুম্পা তোকে নিয়ে ব্রিগেড যাব,
টুম্পা চেনাফ্ল্যাগে মাঠ সাজাব।।
এর পাশে ‘খেলা হবে’ সুপার হিট। বিরোধীদেরও জবাব তৈরি,
বুড়ি মায়ের স্বাস্থ্যসাথী
ফুলিয়ে বলে বুকের ছাতি
অপারেশন ফ্রিতেই হবে
খেলা খেলা খেলা হবে।।
এই দু’টি প্যারোডির পাশে বিখ্যাত ইতালিয় ফ্যাসিস্ট-বিরোধী গান ‘বেলা চাও’-র নকল বিজেপির ‘পিসি যাও’ নেহাতই ম্যাড়ম্যাড়ে। সাড়া ফেলে দিয়েছে বিভিন্ন বামপন্থী গোষ্ঠী, সংগঠনের মঞ্চের আহ্বান, ‘বিজেপিকে একটিও ভোট নয়’, ‘NO VOTE TO BJP’। নির্বাচনে সব দলই বলে ভোট দাও, এই একটি সংগঠন আওয়াজ তুলেছে একটি দলকে ভোট না দিতে। এটা অভিনব! অতি সম্প্রতি এঁদের একটি ভিডিও জনপ্রিয় হয়েছে,
10 এর মিছিল দিচ্ছে ডাক/বাংলায় বিজেপি নিপাত যাক।
বিজেপি আবার এনেছে হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর-এর সুরে,
খাও ধর্মের ক্ষীর,
ইনকিলাব নারায়ে তকদির।
অপেক্ষার আর বেশি দিন নেই। 2 মে আমরা জেনে যাব বাংলার মানুষ কাকে বেছে নিল।
ঋণ স্বীকার: শুভ লাহিড়ী-সময়ের দাবি ও শ্লোগান (আমাদের কথা-ফেব্রুয়ারি-2007)
দ্রৌপদীরা নগ্ন হয়ে প্রতিবাদী হলে পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভয় পায়, নিজেদের কৃতকর্ম ঢাকা দিতে চায়।
দেশ কৃষিতে উদ্বৃত্ত, অথচ ক্রমবর্দ্ধমান অনাহারে থাকা মানুষের সংখ্যা- হিসেবে ভুল হচ্ছে কোথায়?
শাসকের সদ্ভাবনা অসম্ভব, সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞাই অপ-প্রযুক্তি দমনের পথ।
এই সব অঞ্চলে উন্মুক্ত কয়লা খননের কারণে পরিবেশের সমূহ ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
দেশের গরিব মানুষের খাবার নেই, দুর্বলের অবস্থা আরও খারাপ, সেই খবর প্রকাশেও বাধা
নানা ধরনের দমনমূলক আইনের প্রয়োগ এবং সরকার-বিরোধী সমস্ত প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়ার যে প্র