তাঁর মৃত্যুতে স্বয়ং কবিগুরুর কলম থেকে বেরিয়েছিল সেই অমোঘ দু'টি লাইন, ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।' যাঁর সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক বিরোধিতা তৎকালীন ভারতবর্ষে অন্যতম চর্চার বিষয় ছিল, সেই গান্ধী তাঁর প্রতি অকৃপণ শ্রদ্ধায় লিখেছিলেন, ‘নিতান্ত সংকট সময়েও হিন্দু-মুসলমানকে সম্মিলিত রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন উনি।' সমকালীন ভারতবর্ষের অন্যতম দুই চিন্তক, গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথ যাঁর সম্পর্কে এই দরাজ সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, তিনি ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশ। কৃতি ছাত্র সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক গুরু হিসাবে বিদগ্ধ আলোচনায় কখনও কখনও তাঁর ঠাঁই মেলে। কিন্তু নিজের অতিস্বল্প রাজনৈতিক জীবনে সুগভীর ছাপ রেখে যাওয়া চিত্তরঞ্জন প্রহেলিকা হয়েই রয়ে যান। এই বছর 5 নভেম্বর এই মানুষটির জন্ম সার্ধশতবর্ষ। ‘দেশবন্ধু’ আখ্যায় ভূষিত করা বাঙালির কতজনই বা মনে রেখেছেন চিত্তরঞ্জনকে?
আইসিএস পরীক্ষায় সাফল্য মেলেনি। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ব্যারিস্টারিকেই পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। ভালই পসার জমিয়েছিলেন, উকিল হিসাবে নামডাক ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। ইতিমধ্যে দুই স্বাধীনতা সংগ্রামী ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় এবং ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের হয়ে সওয়াল করে তাঁদের প্রায় নিশ্চিত কারামুক্তির হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন। তবে, 1908 সালে আলিপুর বোমা মামলায় প্রধান অভিযুক্ত অরবিন্দ ঘোষের হয়ে তাঁর যুক্তি ও আবেগমিশ্রিত সওয়ালে হতবাক হয়ে গিয়েছিল কোর্টরুম। মুক্তি পেয়েছিলেন অরবিন্দ সহ অন্যান্য অভিযুক্তরা। আইনজীবী হিসাবে তিনি যখন খ্যাতির মধ্যগগনে, ঠিক তখন সহসাই জীবনের বাঁক বদলে সক্রিয় রাজনীতিতে নামলেন। বিদ্রুপ, বিরোধিতা সইলেন, শ্রদ্ধা-ভালবাসাও কুড়োলেন শত শত।
দেশের রাজনীতির মধ্যগগনে তখন গান্ধীজি। নেহরুর পরিভাষায়, কংগ্রেসে তখন গান্ধীর ‘সুপার প্রেসিডেন্সি’ চলছে। গান্ধী চাইছেন, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে সমমনস্ক মানুষরাই শুধু থাকুন। সেই গান্ধী এবং গান্ধী অনুগামীদের কিছুটা ম্লান করে দিয়েই চকিত উত্থান চিত্তরঞ্জনের। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে তিনি মুষ্টিমেয় গান্ধী বিরোধী স্বরের অন্যতম। 1919 সালের কংগ্রেসের অমৃতসর অধিবেশনে গান্ধী বললেন, ‘মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইন মেনে নেওয়াই ভাল।' দলের চরমপন্থী অংশের মধ্যমণি হয়ে চিত্তরঞ্জন গান্ধীর এই বক্তব্যের বিরোধিতা করলেন এবং এই আইনকে পরিত্যাগ করার পক্ষে সম্মতি জানালেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পাল্টে গেল পাশার দান। গান্ধী এবং চিত্তরঞ্জন দু'জনেই এই প্রশ্নে তাঁদের অবস্থান বদলে ফেললেন। ভারত ভাগ্যবিধাতা বুঝি চেয়েছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন দু'টি পথ ধরে তাঁদের আন্দোলন পরিচালিত হোক। 1920-র কলকাতা কংগ্রেসে গান্ধী খিলাফৎ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনের বিরোধিতা করলেন। চিত্তরঞ্জন বললেন, দীর্ঘ সংগ্রামে যখন ভারতীয় হিসাবে কাউন্সিলে সামান্য প্রবেশাধিকার মিলছে, তখন তার সদ্ব্যবহার করাই উচিত। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চিত্তরঞ্জন এই অবস্থান থেকে সরেননি।
ইদানিং, স্বাধীন বাংলার "কারিগর' হিসাবে আর এক বঙ্গজ রাজনীতিকের নাম সুকৌশলে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফজলুল হক মন্ত্রীসভার মন্ত্রী হিসাবে মন্বন্তরের সময় দুঃস্থদের চাল চুরি, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের খুল্লমখুল্লা বিরোধিতা এবং বাংলার সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মদত জোগানো— তাঁর কৃতিত্বের মুকুটে পালকের অভাব নেই! অনৈতিহাসিক এই প্রচারের ঢক্কানিনাদে ঢাকা পড়ে গেছে এই বাংলাকে কেন্দ্র করেই চিত্তরঞ্জন দাশের এক মহতী উদ্যোগের কথা। এপার-ওপার, দুই বাংলাকে মেলাতে বেঙ্গল প্যাক্টের ভাবনা এবং উদ্যোগ দেশবন্ধুরই মস্তিস্ক প্রসূত। বেঙ্গল প্যাক্টে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শাসনক্ষমতা দেওয়ার কথা বললেন চিত্তরঞ্জন। এর বিরোধিতায় রেরে করে উঠল বাংলার হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজ। দলের মধ্যেও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল-রা এর বিরুদ্ধে মত রাখলেন। সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসু, কিরণশঙ্কর রায়, বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের মতো মানুষরা অবশ্য বেঙ্গল প্যাক্টের সমর্থনে এগিয়ে এলেন। 1925-এ দেশবন্ধুর অকালপ্রয়াণ না হলে, বেঙ্গল প্যাক্টের বাস্তবায়ন হলে হয়তো এই বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত হতে হত না। একটা নোয়াখালি বা কলকাতা দাঙ্গা দেখতে হত না। হায়…। ইতিহাসের অধ্যাপক জিষ্ণু দাশগুপ্ত বলছিলেন, ‘সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের জন্য আসন সংরক্ষণের মাধ্যমে তিনি নিজের দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। সাচার কমিটির রিপোর্ট এবং প্রস্তাবগুলোর দিলে চোখ বোলালেই তাঁর এই দূরদৃষ্টির প্রমাণ মেলে।‘
সিভিল সার্ভিসের চাকরিতে মুলতুবি টেনে সুভাষচন্দ্র গেলেন গান্ধীর কাছে স্বরাজের অর্থ জানতে এবং স্বরাজের সঠিক পথের সন্ধান করতে। গান্ধীর উত্তরে সুভাষ মোটেই সন্তুষ্ট হলেন না। গান্ধীও বুঝলেন, এই ছেলের ভিতরে দেশপ্রেমের চাপা আগুন জ্বলছে, যাকে সঠিক ভাবে উস্কে দিতে পারেন একমাত্র দেশবন্ধু। গান্ধী সুভাষকে চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে দেখা করতে বললেন। আজকের ভারববর্ষে, কোনও রাজনীতিক কি সঠিক পরামর্শ নেওয়ার জন্য তাঁর বিরুদ্ধ মত এবং পথের কোনও নেতার কাছে কাউকে পাঠাবেন? গান্ধী চিত্তরঞ্জনের নীতিগত লড়াই কখনওই ব্যক্তিগত শত্রুতার পর্যায়ে নামেনি। অধ্যাপক দাশগুপ্ত মনে করিয়ে দিলেন, এই চিত্তরঞ্জনই কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে গান্ধীর সঙ্গে আলোচনাক্রমে কংগ্রেসের সংগঠনে আমূল বদল আনলেন। যে সংস্কারগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল, ‘চার আনার সদস্যপদ’— যা কংগ্রেসের গণভিত্তিকে আরও মজবুত করেছিল।
চিত্তরঞ্জন স্বরাজ প্রশ্নে দীর্ঘসূত্রিতা চাননি। গান্ধীর সার্বিক বয়কটের সিদ্ধান্তেও তাঁর সায় ছিল না। তিনি কৌশলগত বয়কটের পক্ষে ছিলেন, কেননা তাঁর মনে হয়েছিল সার্বিক বয়কট কখনওই বাস্তবসম্মত কোনও পন্থা হতে পারে না। তবু, গান্ধীর রাওলাট সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অনন্ত সম্ভাবনা দেখলেন চিত্তরঞ্জন। সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনকে সফল করতে। স্ত্রী বাসন্তী দেবী, পুত্র চিররঞ্জনের সঙ্গে নিজেও কারাবরণ করলেন। গান্ধীর সঙ্গে মতান্তরে মতিলাল নেহরুকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি করলেন স্বরাজ্য দল। সালটা 1923। কাউন্সিলে প্রবেশ করে সাংবিধানিক পথে ব্রিটিশ শক্তির বিরোধিতা করাই তখন তাঁর দলের মূল লক্ষ্য। বাংলায় কংগ্রেস বলতে তখনও মানুষ চিত্তরঞ্জনকেই বোঝেন। এই বাস্তবতা গান্ধী দেশবন্ধুর জীবৎকালেই বারবার স্বীকার করেছেন। চিত্তরঞ্জন পারতেন, গান্ধী বিরোধিতাকে উচ্চগ্রামে নিয়ে গিয়ে নিজের মতো করে আন্দোলন পরিচালনা করতে। তিনি বাংলার ছাত্র-যুব, মুসলমানদের নয়নের মণি। চিত্তরঞ্জন স্বাতন্ত্র্য রেখেছেন, কিন্তু অহিংস সত্যাগ্রহের পথকে কখনও অবজ্ঞা করেননি।
ততদিনে জাতীয়তাবাদ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মোহভঙ্গ হয়েছে। জাতীয়তাবাদের এক ভয়ঙ্কর উগ্র রূপ তিনি দেখতে পেয়েছেন। তা সত্ত্বেও জাতীয়তাবাদী দেশবন্ধুর প্রয়াণে অমন দুটি পঙক্তি কেন লিখলেন কবি? রবীন্দ্রনাথ নিজেও বয়কট আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলেন। দেশবন্ধুর সার্বিক বয়কটের বিরোধিতায় কি তাঁর মধ্যে এক অনন্য নেতৃগুণের সন্ধান পেয়েছিলেন কবি? তাই কি চিত্তরঞ্জনের মৃত্যহীন প্রাণকে উপহার হিসাবে গ্রহণ করল তাঁর মন? স্থবির, নিশ্চল বয়কট নয়, ব্রিটিশ বিরোধিতায় এবং দেশের পুনর্নির্মাণে এক সজীবতার প্রত্যাশী ছিলেন কবিগুরু, যার সন্ধান হয়তো পেয়েছিলেন দেশবন্ধুর মধ্যেই। কিন্তু 1925-এ দার্জিলিং-এর ‘স্টেপ অ্যাসাইড’ নামক বাড়িতে অকালে চলে গেলেন চিত্তরঞ্জন। বহু রাজনৈতিক সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটল অচিরেই। এই স্টেপ অ্যাসাইড বাড়িতেই বিতর্কিত ভাওয়াল রাজার ‘মৃত্যু’ হয়েছিল। সন্নাসী হয়ে ভাওয়াল রাজা ফিরেছিলেন। চিত্তরঞ্জন অবশ্য ফেরেননি। সব ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি হয় না। হায়...।
লোকাল ট্রেনের অপেক্ষায় হয়রান মানুষের প্রশ্ন, করোনা কি ট্রেনে চড়তে ভাসবাসে আর বাসে ওঠে না?
প্রকারান্তরে, তামিলনাড়ু বা কর্নাটকের মতো রাজ্যের দুই-ভাষা নীতিতেই সিলমোহর দিল কেন্দ্র।
বারমুডা পরা খারাপ কিছু নয়, তবে সেটা মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।
বিশ্বে দেশ নামক ধারণাকে যত কঠিন করা হচ্ছে, দেশহীন শরণার্থীদের সংখ্যা ততই বাড়ছে।
বাংলার রাজনীতি ও সংস্কৃতির এই অধোগমনে রবীন্দ্রনাথ ব্যথিতই হতেন।
অখ্যাত মফঃস্বলের আরও অখ্যাত নদী বয়ে নিয়ে গেছে পুরনো স্মৃতিদের, তবু উৎসব ফিরিয়ে আনে এদের সকলকে।