এত বিপুল পান্ডিত্য নিয়েও যুধিষ্ঠির বুঝতে পারেন না দেশ কী? দেশ কি মানুষ তৈরি করে? ধর্মপ্রাণরা বলবেন এ সবই নিয়তির খেলা। ধর্মপ্রাণ হয়েও যুধিষ্ঠির জানেন জগতের প্রায় সব সীমারেখা টানা হয় হীন স্বার্থবুদ্ধি দিয়ে। যেভাবে একদিন হস্তিনাপুর আর ইন্দ্রপ্রস্থ দু'টো আলাদা দেশ হয়ে গিয়েছিল। যক্ষকে প্রশ্ন করেন ধর্মপুত্র, দেশ কী? যক্ষ বলেন জগৎকে যতটা সংকীর্ণ পরিসরে মাপা যায়, তার একক হল দেশ।
কাবুল থেকে আফগানরা দলে দলে পাড়ি দিচ্ছেন অনির্দেশের পথে। কোথায় দেশ, কোথায় জাত্যাভিমান? যদি এই বিশ্বটাকে আগাগোড়া বিভক্ত করা যায়, তাহলে দেখা যাবে দুই প্রান্তে অদ্ভুত এক বৈপরীত্য। এক প্রান্তে বলদর্পী শাসক দেশ নামক একটি ধারণাকে আরও মজবুত, আরও কঠিন করার কথা বলে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছচ্ছে। আর এক প্রান্তে যে বিশ্ব, সেই বিশ্বের বাসিন্দারা জানেই না দেশ কাকে বলে। প্রাণ বাঁচাতে পড়িমরি করে যতদূর দৌড়নো যায়, ততটুকই তাদের দেশ।
একদিকে শক্তিশালী করা হচ্ছে দেশ নামক ধারণাটিকে। আমেরিকায় মেক্সিকো থেকে শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ আটকাতে পাঁচিল তোলা হচ্ছে। আফগান শরণার্থী-স্রোত রুখতে গ্রিস এই মন্দাকালেও দীর্ঘ লোহার পাঁচিল তুলেছে। এই দেশ নামক গন্ডিবদ্ধ ধারণায় বিশ্বাস করে যারা স্বস্তিবোধ করেন, তাদের কাছে এ নিশ্চয়ই দেশহিতৈষী কাজ। যে কাজ করে, যে জাতীয় নিরাপত্তার বুকনি এঁটে শাসক গদিতে বসছেন আজকাল। অবশ্য অতীতেও হিটলারের জার্মানি, নেপোলিয়নের ফ্রান্সে এমন হয়েছে।
মার্কস, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী কিংবা গ্রামসি— এত মতপার্থক্য সত্ত্বেও বুঝি একটা জায়গায় এসে মিলে গেছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই দেশকে নিয়ে সন্দিগ্ধ ছিলেন আগাগোড়া। পরিবর্তে জোর দিয়েছিলেন সমাজের ওপর। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এই সমাজই ‘আত্মশক্তি’ জোগাবে। গান্ধী বলছেন স্বয়ংশাসিত গ্রামসমাজ— রামরাজ্যের কথা। অথচ সমাজটা টুকরো টুকরো করেই রাষ্ট্র তৈরি হল। সার্বভৌমত্বের ধারণা এল। দেশ স্বনির্ভর হল, ব্যক্তিমানুষ কি হল?
আরও পড়ুন: দুয়ারে তালিবান: ভাষণে সমস্যা মিটবে না
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শেষে কুর্দ শিশু আয়লানরা জলে ভেসে আসে। নিথর দেহের নাগরিকত্ব নিয়ে আর কেউ প্রশ্ন করে না। মাঝ আকাশে মার্কিন উড়োজাহাজে যে আফগান সদ্যোজাত জন্মাল তার নাম আর নাগরিকত্ব নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। নাগরিকত্ব নিয়ে নানা দেশের নানা নিয়ম। সেই নিয়মের চক্রব্যূহ এড়িয়ে বোধহয় বলা যায়, সদ্যোজাতটির নাম রিফিউজি। আর নাগরিকত্ব? মানবতা। এই পৃথিবীর বুকে একটা দেশের লোক না হলে কি বাঁচা যাবে না?
দেশ গড়ার নামে প্রহসন হয়েছে ঢের। কাঁটাতারে লেগে আছে কত মাংসপিন্ড আর রক্ত। বিশ্বলোকের সাড়া পেতে আমরা ‘আপন হতে বাহির’ হইনি। উল্টে দেশ নামক ধারণাকে এত শক্তপোক্ত করতে চেয়েছি যে, প্রতিবেশী দেশের বন্ধুটিকেও যেন শত্রু মনে হয়েছে বারেবারে। তবু ছিন্নমূল রিফিউজিরা বাঁচছে। চট্টগ্রামের শরণার্থী শিবিরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রোহিঙ্গারা বাঁচছে। সিরিয়ায় কুর্দ শিশু গুলির ফাঁকা খোল কুড়িয়ে সেটাকে পেনদানি করেছে। আফগানরাও দৌড়চ্ছে দিকবিদিকে।
2018-তে ফ্রান্স ফুটবল বিশ্বকাপ পেল। দেখা গেল টিমে প্রায় 6 জন শরণার্থী পরিবারের ছেলে রয়েছে। সদ্য সমাপ্ত অলিম্পিক্সেও না-দেশের বাসিন্দাদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। কঠিন জীবনসংগ্রাম এই রিফিউজিদের প্রেরণাশক্তি। তাই বলাই যায়, একদিন এই দেশহীনদের প্রত্যেকে একটা করে দেশ পাবে। সেই দেশে হয়তো কোনও কাঁটাতার থাকবে না। দেশের মাটি পাওয়ার লড়াই কতটা কঠিন, তা এরা জানে বলেই দেশ গঠনের নামে পররাষ্ট্রকে ধমকাবে চমকাবে না। জানি না সেই দেশের বাসিন্দারা রবীন্দ্রনাথকে চিনবে কিনা। তবে সেখানে অলক্ষ্যে হয়তো শোনা যাবে, ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো, সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।'
ধর্ম যাদের সঞ্জীবনী, সেনাশাসন যাদের গণতান্ত্রিক আভরণ, তাদের পথ আমরা কেন অনুসরণ করব?
স্বাধীনতার 75 তম বছরে যে গণ-আন্দোলন প্রতিস্পর্ধী শাসককে নতজানু করল, সেই আন্দোলনেরও প্রেরণা মহাত্মা।
ঈশান কোণে মেঘ থাকলেও বিসমিল্লার সুরে, ফৈয়জের কবিতায় এই দেশ বেঁচে থাকবে।
তাঁর মুখে আমরা 'শুনে' চমকে গেল লোকে, করোনা কাল কেটে গেলেও কি থাকবে এই বিনয়?
আসামের ফর্মুলায় বাংলা-জয় হল না বিজেপির।
বহু সঙ্কটেও মানুষকে বেঁচে থাকার শিক্ষা দিয়ে গেল 2020।