×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • দক্ষিণের চাপে নরম হল ‘উত্তরের দল'

    বিতান ঘোষ | 02-08-2020

    দেশের রাজনৈতিক নীতি-নির্ধারণে উত্তর ভারত চিরকালই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। তুলনায় বিন্ধ্য পর্বতের ওপারের দ্রাবিড়-ভূম খানিক কাব্যে উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। একদা গো-বলয়ের রাজনীতিতে হাত পাকানো বিজেপি এখন দেশের মসনদে। গত 6 বছর ধরে উত্তর-ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তাদের বিজয়-রথ ছুটেছে। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে এক কর্ণাটক ছাড়া আর কোনও রাজ্যে তারা বিশেষ কল্কে পায়নি। কিন্তু লোকসভায় 303টি আসনে জয়লাভ করা সর্বভারতীয়' বিজেপি এখন নিজেদের উত্তর ভারতের দল তকমা ঘুচিয়ে দাক্ষিণাত্য-বিজয়টাও সেরে ফেলতে চাইছে। তাদের 6 বছরের শাসনকালে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তারা বেশ কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। অভিযোগ, বিরোধী মত বা দেশের বহু কণ্ঠস্বরের প্রতিফলন সেখানে হয়নি। তবে দেশের নয়া শিক্ষানীতির ঘোষণায় দ্রাবিড় অস্মিতার কাছে কেন্দ্রকে কিছুটা হলেও পিছু হঠতে হয়েছে।

     

    1986 সাল থেকে চলে আসা শিক্ষানীতিতে আমূল পরিবর্তনের ইঙ্গিত আছে কেন্দ্রের নয়া শিক্ষানীতি (NEP)-র ঘোষণায়। যার মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হল, ইংরেজি সহ তিনটি ভাষায় পাঠ গ্রহণের সুযোগ। নয়া নিয়মে বলা হয়েছে এই দু'টি ভাষা কী হবে, তা ঠিক করবে সংশ্লিষ্ট রাজ্য, অঞ্চল অথবা পড়ুয়া নিজে। পড়ুয়ারা যাতে বিষয়বস্তুকে সহজে আত্মস্থ করতে পারে, তার জন্য পঞ্চম (প্রয়োজনে অষ্টম) শ্রেণী পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কথাও বলা হয়েছে। কেন্দ্রের এই তিন-ভাষা নীতির খসড়া গত বছরের জুন মাসেই প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানে অবশ্য ইংরেজি এবং একটি স্থানীয় ভাষার পাশাপাশি তৃতীয় ভাষা হিসাবে হিন্দি শেখানোর কথাও বলা হয়েছিল। দেশের দক্ষিণের দুই রাজ্য, তামিলনাড়ু এবং কর্নাটক এই খসড়া-নীতির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। ডিএমকে নেতা, করুণানিধি-পুত্র স্তালিন এবং কর্ণাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, কংগ্রেস নেতা সিদ্দারামাইয়া একে দক্ষিণ ভারতের বিরুদ্ধে কেন্দ্রের হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত বলে উল্লেখ করেন। অতীতে হিন্দিবিরোধী আন্দোলনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বড়সড় আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারিও দেন তাঁরা।

     

    প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, 1969 সালে ইন্দিরা গান্ধীর আমলে যে শিক্ষানীতি প্রবর্তিত হয়েছিল, তাতে এই তিন ভাষার ফর্মুলা মেনেই এগোনো হয়েছিল। দেশের প্রথম সেই শিক্ষানীতিতে হিন্দিভাষী অধ্যুষিত রাজ্যগুলোর জন্য ইংরেজি, হিন্দি এবং একটা আধুনিক ভারতীয় ভাষায় স্কুলশিক্ষা প্রদানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারত সহ অ-হিন্দি রাজ্যগুলোর জন্য ইংরেজি, হিন্দি এবং যে কোনও একটা ভারতীয় ভাষায় শিক্ষাদানের প্রস্তাব দেওয়া হয়। তামিলনাড়ু এই নীতি কোনওদিনই কার্যকর করেনি। হিন্দিকে বাদ দিয়ে তারা ইংরেজি এবং তামিল ভাষাকেই শিক্ষাদানের মাধ্যম করেছিল। অন্যান্য বেশ কিছু রাজ্যও নিজেদের সুবিধার্থে এই নীতিতে কিছু পরিবর্তন এনেছিল। এই প্রসঙ্গে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট অফ এডুকেশনের অধ্যাপিকা লীনা রাত্তি বলছিলেন, "হিন্দি বলয়ের বিভিন্ন রাজ্য তৃতীয় ভাষা হিসাবে পড়ুয়াদের সংস্কৃত পড়ায়। অথচ 1969-এর শিক্ষানীতিতে আধুনিক কোনও ভারতীয় ভাষাকে তৃতীয় ভাষা হিসাবে তাদের স্বীকৃতি দেওয়ার কথা। আর অবশ্যই সেই ভাষা সংস্কৃত হতে পারে না।

     

    তামিলনাড়ু অবশ্য গোড়া থেকেই দুই-ভাষা নীতি নিয়েই এগিয়েছে। 1937 সালে সে রাজ্যে দ্রাবিড় রাজনীতির উদগাতা রামস্বামী পেরিয়ারের হিন্দি বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলন দ্রাবিড় রাজনীতির পালে বাতাস জুগিয়েছিল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগাম। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে রাজাগোপালাচারী (তৎকালীন মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী), যুক্তপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থ, মোরারজি দেশাই-রা গোটা দেশেই হিন্দি বাধ্যতামূলক করার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু, ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবিতে অন্ধ্রে পট্টি শ্রীরামালুর অনশন আন্দোলন, পেরিয়ারের হিন্দিবিরোধী আন্দোলনের সামনে নেহরু কিছুটা ব্যকফুটেই খেললেন। হিন্দি নিয়ে সরাসরি কোনও ঘোষণা না থাকলেও, দক্ষিণের অ-হিন্দি রাজ্যগুলোর ওপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা আর করা হয়নি তাঁর আমলে। 1969-এর শিক্ষানীতিতেও তারই প্রতিফলন দেখা গেল, যখন তামিলনাড়ু সরাসরি জানিয়ে দিল তৃতীয় ভাষা হিসাবে তারা হিন্দিকে মানবে না।

     

    বিজেপির তরফে চেষ্টা ছিল দক্ষিণেও হিন্দিকে ঢুকিয়ে দেওয়ার। খসড়া নীতি প্রকাশ করে কেন্দ্র পরখ করে নিতে চেয়েছিল, দক্ষিণ ভারত বিষয়টাকে কীভাবে নেয়। সেখান থেকে জোরালো প্রতিবাদ ধেয়ে আসছে দেখে নতুন নীতিতে একধাপ পিছিয়ে বলা হল ইংরেজি, একটি স্থানীয় ভাষার পাশাপাশি অ-হিন্দি রাজ্যগুলো কোনও প্রাচীন বা ধ্রুপদী ভাষাকে তৃতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে পারবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থাৎ অন্য কোনও ভাষা থেকে কোনও শব্দ ধার না করার মানদণ্ডে তামিল, তেলেগু, কন্নড়, মলয়লম এবং ওড়িয়া— এই পাঁচটি ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দেওয়া হল। প্রকারান্তরে, তামিলনাড়ু বা কর্নাটকের মতো রাজ্যের দুই-ভাষা নীতিতেই সিলমোহর দিল কেন্দ্র। নিজেদের হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান ভাবমূর্তির বাইরে বেরিয়ে দক্ষিণের হৃদয় জয় করতে তাই হিন্দি নিয়ে সুর নরম করতে বাধ্য হল বিজেপি। উত্তর ভারতের দল'-এর এই দক্ষিণ-প্রীতি' শুধু ভোট রাজনীতির স্বার্থেই কিনা, তার উত্তর সময়ই দেবে।


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    নিছক খাওয়া-পরা নয়, দুর্গতদের পড়াশোনা আর স্বাস্থ্যেও সমান নজর দিতে চাইছে ‘জোনাকি’।

    বুকের মাঝে আস্ত একটা দেশকে যারা লালন করতে ব্যর্থ, তারাই ভাগাভাগির কথা বলে।

    যুদ্ধ-যুদ্ধ আবহে আপাতত ‘দেশপ্রেমী' সাজতে চাইছেন সবাই

    বাংলার রাজনীতি ও সংস্কৃতির এই অধোগমনে রবীন্দ্রনাথ ব্যথিতই হতেন।

    শুধুই কি উন্মাদনা, জনারণ্য আর আবেগ? মানুষের রুজিরুটিও তো এসব মেঠো সভা সমাবেশের সঙ্গে যুক্ত ছিল

    জন্মিলে মরিতে হইবে, ক্যাপিটালিজম সঙ্গ দেবে!

    দক্ষিণের চাপে নরম হল ‘উত্তরের দল' -4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested