×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • জীর্ণ সিডিশন যাক ভেসে যাক!

    বিতান ঘোষ | 10-05-2022

    প্রতীকী ছবি।

    জনপরিসরে ‘বিশৃঙ্খলা’ রুখতে ঔপনিবেশিক আমলে চালু হওয়া দেশদ্রোহিতা আইন বা সিডিশন অ্যাক্টের বৈধতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। এই আইনটি বৈধ না অবৈধ, তা নির্ধারণ করবে সুপ্রিম কোর্ট, এমনটাই স্থির হয়েছিল। তবে 10 মে এই নিয়ে শুনানির আগেই কেন্দ্র হলফনামা দিয়ে জানাল, তারা এই আইনের কিছু অংশের পুনর্বিবেচনা এবং পুনর্মূল্যায়নে আগ্রহী। তাই এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে 'সময়ের অপচয়' না করার অনুরোধ জানানো হয়েছে কেন্দ্রের তরফে।

     

    যে আইন খোদ ইংল্যান্ড সরকার 2009 সালে, স্কটল্যান্ডে 2010 সালে, নিউজিল্যান্ডের মতো ছোট দ্বীপরাষ্ট্রে 2007 সালেই বাতিল করা হয়েছে, সেই আইন বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে বহাল তবিয়তে থেকে গিয়েছে! ইন্দোনেশিয়ায় 2007 সালে, অস্ট্রেলিয়ায় প্রথমে 2005 সালে, পরবর্তী সময়ে আবার 2010 সালে, এমনকি অর্থনৈতিক ভাবে পশ্চাৎপদ ঘানাতেও 2001 সালে এই আইন বাতিল করা হয়েছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহু বছর ধরেই এই আইনের একাংশকে কার্যকর করা হয় না এবং প্রত্যেক নাগরিক যাতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন, সেই বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়।

     

    দেশদ্রোহিতা আইন প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এর আগে তাঁর একটি পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন,  ""এটি একটি ঔপনিবেশিক আইন। এই আইনবলে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করা হয়েছিল। এমনকি মহাত্মা গান্ধী, বাল গঙ্গাধর তিলকদের মতো মানুষদের কন্ঠরোধ কর‍তেও ব্রিটিশ প্রশাসন এই আইনের শরণাপন্ন হয়েছিল।''
     


    প্রধান বিচারপতি বলেন, ""অতীতের দিকে তাকালে আমরা দেখব, এই আইনের বিপুল ক্ষমতা অনেকটা কাঠুরের একটি গাছের পরিবর্তে গোটা বনটাকেই কেটে ফেলার সঙ্গে তুলনীয়।'' রমণার মতে স্বাধীনতার পরেও এই ধরণের আইনের ব্যবহার দুর্ভাগ্যজনক

     

    এই দেশে মহাত্মা গান্ধী থেকে হালের কানহাইয়া কুমার কিংবা লেখিকা অরুন্ধতী রায়, বহু শীর্ষ স্থানীয় রাজনীতিককেই এই মামলায় অভিযুক্ত এবং দণ্ডিত হতে হয়েছে। সরকার বিরোধী স্বরগুলির বিরুদ্ধেই এই আইনকে ‘ব্যবহার’ করা হয়েছে— সে স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতেই হোক বা স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে৷ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক দ্বারা প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, 2014 থেকে 2019 সালের মধ্যে, এই পাঁচ বছরে সারা দেশে মোট 326টি দেশদ্রোহিতার মামলা রুজু হয়েছে। আর এই মামলায় এই সময়ের মধ্যে মাত্র 6 জন দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন! এই অজামিনযোগ্য এই আইনে অভিযুক্তকে তিন বছর থেকে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত আটক রাখা যায়। এই আইনবলে শাসক ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ভয় পাইয়ে রাখাই শাসকের প্রধান লক্ষ্য।

     

    সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ইমন গিলমোর কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনায় দেশদ্রোহিতা আইন, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, দেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থা, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এবং জম্মু ও কাশ্মীরের সাম্প্রতিক বিষয়ের কথা উত্থাপন করেন। গিলমোর জানান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রধান, অরুণ কুমার মিশ্রের সঙ্গে আলোচনাতেও এই বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হয়েছে৷ গিলমোর এবং ভারতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত ইউগো আসতুতোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী, মুখতার আব্বাস নকভির আলোচনাতেও বিষয়গুলির অবতারণা করা হয়। পশ্চিমি দুনিয়া যে ভারতে ক্রমবর্ধমান সংখ্যালঘু "পীড়ন' এবং দেশদ্রোহিতামূলক আইনের "অপব্যবহার' নিয়ে চিন্তিত, তার আভাস পাওয়া যায় তাদের এই পদক্ষেপে।

     

    আরও পড়ুন: অপব্যবহারই সিডিশন আইনের স্বাভাবিক ব্যবহার

     

    অ্যাটর্নি জেনারেল মূলত অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে এই আইনের অপব্যবহার নিয়ে সরব হলেও, তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে এই আইনের অপব্যবহাহের বিষয়টি উহ্য রেখেছেন। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরের বাড়ির সামনে হনুমান চাল্লিশা পাঠ করার ঘোষণা করে সংবাদ শিরোনামে আসা নির্দল সাংসদ নবনীত রানা কৌর এবং তাঁর স্বামী রবি রানার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা আইনে মামলা রুজু করে মহারাষ্ট্র সরকার। সেই ঘটনার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বেণুগোপাল আইনের অপব্যবহারের দিকটি তুলে ধরতে চান। এই আইন প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল কেকে বেণুগোপালের মত হল, দেশদ্রোহিতা আইনের অপব্যবহার রোধ করতে শীর্ষ আদালত হস্তক্ষেপ করতেই পারে। কিন্তু দেশের নিরাপত্তা স্বার্থেই এই আইন রদ করা উচিত নয়।

     

    সম্প্রতি পেগাসাস মামলার রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রকে তীব্র ভর্ৎসনা করে বলেছিল, "জাতীয় নিরাপত্তার নামে ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার ছাড়পত্র পেয়ে যেতে পারে না।' এই মামলায় কেন্দ্রের তদন্ত কমিটির ভরসায় না থেকে শীর্ষ আদালত নিজেরাই একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো কেন্দ্রীয় সরকার সিডিশন আইনের ভবিষ্যৎ সুপ্রিম কোর্টের হাতে ছাড়তে চাইছে না। উলটে এই নিয়ে 'নির্দিষ্ট ফোরাম'-এ আলোচনা হচ্ছে বলে কোর্টকে নিরস্ত করতে চাইছে।

     

    কিছুদিন আগের দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীদের সকাশে "লক্ষণরেখা'র কথা স্মরণ করিয়েছিলেন বিচারপতি রমণা। তিনি উষ্মা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, শাসনবিভাগের ঔদ্ধত্য ও উপেক্ষার ফলে আইনের অপব্যবহার হচ্ছে, সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার চাইতে শাসনবিভাগের দ্বারস্থ হচ্ছেন। সাম্প্রতিক অতীতে ভারতীয় আইনের 124(A) ধারায় বিধৃত দেশদ্রোহিতা বা সিডিশন আইনের অপব্যবহার নিয়েও সরব হতে দেখা গেছে বিভিন্ন ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল, এমনকি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃত মানবাধিকার সংগঠনগুলিকেও। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি বারবার অভিযোগ করেছে যে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে শাসকদল দেশদ্রোহিতা আইনকে ব্যবহার করে থাকে। আবার শাসক বিরোধী আসনে বসে একই অভিযোগ এনেছে। তবু মান্ধাতা আমলের এই আইনকে রদ করার কথা কোনও রাজনৈতিক দলই এখনও ভেবে উঠতে পারেনি। নাগরিক অধিকারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুললেও, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার এই আইন বাতিলে আদৌ আগ্রহী নাকি, তারা এই বিষয়ে সময় কিনতে চাইছে, তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই।

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    বেঙ্গল প্যাক্টে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শাসনক্ষমতা দেওয়ার কথা বললেন চিত্তরঞ্জন।

    বাঙালিকে রবীন্দ্র-কবিতা না শুনিয়ে, প্রধানমন্ত্রী ‘খেলা’র মন্ত্র শেখালে জাতির উপকার হতে পারে!

    করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে লড়তে নেমে আসলে দু'টো মহামারীর বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হচ্ছে।

    শাক্ত সুভাষ আর বৈষ্ণব গান্ধীর দ্বন্দ্বে কি দম নিতে পারেন ব্রিটিশ-বন্ধু সাভারকর?

    কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এই দেশ, আবারও না হয় পরীক্ষা দেবে।

    রাজনৈতিক দলকে দানের নামে আর্থিক অনাচার, অস্বচ্ছতার লজ্জাজনক কাহিনি।

    জীর্ণ সিডিশন যাক ভেসে যাক!-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested