পাড়ার ত্রিকালদর্শী অনুপ জ্যাঠা সেদিন ব্যাজার মুখে বলল, ‘বাঙালির খেলার মাঠটা কেমন ছোট হয়ে যাচ্ছে, বুঝলি।' তাকে প্রবোধ দিয়ে আমি বললাম, কেন গো, এই যে এত লোকজন ‘খেলা হবে’, ‘খেলা হবে’ করে পাড়া মাত করছে, তারা সবাই মাঠে নামলে তো মাঠের আয়তন এমনিই বেড়ে যাবে। জ্যাঠা গম্ভীরমুখে বলল, ‘নারে, তা হওয়ার নয়, পরে টের পাবি আমি কী বলতে চাইছি।'
তো জ্যাঠা কী টের পাওয়ার কথা বলতে চেয়েছিলেন জানা হয়নি। তবে বাঙালি যে বড় মাঠের খেলুড়ে নয়, তা দিব্যি বোঝা গেছে। আরে বাবা খেলতে গেলে কবজির জোর লাগে, পাবজির নয়। বাঙালির গর্বের বলতে ছিল দু’ দু’টো ফুটবল দল। তাদের স্পনসর জোগাড় করতে গিয়ে ক্লাবকর্তাদের নাকের জলে চোখের জলে অবস্থা হয়েছে। ওইদিকে দেখুন, গুজরাটের মোতেরা স্টেডিয়ামের আস্ত দু’টো দিক কিনে নিল দেশের সেরা দুই ধনকুবের, মিস্টার আম্বানি আর আদানি। লকডাউনে বাঙালি কাজ হারিয়েছে, মফঃস্বলের ট্রেন সন্ধের দিকে ফাঁকা যায়, আর ওই দু'জন মানুষ গত একবছরে 50 শতাংশেরও বেশি সম্পত্তি বাড়ান। শুধু খেলা হবে বললেই কি খেলা যায়, বাঙালি?
বাংলার নেতানেত্রীদের ভাবনাচিন্তাও কুয়োর ব্যাঙদের মতো। কেউ প্রেসকে ডেকে নর্দমা উদ্বোধন করান, তো কেউ প্রাণ ভরে শ্বাস নেওয়াতেও ‘অনুপ্রেরণা’ হয়ে থাকতে চান। কিন্তু আত্মবিস্মৃত এই জাতিটা কতদিনই আর এসব মনে রাখে? ওই নর্দমাতেই যখন কলকল করে জল বইবে কিংবা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে কেউ যখন সেখানে মনের সুখে বসবে, কেউ কি সেই নেতা বা নেত্রীর নাম মনে রাখবে? এসব ঠুনকো বুদ্ধি নিয়ে কি আর রাজনীতিক হওয়া যায়? 2008-এর পঞ্চায়েত ভোটে বুদ্ধবাবুর কার্টুন এঁকে তৃণমূল দেওয়াল লিখেছিল, ‘কী আশায় বাঁধি কেমিক্যাল হাব, দুরাশার নয়াচরে।' তার বছর তিনেক পর বুদ্ধবাবু এবং তাঁর দলের খেলাঘর ভেঙে যায়। অধুনা তৃণমূল খেলা হবে বলছে বটে, তবে সেই দলের বহু প্লেয়ারই বিপক্ষ দলে গিয়ে ভিড়ছে। বোঝাই যাচ্ছে বাঙালি বড় মাঠের খেলায় খুব একটা দর নয়। আর দর হলেও বাঙালির খেলায় কনসিসটেনসি কম। গাভাসকর হয়ে থিতু হওয়ার আগেই উটকো বল খুঁচিয়ে ক্লিন বোল্ড। আরে বাবা ঠিকঠাক খেলার জন্য চাই উচ্চমার্গের চিন্তা, ভরপুর কর্মশক্তি আর অন্তর ও বহিরঙ্গে বৈরাগ্যের ভাব!
এতশত গুণের আধারে আধারিত দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কর্মজীবন। তাঁর ঔদার্য আছে, তাই তিনি ছোট মাঠে খেলেন না। তিনি বড় মাঠে খেলার মানুষ। নিন্দুকেরা যদিও বলে উনি যে মাঠে খেলেন, পরে সেই মাঠটিকেও বেচে দেন বন্ধু পুঁজিপতিদের কাছে। সে অন্য বিষয়। তবে, আস্ত খেলার মাঠকেই নিজের নামে অলংকৃত করার মতো কলজের জোর তো আর সবার থাকে না। তার জন্য সিংহহৃদয় হতে হয়। যা আছে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর। তিনি জানেন, দেওয়ালের চুনকাম খসলে কে, কবে, কোথায় ‘অনুপ্রাণিত’ হয়েছিল, তা ভুলে যাবে। কিন্তু, ক্রিকেট স্টেডিয়ামে খেলা চলাকালীন ধারাভাষ্যকাররা যতবার স্টেডিয়ামটির নাম উল্লেখ করবেন, ততবার তাঁর নামটিও উচ্চারিত হবে। ব্যাপারটা বোঝার পর অনুপ জ্যাঠার কথাটা মরমে প্রবেশ করল। সত্যিই, বাঙালি কত ছোট মাঠে খেলে নিজেকে বড় খেলোয়াড় ভাবে, কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মতো বড় মাঠে খেলতে পারেন কতজন?
তবে, অনেকেই আবার এর মধ্যে ইতিহাসের খোঁচা দিচ্ছেন। বলছেন মোতেরার যে ক্রিকেট স্টেডিয়ামটির নাম বদলে প্রধানমন্ত্রীর নামে রাখা হল, সেটি আগে বল্লভভাই প্যাটেলের নামাঙ্কিত ছিল। এই সেই বল্লভভাই প্যাটেল, যাকে সময়ে অসময়ে স্মরণ করে গুজরাটি অস্মিতায় জলহাওয়া লাগিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। নর্মদার জলে কয়েকশো গ্রামকে ডুবিয়েও, বানিয়েছেন সর্দারের সুউচ্চ পূর্ণাবয়ব মূর্তি, ‘স্ট্যাচু অফ ইউনিটি’। প্যাটেলকে কংগ্রেসের কব্জা থেকে নিজেদের অনুকূলে আনবেন বলে কি কম ব্যাটেল করেছেন প্রধানমন্ত্রী? নেহরুর পরিবর্তে যে প্যাটেল প্রধানমন্ত্রী হলে দেশটাই বদলে যেত বলে সংঘের প্রচারযন্ত্র প্রচার চালায়, সেই প্যাটেলের কাছ থেকেই কেড়ে নেওয়া হল আস্ত একটা ক্রিকেট স্টেডিয়াম।
প্যাটেল হ্যান করেছেন, ত্যান করেছেন বলে প্রধানমন্ত্রী যতই ফিরিস্তি দিন, প্যাটেলের একটা ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কাজের কথা তিনি কখনও উল্লেখ করেন না। বলা ভাল উল্লেখ করতে লজ্জা পান। তা হল স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে দেশের জাতীয় পতাকাকে স্বীকৃতি দিতে না চাওয়া রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে নিষিদ্ধ করেছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাটেল। আদ্যোপান্ত জাতীয়তাবাদী প্যাটেল দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনও আপস চাননি। নেহরুর মতো ঔদার্যও তাঁর ছিল না। সেই প্যাটেলকে সরিয়ে নিজের নাম ঢোকানোয় তবে কি মধুর প্রতিশোধ নিলেন সংঘের নয়া পোস্টারবয় মোদী? নিন্দুকেরা বলছেন এটা তো পোয়েটিক জাস্টিস। উনি সবরমতী আশ্রমে গান্ধীর মতো চরকা ঘুরিয়ে নিজেই গান্ধী হতে চেয়েছেন, এবার আর এক গুজরাটি, গান্ধী-শিষ্য প্যাটেলকেও যে ঘাড়ধাক্কা দেবেন, তাতে এত অবাক হওয়ার কী আছে!
মোদ্দা কথা কিন্তু ওই। বাঙালি যতই খেলা হবে বলে ডাংগুলি খেলে বেড়াক, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু জানেন বড় মাঠে কখন কীভাবে খেলতে হয়। ওই দেখুন টিভিতে দেখা যাচ্ছে ভারতের বোলাররা নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামের আদানি প্রান্ত থেকে বল করছে ইংল্যান্ডকে। উইকেটকিপার রিলায়েন্স প্রান্তের দিকে পিছন করে কিপিং করছেন। আমরা মাথা চুলকোচ্ছি। এত বড় খেলাঘরের গোলকধাঁধায় পথ খুঁজছি...
দায়িত্বশীল নাগরিককে 74 বছর বয়সী স্বাধীন রাষ্ট্রের উপহার একটা কেক আর চকোলেট
কৃষ্ণের মোহনবাঁশিতেই যখন হিরণ্যকশিপুরা পরাভূত, তখন বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতারে আসার কীই বা প্রয়োজন?
ঈশান কোণে মেঘ থাকলেও বিসমিল্লার সুরে, ফৈয়জের কবিতায় এই দেশ বেঁচে থাকবে।
তামাদি হয়ে যাওয়া দেড়শো বছরের দেশদ্রোহিতা আইনকে কি এই দেশে নিষিদ্ধ করা হবে?
মানুষের মনোলোকে আড়ি পাতা ফেসবুকের অন্তর্লোকে আলো ফেলবে এই বই।
আজকের দিল্লিকে দেখলে গালিব কী লিখতেন জানা নেই। কিন্তু সমকালীন ঘটনার অভিঘাত যদি কবিমানসকে বিষণ্ণ করে