×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • কেয়া পাতার নৌকো থেকে লজ্জা হয়ে রক্তমাংসের দীপান্বিতা

    শুভস্মিতা কাঞ্জী | 27-10-2021

    প্রতীকী ছবি

    1947 থেকে 2021, মাঝখানে 74টা বছর। পদ্মা দিয়ে গড়িয়ে গেছে অনেক জলকিন্তু সুযোগ পেলেই এক শ্রেণীর মানুষের সংখ্যালঘু (Minorities) নিপীড়নের পরম্পরা বিন্দুমাত্র বদলায়নিআজকের বাংলাদেশের (Bangladesh) কিছু ঘটনার প্রায় হুবহু প্রতিরূপ ধরা রয়েছে উপমহাদেশের অতীতের সাহিত্যে। শুধু চরিত্রদের নাম বদলেছে, ঘটনা বদলেছে, কিন্তু অত্যাচারের চিত্রটা একই থেকে গেছে বরাবর। ভারতের অথবা বাংলাদেশের ঘটনার মধ্যে কোনটা বেশি লজ্জা ও দুঃখজনক, কোনটা ক্রিয়া আর কোনটা প্রতিক্রিয়া আর কোনটাই বা তস্য প্রতিক্রিয়া তাই নিয়ে অনন্ত তর্ক চলতে পারে। কিন্ত দুই ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির ধ্বংসের দায়ভাগে সকলেই সমান অংশিদার।

     

    প্রফুল্ল রায়ের উপন্যাস কেয়া পাতার নৌকোয় (Keya Patar Nouko) উঠে এসেছে 1947 -এর দেশভাগের যন্ত্রণা। এক সময় যে হিন্দু মুসলিম পরিবার দুটো পাশাপাশি থাকত, নিজের বাগানের, ক্ষেতের এটা ওটা একে অন্যকে দিত, সুখে দুঃখে পাশে থাকত, হঠাৎই তাদের বহু বছরের সম্পর্কের সমীকরণ বদলে যেতে থাকলইন্ডিয়া এক লহমায় হয়ে গেল হিন্দুদের থাকার জায়গা, আর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিমদের। তাই যে যত বড়লোক হোক, সম্মানীয়, সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ হোক, যতই আগে মান সম্মান পাক, রাতারাতি পুরো অবস্থা বদলে গেল। একটাই পরিচয় তখন, ‘হিন্দু না মুসলিম?’ হিন্দু মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হতে থাকে। একের পর এক পুড়ে যেতে থাকে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি। পরিচিত মুসলিমদের হাতে প্রাণ যেতে থাকে হিন্দু পুরুষদের। যে যেমন ভাবে পেরেছিল পালাচ্ছিল। শুধু ভিটেমাটি আঁকড়ে থেকে গিয়েছিল গল্পের নায়ক বিনু, তার দাদু হেমনাথ ও তার পরিবারকিন্তু সেই ধ্বংসলীলা বিনুর পরিবারেও থাবা বসায়। লুঠ হয়ে যায় তার প্রিয় নারী ঝিনুক। ধর্ষিত, ক্লান্ত, বিধ্বস্থ ঝিনুক যখন কোনওক্রমে প্রাণটুকু নিয়ে বাড়ি ফেরে, হতবুদ্ধি বিনু বাধ্য হয় তাকে নিয়ে ইন্ডিয়া পালিয়ে আসতে। হ্যাঁ, নিজের দেশ, নিজের মাটি, নিজের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসতে। কারণ সে পূর্ব পাকিস্তানকে তার নিজের দেশ ভাবলেও, দেশ তো তাকে নিজের বলে মনে করে না। মনে করে স্রেফ এক সংখ্যালঘু, যাকে রাষ্ট্র দয়া করে আশ্রয় দিয়েছে মাত্র। তাই রাষ্ট্রের, এবং সংখ্যাগুরুদের পূর্ণ অধিকার আছে তাকে হেনস্থা করার, মারার, লুঠ করার। কেয়া পাতার নৌকো উপন্যাসে বিনু ঝিনুকের সঙ্গে পাঠকরাও যেন সেই দেশের মাটি ছেড়ে আসার যন্ত্রণা, কষ্ট, দেশ থেকে পালানোরপ্রতিটা পদক্ষেপ অনুভব করতে পারে। 

     

    আরও পড়ুন: সরকারি পাঠ্য বইয়ে আমরা ওরা

     

    কাট টু। তসলিমা নাসরিনের (Taslima Nasrin) লজ্জা উপন্যাস। ঘটনার সময়কাল 1992ভারতে চলল বাবরি মসজিদ ধ্বংসলীলা। উত্তাপ পৌঁছল বাংলাদেশেও। বেছে বেছে মারা হতে লাগল হিন্দু পুরুষদের। ধর্ষিত হতে থাকল হিন্দু নারীরা। বাঁচার তখন দুটি মাত্র পথ; হয় ইন্ডিয়া পালিয়ে যাও, নইলে ধর্মান্তরিত হয়ে কিংবা কোনও মুসলিমকে বিয়ে করে থেকে যাও নিজের দেশে (!) নিজের দেশ! কোনটা নিজের দেশ? গল্পের নায়ক সুরঞ্জনের বাবা সুধাময় একসময় যে দেশকে আপন বলে ভেবেছিলেন, পরিবারের বাকি সবাই দেশ ছাড়লেও তিনি যে দেশ ছাড়েননি, সেই দেশ? যে দেশের মাটিকে নিজের বলে মনে করেছিলেন সেই দেশ? কিন্তু কী দিল সেই দেশ, সেই দেশের মাটি তাকে? শুধুই অপমান, উপেক্ষা। এমনকি শেষ পর্যন্ত তার এক মাত্র কন্যা মায়াকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয় হিন্দু বলে। কেয়া পাতার নৌকোয় ঝিনুক ফিরতে পারলেও, লজ্জায় মায়ার আর বাড়ি ফেরা হয় না। সুরঞ্জন পায় না কোনও ভাল চাকরি। তার বাবাও পেয়েছিল কি? পায়নি। উল্টে এই বিপদের সময়ে একদা ঘনিষ্ঠ মুসলিম বন্ধুরা দয়া দেখিয়েছে। কারণ তারা সংখ্যাগুরু যে। খবর পেয়েছে হিন্দুরা কী ভাবে গৃহবন্দি হয়ে আছে। কীভাবে একের পর এক হিন্দুদের বসতি, মন্দির লুঠ হয়েছে, ধ্বংস করা হয়েছে, পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সুধাময় অংশ নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননিকারণ তিনি হিন্দু, আর সেই যুদ্ধে সামিল হতে গেলে মুসলিম হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ভাষা এক হলেই কি আর ধর্ম এক হয়? তারপর? তারপর আর কী কেউ কেউ থেকে গেছেন শিকড়ের টানে, আবার অপমানের, সমস্যার শিকার হয়েছেন। হবেন। লেখিকা তাই যথার্থই বলেছেন, ‘দেশ ধুয়ে কী জল খাব বাবা? এই বাড়ি এই শেকড় কী দিচ্ছে আমাদের? আমরা যতই নাস্তিক হই, উদারপন্থী হই এদের কাছে আমরা হিন্দু...। শেকড় দিয়ে কী করবে? শেকড় দিয়ে যদি কিছু হতোই তবে ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকতে হবে কেন?... এরা কথায় কথায় আমাদের বাড়িঘরে হামলা করবার, আমাদের জবাই করবার অভ্যাস রপ্ত করে ফেলেছে।' দাঙ্গা আসলে একে বলা চলে না। দাঙ্গা মানে তো দুপক্ষের মধ্যে মারপিট, এখানে তো স্রেফ এক পক্ষই আরেক পক্ষকে মারছে, মারছে, মারছে। তাই তো শেষ অবধি সুধাময় ছেলেকে বলেন ইন্ডিয়া চলে যাই চল। 

     

    কাট থ্রি। 2021না, এবার আর কোনও উপন্যাস নয়। মানে আপাতত লেখা হয়নি। হয়তো ভবিষ্যতে হবে। দুর্গাপুজোর মধ্যে কেউ এসে হনুমানের হাতে জেনে বুঝে কোরান ধরিয়ে দিয়ে গেল। ব্যাস আবার জ্বলে উঠল দেশ। পুড়ল একের পর এক সংখ্যালঘুদের বাড়ি। মৃত্যু হল শতাধিকের। দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসার পোস্ট চোখে পড়ল বহু। বন্ধু দীপান্বিতা ওদেশ থেকে লিখলেন বাড়ি ঘরে ডাকাতি হয়ে গেছে, পুলিশ পদক্ষেপ নিচ্ছে না।'

     

    আরও পড়ুন:ভারতের বারমুডা ট্রায়াঙ্গল

     

    কী অদ্ভুত না? বাস্তব গল্প সব বারবার মিলেমিশে যাচ্ছেঝিনুক, মায়া, দীপান্বিতা কারও মধ্যে তফাৎ পেলেন? কিংবা বিনু সুরঞ্জন? না। কোনও তফাৎ নেই। ঘটনার সময় আর কারণগুলো খালি পাল্টে যায়। এক থেকে যায় সংখ্যালঘুদের উপরে অত্যাচারের ইতিকথা। রাষ্ট্র, ধর্ম সবের ঊর্ধ্বে গিয়েও প্রতিটা জায়গায় সংখ্যালঘুদের উপর সংখ্যাগুরুদের যে অত্যাচার, তার যে ভীষণ ভীষণ মিল। এবং এর পরিবর্তন নেই। তাই তো বারংবার নানান লেখকের হাত ধরে উঠে আসে বাস্তবের এই নিদারুণ করুন চিত্র। গল্পগুলো পড়লে মনে হয় তফাৎ কই? সবই তো এক। সংখ্যালঘুরা যতই সেই দেশকে নিজের ভাবুক, দেশ তো তাদের নিজের ভাবতে পারে না। বারবার দূরে ঠেলে দেয়। তবুও কেউ কেউ আঁকড়ে ধরে থাকে মাটি, কিন্তু বারবার আঘাতে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হতে হতে আর কতদিন সইবে তারা অপমান? আর তখনই সংখ্যালঘুদের সংখ্যা আরও কমতে থাকে। যেমন আজ বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র 9শতাংশ, 1971 সালে যা ছিল 20শতাংশ। এর শেষ কোথায়? বদলই বা কী করে সম্ভব?

     


    শুভস্মিতা কাঞ্জী - এর অন্যান্য লেখা


    পরীক্ষার ধরন পড়ুয়াদের ক্ষতি করছে কিনা, করলেও কতটা, তা বোঝা কেবল সময়ের অপেক্ষা।

    নিজেদের প্রাণ দিয়ে মানুষের ভুলের খেসারত দিচ্ছে উত্তরবঙ্গের বন্যপ্রাণীরা।

    এক গ্রাম্য মধ্যবিত্ত ছেলের অধরা স্বপ্ন, বন্ধুত্ব এবং জীবনের গল্প বলল বাদল দাস।

    সারদা থেকে নারদা হয়ে ভ্যাকসিন, ‘কেলো’ যেন আর তৃণমূলের পিছু ছাড়ছে না!

    ইচ্ছেপূরণের গল্প দেখাল ‘ঘরেলু’ শর্ট ফিল্মটি। 

    অ্যাক্রোপলিস মলে চলছে কলকাতা স্ট্রিট ফুড ফেস্টিভ্যাল।

    কেয়া পাতার নৌকো থেকে লজ্জা হয়ে রক্তমাংসের দীপান্বিতা-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested