""সে কহিল, ‘এত রক্ত কেন!’ এমন প্রকার কাতর স্বরে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করিল, ‘এত রক্ত কেন’, যে রাজারও হৃদয়ের মধ্যে ক্রমাগত এই প্রশ্ন উঠতে লাগিত, ‘এত রক্ত কেন?’ তিনি সহসা শিহরিয়া উঠিলেন।''
রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের এক শিশু হাসি এভাবেই বিস্মিত হয়েছিল মন্দিরে বলির রক্তধারা দেখে! কালের সীমানা ছাড়িয়ে ’এত রক্ত কেন’ উক্তিটি যেন আজকের বাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সমান প্রাসঙ্গিক।
সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষাপট রামপুরহাটের বগটুই গ্রাম। অখ্যাত এই গ্রামই এখন বাংলার রাজনীতির হেডলাইনে। বীরভূম তথা বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের রাজনীতি ও বেআইনি অর্থনীতির ভরকেন্দ্র এই বালি, কয়লা ও পাথরের চোরাচালান। বগটুই গ্রামে গত সোমবার খুন হন তৃণমূল নেতা ভাদু শেখ। আর তার বদলা নিতেই দরজা বন্ধ করে আগুন লাগানোর বীভৎস পরিকল্পনা। এসবের মূলে ’গ্যাং ওয়ার’। এক ওয়ারলর্ডের সাথে অন্য গোষ্ঠীর দর কষাকষি, লড়াই আর হত্যার রাজনীতি।
রাজনৈতিক পালাবদলেও থামে না রক্তের স্রোত। তবে কি বাংলার সমাজে সম্প্রীতি, মনুষ্যত্ববোধের আড়ালে চোরাস্রোতের মতোই থেকে গেছে হিংসা বিদ্বিষ্ট মানসিকতা? মানব সভ্যতার ইতিহাসেই অবশ্য শোষণ, অধিগ্রহণ, আগ্রাসন, হত্যার নজির পাতা ওল্টালেই পাওয়া যায়। বাংলার ইতিহাসও তার ব্যতিক্রম নয়। আবার, উল্লেখযোগ্য ভাবে সম্প্রীতির বার্তাবাহক হয়ে বাংলায় যুগে যুগে এসেছেন চৈতন্যদেব, লালন সাঁই, শাহ আবদুল করিম থেকে রবীন্দ্রনাথ। ভারতবর্ষের ধর্মীয় ইতিহাসের দু’টি প্রগতিশীল ধারা ভক্তিবাদ ও সুফিবাদ উভয়ের অনুশীলন হয়েছে বাংলার মাটিতে। বাউল দর্শন প্রশ্ন করেছে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের উদ্দেশ্যে। আবার, ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রভাবিত সমাজে সমান্তরালে চলেছে জীবন্ত নারীদেহ চিতায় পোড়ানোর অনুশীলনও। একই মুদ্রার দুই পিঠে ভিন্ন চেতনা এবং তার অনুশীলন। 1905 সালের বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য যে বাংলাতে মানুষ অরন্ধন পালন করেছিলেন, সেই বাংলাতেই 1940 পরবর্তী সময়ে দেখা গেল সাম্প্রদায়িক হানাহানি, দাঙ্গা বিধ্বস্ত রক্তাক্ত জনপদ!
ভারতবর্ষে অন্য সমাজের সঙ্গে বাংলার একটি তফাৎ আছে, যা আজকের বাস্তবতাতেও প্রসঙ্গিক। ব্রাহ্মণ্যবাদের আগ্রাসন থেকে আংশিক মুক্ত থাকার ফলে, কিংবা ব্রিটিশদের প্রগতিশীল চেতনায় জাগরিত হয়ে, ভক্তি-সুফিবাদের প্রভাবে বাঙালিদের চর্চা এবং সংঘাতের চরিত্র থেকেছে রাজনৈতিক। দেশের অন্যত্র জাতপাতের দ্বন্দ্ব, সামাজিক উচ্চ-নীচের দ্বন্দ্ব বিকশিত হলেও বাংলার সমাজ জীবনের কেন্দ্রে থেকেছে রাজনীতি এবং তা নিয়ে সংঘাত।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পেছনে ফেলে উত্থান ঘটে বামপন্থী আন্দোলনের। এই সময় উদ্বাস্তু জনগণের অধিকারের দাবিতে আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন বামপন্থীদের ভিত শক্ত করে। এই পর্যাপ্ত কংগ্রেস ও বামপন্থীদের মধ্যে বিবাদ চরমে পৌঁছয়। কমিউনিস্ট পার্টিও কুড়ি বছরের মধ্যে নানান প্রশ্নে তিন ভাগে ভেঙে যায়। রাজনৈতিক সংঘাত ও হিংসার ঘটনাও বাড়তে থাকে। বাংলা জুড়ে জমিদার জোতদারের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন সংঘটিত হতে শুরু করলে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার সংকটে পড়ে। 1969 সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পুলিশ হাতিঘিষা জোতে কৃষকদের জমায়েতে গুলি চালিয়ে হত্যা করে 11 জন গ্রামবাসীকে, যাদের অধিকাংশই ছিলেন মহিলা৷ নকশালবাড়ি আন্দোলনের পর্যায়ে বাংলা কার্যত তিনটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সিপিআই(এম), নকশালপন্থী দল ও গোষ্ঠীসমূহ আর কংগ্রেস, সাথে তার পুলিশ –গুণ্ডাবাহিনী। ছয় ও সাতের দশকের বাংলায় রাজনৈতিক সংঘর্ষ ছিল নিত্যজীবনের অংশ। বরানগর কাশীপুরের গণহত্যা, বেলেঘাটা থেকে বারাসাতের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ভোলবার নয়। বিপ্লবী সম্ভাবনার দ্যুতি নিয়ে এলেও বাস্তবিক দিশাহীনতা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মোকাবিলা করতে না পেরে মূলধারার রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে নকশালপন্থীরা।
আরও পড়ুন: নেই রাজ্যের বাসিন্দাদের বিরোধের নিষ্পত্তি হিংসাতেই হতে বাধ্য
বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কাটবে, এমন আশা করেছিলেন অনেকেই। কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্র ও দলীয় সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্যে একাধিক গণহত্যার ঘটনা ঘটে সিপিএম-এর নেতৃত্বে বামফ্রন্টের আমলে। 1979 সালে মরিচঝাঁপিতে অসহায় উদ্বাস্তুদের কোণঠাসা করা দিয়ে যার সূত্রপাত। 1982-এর এপ্রিলে বিজন সেতু থেকে একবিংশ শতকের সূচপুর, ছোট আঙারিয়ার রাজনৈতিক হিংসা তারই নিদর্শন। 2007 সাল থেকে নন্দীগ্রামে লাগাতার সন্ত্রাস, গণহত্যা চালিয়ে জনরোষে গদি টলে যাওয়ার পূর্ব মূহুর্তেও 2011 সালের নেতাই সাক্ষী থেকেছে বাম জমানার রাজনৈতিক হিংসার। পালাবদলের পরেও বাংলায় মার-পাল্টা মারে রাজনীতি বজায় থেকেছে বহাল তবিয়তেই। পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধীদের কোণঠাসা করতে হিংসার আশ্রয় নিয়েছে শাসকদল। আরাবুলের বাহিনীর হাতে ভাঙড়ে তিনজন গ্রামবাসীর মৃত্যু হয়েছে জমি আন্দোলনের সময়কালে। কিন্তু মমতার শাসনকালে এই প্রথম গণহত্যার সাক্ষী থাকল বাংলা। বগটুই গ্রামে জনা দশেক মানুষের মৃত্যু আবারও প্রমাণ করল বাংলায় হিংসার ধারাবাহিকতাকেই। এবার আর বিরোধী পার্টি নয়, তৃণমূলের অভ্যন্তরেই সংঘর্ষ!
সম্প্রীতির যে মাটিতে কিছু দিন আগেই বিজেপিকে ‘না’ বলেছিল বাংলার মানুষ, সেই মাটিতেই সন্ত্রাসের বলি দশটা জীবন্ত প্রাণ। একাধারে ভক্তি এবং শক্তির উপাসক এই গাঙ্গেয় সমতলের মানুষরা কি তবে সহজাত ভাবেই দ্বৈত চরিত্রের ধারক বাহক? ইতিহাসের যাত্রাপথে কিন্তু ধর্মের আশ্রয় নিয়েও বাঙালি ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শক্তি সঞ্চয় করতে 1920-30 সালেও অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীরা কালী'র পূজা করতেন, বেদে হাত রেখে যুদ্ধে যেতেন। কিন্তু আজকের বাঙালি যুদ্ধ করছে নিজের পড়শি কিংবা সহোদরের সঙ্গেই। কয়লা কিংবা বালির ভাগাভাগি নিয়ে সংঘাত, এলাকা কার হাতে থাকবে সেই সংঘাতেই মৃত্যু হল এতগুলো তাজা প্রাণের। ‘এত রক্ত কেন?’ রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের ছোট্ট মেয়েটি যেন আজও এই প্রশ্নই করে চলেছে আমাদের। বাংলার গ্রাম-শহর, পার্টি, নাগরিক সমাজ সক্কলের প্রতি প্রশ্ন রইল, এই রক্ত ধারার শেষ কোথায়?
দারাং জেলায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হত্যা ও উচ্ছেদের প্রেক্ষাপটে রয়েছে একাধারে জমির অধিকারের প্রশ্ন
ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রছাত্রীদের বোঝানো হচ্ছে গীতার শ্লোক, মোদীজির মহৎ কীর্তি।
এপ্রিলে দেশের বেকারত্বের হার ছুঁলো 7.83 শতাংশ, কর্মক্ষেত্রে সংকট ক্রমশ উর্ধ্বমুখী
শাসকবিরোধী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বদলি প্রসঙ্গে বেফাঁস মন্তব্য করলেন নির্মল মাজি
সাম্প্রদায়িক হিংসার বাতাবরণে শ্রীরামপুরে অনুষ্ঠিত হল সম্প্রীতির লক্ষ্যে পদযাত্রা
মরিচঝাঁপির দলিত উদ্বাস্তু গণহত্যার চাপা পড়া ইতিহাস আজও প্রাসঙ্গিক