×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • "আমি মুসলমানদের ভালবাসি' - স্বামী বিবেকানন্দ

    রিম্পা বিশ্বাস | 15-01-2022

    নিজস্ব ছবি

    হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আইকন হিসেবে স্বামী বিবেকানন্দকে তুলে ধরার চেষ্টার সঙ্গে তাঁর কর্ম ও ভাবনার মিল নেই। বরং তার সঙ্গে মুসলিমদের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণ করে যে তিনি নিছক একজন হিন্দু সন্ন্যাসী ছিলেন না। তাঁর ভাবনার একটিমাত্র খণ্ডিত অংশ রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করছে বর্তমান শাসকবর্গ। তবে এই ধারাও ভারতের ইতিহাসে নতুন নয়! মৌর্য্য যুগ থেকে কলিকালের মোদী যুগ এক‌ই সূত্রে বাঁধা।

     

    বুদ্ধ ও বিবেকানন্দের ব্যবহার রাজকার্যে ধারাবাহিক ভাবে হয়ে আসছে। "western science must be coupled with eastern Vedanta " স্বামীজীর এই জাতীয় কয়েকটি উক্তিকে ব্যবহার করে প্রাচীন ভারতবর্ষের বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, পুরানগুলিকে পূণরায় শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা করা হচ্ছে। সে হোক, সমাজে কত কিছুই তো হচ্ছে। তবে বিশ্বমানবতার প্রতিভূ হিসেবে যিনি পরিচিত, তাঁর কয়েকটি উক্তি ও মতাদর্শের খন্ডিত একটি দিক জনসাধারণের কাছে বার বার তুলে ধরে আদপে মানবসমাজের ক্ষতিই করা হচ্ছে। 

     

     

    "আমাদের এমন একটি জায়গায় পৌঁছতে হবে যেখানে গীতা নেই, বাইবেল নেই, কোরান নেই। আছে শুধু ভালবাসা, যদি আমরা আমাদের ঐ স্তরে উন্নীত করতে পারি।" এই উক্তিও স্বামীজীর তবে এই জাতীয় কোনও কিছুই এখনকার দেশ-নেতাদের দ্বারা ব্যবহৃত হয় না। এখনকার যুবসমাজের অর্থাৎ আমাদের দেশের 70 শতাংশ মানুষ যারা আঠারো থেকে চল্লিশ বয়সের মধ্যে রয়েছেন, তাদের কাছে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি মহান আদর্শ ও জীবনবোধ। সেই আদর্শ ও জীবনের অন্যতম প্রতিমূর্তি হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। জাতিভেদের ঊর্ধ্বে গিয়ে যখন তিনি দেশবাসীকে জাগ্রত হতে বলেছিলেন তা কী শুধুমাত্র কোনও এক বিশেষ ধর্মের মানুষের জন্য? তৎকালীন পরাধীন ভারতবর্ষের প্রধান সমস্যা সম্পর্কে রামকৃষ্ণ যে সচেতনতার কথা বলেছিলেন বিবেকানন্দ সেটি বাস্তবায়নের সর্বাধিক চেষ্টা করেছিলেন। রামকৃষ্ণ বলতেন "সর্বাঙ্গে রক্তসঞ্চার না হলে কোনও দেশ কোনও কালে কোথাও উঠেছে দেখেছিস? একটা অঙ্গ পড়ে গেলে অন্য অঙ্গ সবল থাকলেও ওই দেহ নিয়ে কোনও বড় কাজ হবে না"। দেশের সকল ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে পৌঁছোনোর বিবেকানন্দের ইচ্ছা যে রামকৃষ্ণ থেকে এসেছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। 

     

    আরও পড়ুন:গেরুয়া ভারত গড়তে হাতিয়ার বিদ্বেষ ও ঘৃণার প্রচার

     

    বিবেকানন্দের সঙ্গে ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের যোগ কতটা ছিল বা ইসলাম প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য কী? সাধারণত বিবেকানন্দ নিয়ে যারা পড়াশোনা করেন তাদের কাছে এসব নতুন করে আলোচনার অবকাশ রাখে না। তবে যেভাবে দিন দিন বিবেকানন্দকে হিন্দু সন্ন্যাসী হিসেবে প্রচার করার প্রচষ্টা করা হচ্ছে তাতে বিবেকানন্দ জনসাধারণের কাছে ধর্মীয় গোঁড়ামির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। বাল্যকাল থেকেই বিবেকানন্দ অর্থাৎ নরেন সমাজের ধর্মীয় জাতিভেদকে ধুলিস্যাৎ করে এসেছে। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত পেশায় আইনজীবী হওয়ায় নরেনের বাড়িতে বহু ধর্মের মানুষের যাতায়াত ছিল। একদিন বিশ্বনাথ দত্ত মক্কেলদের সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে সকলকে নিয়ে সদর দরজা পর্যন্ত অগ্ৰসর হয়েছে সেই সময় বৈঠকখানায় যতগুলি হুকো ছিল নরেন প্রত্যেকটিতে মুখ দিয়ে একবার করে টানলেন, মুসলমানের হুকোটি একটু বেশিক্ষণ ধরেই টানলেন। এমন সময় বিশ্বনাথ দত্ত এসে বিষয়টি জিজ্ঞাসা করলে বালক নরেন বলেন যে 'দেখছি জাত না মানিলে কি হয়'। এরপর পিতা পুত্র দুজনেই উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। 

     

     

    ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা তাঁর ছোট থেকেই। বাড়ির পরিবেশ এর বিশেষ সহায়ক ছিল। দত্ত বাড়িতে সেই সময় পলান্নভোজনের নিয়ম ছিল। 'যুগনায়ক' এ স্বামী গম্ভীরানন্দ লিখেছেন যে "পোশাক-পরিচ্ছদ, পানাহার, আদব-কায়দায় তিনি প্রাচীন হিন্দু-মুসলিম যৌথ পরিবারের রীতিনীতি অনুসরণ করিতেন'। এর কারণ ছিল তাঁর আদর্শ, যা ছিল জাতি,ধর্ম, বর্ণের ঊর্ধ্বে। শিকাগো ধর্ম সম্মেলনের পর থেকে তিনি সমাজে একটি পরিচিত মুখ, এর আগে ও পরে যে কোনও ধর্মের মানুষের থেকে আপ্যায়নে তিনি কখনোই দ্বিধা করেননি। তাঁর মুসলমানদের বাড়িতে যাওয়া, থাকা এবং আহার গ্ৰহণ করায় যখন প্রশ্ন তোলা হত তখন স্বামীজী বলে উঠতেন "আমি তো সন্ন্যাসী! আপনাদের সমস্ত বিধিনিষেধের ঊর্ধ্বে" (যুগনায়ক প্রথম খন্ড)। অর্থাৎ বর্তমানে বিবেকানন্দের গায়ে যে একজন হিন্দু সন্ন্যাসীর তকমা লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে তা তিনি নিজের জীবিতকালেই ঝেড়ে ফেলেছেন। 

     

     

    মুসলমান ও বিবেকানন্দ প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে অবশ্যই আলমোড়ার সেই ফকিরের কথা উল্লেখ করতে হয় যিনি স্বামীজীর প্রাণরক্ষা করেছিলেন। তারপর থেকে স্বামীজী যতবার আলমোড়ায় গিয়েছিন ততবারই সেই ফকিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। পরবর্তীকালে জনসম্মুখে বারবার তিনি বলেছেন "লোকটি বাস্তবিক আমার প্রাণরক্ষা করেছিল। আর কখনও আমি ক্ষুধায় অত কাতর হয়নি।' মুসলমানদের প্রতি স্বামীজীর গভীর ভালবাসা অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য ঠেকতো। স্বয়ং নিবেদিতা পর্যন্ত এ নিয়ে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। উত্তরে ছিল স্বামীজী সহজ সরল স্বীকারোক্তি 'কি জানো, আমি মুসলমানদের ভালবাসি'।

     

     

    ভারতবর্ষে ইসলামের আগমনকে স্বামীজী ভারতীয়দের আধ্যাত্মিক অগ্ৰগতির পথ হিসেবে দেখেছেন। ভূখণ্ডে মুসলিম শাসনকে তিনি দেখেছেন মৌর্য্য ও গুপ্তদের মত শ্রেণী শাসন হিসেবেই। একদিকে তিনি আকবরকে যেমন সব্বোর্চ গুণের প্রতিভূ মনে করতেন অপরদিক শেরশাহের প্রশাসনের গুণগান করতেন। স্বামীজীর কল্পনায় তিনি আকবরের পূর্বজন্ম দেখতেন, এক সাধুর বেশে। মুঘলদের বিরুদ্ধে শিখ, মারাঠাদের বিদ্রোহকেও তিনি দেখতেন কালের বিবর্তন রূপে। ভারতীয় ইতিহাস নিয়ে পরিচিত মহলে তিনি প্রায়শই আলোচনা করতেন। আলোচনায় বারবার তিনি তাঁর ধর্মীয় উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। এর কারণেই বহু সংখ্যক মুসলিম সেই সময় তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। 

     

     

     সমাজের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব নতুন নয়। বিবেকানন্দের জীবনকালেও এই দ্বন্দ্ব ছিল, তা সত্ত্বেও বিবেকানন্দ যথার্থ ভাবে জাতি, ধর্ম, বর্ণের ঊর্ধ্বে ব্যক্তি ও সমষ্টির উত্তরণে বারে বারে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন। এই দিক থেকে দেখতে গেলে বলা যায় উনিশ শতকের প্রথমার্ধে রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে ভারতবর্ষে বিশেষত বাংলায় যে হিন্দু-মুসলিম সংহতির সূচনা হয়েছিল স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন তাঁরই উত্তরসূরি এবং এক্ষেত্রে বিবেকানন্দ প্রথমে একজন সমাজসংস্কারক তারপর একজন সন্ন্যাসী যিনি নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলে ঘোষনা করেছিলেন, যার সঙ্গে আজকের রাজনীতির আইকন বিবেকানন্দের কোনও মিল নেই। 

     


    রিম্পা বিশ্বাস - এর অন্যান্য লেখা


    সভ্যতা কীভাবে মানুষের পাগলামিকে ব্যবহার করেছে ?

    দেশের মহানগরগুলিতে নারী সুরক্ষার জন্য গঠিত নির্ভয়া তহবিলের টাকায় শহরে শুধুমাত্র আলো দেখা যায়।

    হিজাব বা অন্য পোশাক নয়,মৌলবাদী শাসকদের আসল টার্গেট নারীর শিক্ষার অধিকার ও স্বাধীনতা।    

    নিম্ন মানের কৃষি বীজ এবং তার অনিয়ন্ত্রিত বাজার দেশে প্রাকৃতিক চাষের পথে অন্যতম প্রধান অন্তরায়।

    খাদ্যের অতিরিক্ত সংরক্ষণ এবং তার ব্যবহারের কারণে মানুষের পাশাপাশি পৃথিবীও অসুস্থ।

    গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়ার সপরেও বেঁচে ফিরে রফিজা নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখে মেয়েকে ঘিরে। 

    "আমি মুসলমানদের ভালবাসি' - স্বামী বিবেকানন্দ-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested