×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • রাষ্ট্রের চোখেও চোখ রাখা যায়, শেখাল পুরনো বছর

    বিতান ঘোষ | 08-01-2022

    প্রতীকী ছবি।

    কার্যত মহামারী-ধ্বস্ত হয়ে কেটে গিয়েছে আরও একটা বছর। তবু অসীম সময়ের দিনলিপিতে দুঃখ, মৃত্যু থাকলেও বিচ্ছেদ তো নেই। বিচ্ছেদ থাকতে পারে না। আর বিচ্ছেদ নেই বলেই সময় তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলে। আমাদেরও ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াতে হয়। নৈরাশ্যের শেষে নতুন স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। যেমন ইংরেজি নতুন বছর 2022 অনেক প্রত্যাশা নিয়ে তার পথচলা শুরু করেছে। 12টা মাসের পর খেরোর খাতায় লাভ-ক্ষতির হিসাবনিকাশ হবে নিশ্চয়ই, কিন্তু নতুন বছরের শুভারম্ভে নতুন সম্ভাবনার দিকগুলোয় আলো ফেলা যেতেই পারে।

     

     

    গত বছরের শুরুটা হয়েছিল তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে দেশের কৃষকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের হাত ধরে। 2020-তেই এই আন্দোলন দিল্লির রাজপথে নেমে এলেও কৃষকদের লালকেল্লা-মুখী ট্রাক্টর মিছিল এবং তার পাল্টা রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দেশের রাজধানী শহর। কৃষকদের দুর্দমনীয় জেদ, লক্ষ্যের প্রতি স্থিতধী থাকাকে কার্যত কড়া চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করে রাষ্ট্রের বেয়নেট, আইনকানুন, মায় পুলিশ-প্রশাসন। বছরের শেষ লগ্নে অবশ্য আত্মনির্ভর নয়, আত্মম্ভরি রাষ্ট্রের স্বগতোক্তি, ‘ভুল হয়েছিল’। 2021-এর শেষ লগ্ন শেখাল, সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রেরও ভুল হয়, সত্য মিথ্যার ঊর্ধ্বে বিরাজ করা, এক বায়বীয় ও আরোপিত চরিত্রের রাষ্ট্র-পতিও তবে ভুল স্বীকার করেন। আর রাষ্ট্র তার শাসনের কৌলীন্য রক্ষায় দাঁত-নখ বার করলে, পথের নিরস্ত্র, সহিংস আন্দোলন এখনও যুদ্ধটায় জিতে যায়। অধুনা গডসে জিন্দাবাদ ধ্বনিতে সরব দেশে অলক্ষ্যে হেসে ওঠেন গান্ধী। রাষ্ট্রের লাল চোখকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া কৃষক আন্দোলন বলে যায় গান্ধী জিন্দা হ্যায়। এই যে প্রতিস্পর্ধার নান্দীমুখ 2021-এ হল, সেটাই কি নতুন বছরের যাবতীয় রাষ্ট্ররোষে সাধারণের সহায় হবে না?

     

     

    বছরভর ধুকপুক করে চলা বুকে অক্সিজেন পাওয়ার আর্তি, জ্বলন্ত চিতার লেলিহান শিখায় জ্বালা করে ওঠা চোখ। মহামারী, অ্যাসিম্পটোম্যাটিক স্বৈরতন্ত্রের দুরন্ত স্পেলে কেউ কর্মচ্যুত, কেউ জীবনচ্যুত। দিকে দিকে বাঁচার আর্তি, আলুথালু জীবনটাকে পরিপাটি করে নেওয়ার ব্যাকুলতা। রাষ্ট্রের তুখোড় বোলিং-এ সামাজিক ন্যায়, সমানাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা কার্যত ক্লিন বোল্ড।

     

     

    শেষে ক্রিজ আঁকড়ে পড়ে রইলেন দেশের কৃষকরা। তাঁদের পরিমিতিবোধ, অনন্ত স্থৈর্যশক্তি দেশে গণতন্ত্রকে ক্লিন বোল্ড হতে দেয়নি। বিদ্বেষী রাষ্ট্রের সামনে নতজানু না হওয়ার চাবিকাঠি ওই প্রতিস্পর্ধাতেই লুকিয়ে আছে। বছর শেষে রাষ্ট্র ইনিংস, ম্যাচ দুই-ই প্রায় হারাতে চলেছে। শতাব্দীর 22-গজে টিকে আছে প্রতিস্পর্ধা।

     

     

    বঙ্গদেশেই কি কম গোলযোগ হল গেল বছরটায়! কী রোমাঞ্চকর রাজ্য নির্বাচন, ইতিপূর্বে রাজ্যবাসী এমনটা কি দেখেছিল? দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-সহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বাঘা বাঘা সদস্যরা কার্যত রাজ্যে ঘাঁটি গেড়ে কামান দেগেছিলেন রাজ্যের বিদায়ী তৃণমূল সরকারের উপর। সংশয়ী বাঙালি, স্রোতের অনুকূলে বইতে চাওয়া বাঙালির মনেও সংশয়, এ বার কি তবে কপালে হাত ঠেকিয়া দুগগা দুগগা নয়, উল্টে ঊর্ধবাহু করে জয় শ্রীরাম কিংবা জয় বজরংবলী বলতে হবে? ভীরু বাঙালির মনে নানা অশুভ চিন্তার ছাপ যে ছিল না এমনও নয়। যতই বহিরঙ্গে বাঙালি কসমোপলিটান হোক, নিজের খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি নিয়ে যাদের এই দুর্দিনেও এত প্রবল আত্মশ্লাঘা, তারা বুঝি এই অহেতুক হিন্দি ভাষণ, বাঙালিকে সহবৎ শেখানোর চেষ্টায় ঘাবড়ে গেল। প্রধানমন্ত্রী তাঁর অননুকরণীয় সানুনাসিক স্বরে মুখ্যমন্ত্রীকে বললেন, ‘‘দিদি, ও দিদিইইই...!’’ ব্যাস, তাতেই সভাস্থল জুড়ে কি ব্যাপক হইচই, গুরু কী দিলে সুলভ ভাবভঙ্গি। বাঙালি দিদি বলতে শরৎচন্দ্রের মেজদিদি, যতীন বাগচির কাজলাদিদি কিংবা বিভূতিভূষণের দুর্গা (দিদি)-র কথা জেনে এসেছে, মাতৃসুলভ সেই দিদিত্বের বিপ্রতীপে ‘দিদি’ সম্বোধনের সঙ্গে এ কেমন প্রবঞ্চনা? আর রইল রসবোধের প্রসঙ্গ। এই মোটা দাগের বিদ্রুপে রস কই! পুরুষতান্ত্রিক আস্ফালনই যে ষোলো আনা। শরৎ পন্ডিত, সুকুমার রায়দের উত্তরাধিকারদের কি হাস্যরস এতই কম পড়েছে?

     

     

    উত্তর-সত্য যুগে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে অনর্গল অনৃতভাষণ দেখেছিল বাংলা। আগে এমনটা হয়নি বা ভবিষ্যতেও হবে না এমন নয়। কিন্তু এতকাল প্রতিতুলনা টানা চলত চুরি কিংবা স্বজনপোষণের দক্ষতার ভিত্তিতে। এ বার সেই জায়গায় উঠে এসেছিল ধর্ম ও জাতিগত বিভাজন। কে কত বড় হিন্দু তার অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হল। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেমালুম বলে বসলেন বাংলায় এখন দুর্গাপুজো হয় না! এই ঘূর্ণপাকে পড়ে কিছু মানুষ অবশ্য গেছোদাদা হয়ে গিয়েছিলেন, তৃণমূল-বিজেপি উভয় ডালেই নিরন্তর ঝোলাঝুলি করার পর তাঁরা এখন কোন ডালে রয়েছেন, তা বোঝাই বড় দুষ্কর।

     

    আরও পড়ুন: নর্থপোল থেকে সান্তা আসে পুঁজিবাদের থলি নিয়ে 

     

    বাঙালি কিন্তু ওই মোটা দাগের রসবোধ কিংবা চড়া মূল্যের প্রচারযন্ত্রকে বিশেষ আমল দেয়নি। উল্টে রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের উপর তীব্র বিরাগ থাকলেও, সেই সমস্ত রাগ প্রশমিত করেও বিজেপিকে ব্যাপক ভাবে পরাস্ত করেছে। বুঝিয়ে দিয়েছে, দেশের বহুত্ববাদ, লিঙ্গসাম্য, উদারবাদ রক্ষায় স্বাধীনোত্তর যুগের মতো স্বাধীনতা-উত্তর যুগেও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে বাংলা। বাঙালির লক্ষ্মী যখন চঞ্চলা, সরস্বতীর কৃপাদৃষ্টিও আগের মতো প্রবল নয়, তখন এই স্বাভিমান, এই স্বাতন্ত্র্য কি বাঙালি জাতির নয়া আভরণ নয়? 2021-তো তাই উপহার দিয়ে গেল বাংলাকে। আর দেশের উদ্দেশেও বার্তা পাঠাল, অপরাজেয় কেউ নয়। ভাস্কর পণ্ডিত (বঙ্গে মরাঠা আক্রমণের সময় বর্গী সেনাপতি)-রা নয়, উদয়ন পণ্ডিতরাই আলোকবর্তিকা নিয়ে এগিয়ে যায় বরাবর। এই আলোকবর্তিকাকে পাথেয় করেই নতুন বছরে পথ হাঁটবে আফস্ফা-পীড়িত মেঘালয়-মণিপুর কিংবা রাষ্ট্রপীড়িত গণ-আন্দোলন।

     

     

    আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও কিছু আশাব্যাঞ্জক ঘটনা ঘটছে। দক্ষিণপন্থা ও দক্ষিণপন্থীদের এই প্রাবল্যের যুগে চিলি সমেত লাতিন আমেরিকার বহু দেশেই বামপন্থী ও মধ্যপন্থীরা ক্ষমতায় আসছেন, যা বিশ্বে মতাদর্শ ও কৌশলগত ভারসাম্যের জন্য ভীষণ জরুরি। বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি পরিবেশরক্ষায় এক মঞ্চে মিলিত হয়ে শপথ নিচ্ছে। এমনকি নতুন বছরের গোড়ায় বিশ্বের পাঁচ বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্র একযোগে ঘোষণা করেছে, তারা কোনও অবস্থাতেই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে না। রাশিয়া যখন ইউক্রেন সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করছে, চিন-আমেরিকা সম্পর্ক যখন স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে, তখন এই ঘোষণায় কিঞ্চিৎ ভরসা জাগে বইকি। তবু চিন্তায় রাখছে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতা আর সেই অস্থিরতাকে ঢাল করে কিছু রাষ্ট্রশক্তির হীন স্বার্থবুদ্ধি চরিতার্থ করার চেষ্টা। বিভিন্ন দেশে মৌলবাদের আস্ফালনও যথেষ্ট শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠছে।

     

     

    তবুও যে ক্যাপিটল হিলের ঘটনার পরেও মার্কিন মুলুকে গণতন্ত্র বহাল তবিয়তে রয়েছে, দেশব্যাপী কৃষক আন্দোলন, বাংলার নির্বাচন বুঝিয়ে দিয়েছে অসীম ক্ষমতাধর রাষ্ট্রশক্তিও অপরাজেয় নয়, তাতেই মনে হয় আশার সব ক'টি প্রদীপ এখনও নির্বাপিত হয়নি। 2022-এ এই দীপগুলোকে দেদীপ্যমান করে রাখাই আমাদের সকলের কাজ।

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    ফলাফল যার পক্ষেই যাক, বাংলার সামনে ইতিহাসের হাতছানি স্পষ্ট।

    গত ভোটে মরুরাজ্যে যাও বা মরূদ্যানের দেখা মিলেছিল, সেটাও বোধহয় মরীচিকা হয়ে মিলিয়ে যেতে চলেছে।

    দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সঙ্ঘ এবং মহাসভা আগাগোড়া অনুপস্থিত থেকেছে

    কালো চামড়ার মানুষদের ওপর অত্যাচারের যে সুদীর্ঘ দলিল, তাতে জর্জ ফ্লয়েডের নামটা নতুন সংযোজন মাত্র।

    সহিষ্ণু আর সময়ানুবর্তী হওয়ার পাঠ যাদের দেওয়ার কথা, সেই শিক্ষকদের একাংশই এই দুইয়ের পাঠ ভুলেছেন।

    কথার খেলাপ করেছি আমিও, সেই লজ্জায় মাস্কে মুখ ঢাকি।

    রাষ্ট্রের চোখেও চোখ রাখা যায়, শেখাল পুরনো বছর-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested