×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • দক্ষিণের হাওয়ায় ভিকট্রি স্ট্যান্ডে তিন চ্যাম্পিয়ন

    বিতান ঘোষ | 15-07-2020

    মহামান্য ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে আশ্বস্ত করেছিলেন, গরম পড়লেই করোনা গায়েব হয়ে যাবে। তাঁর কথায় ভরসা রেখে দেখা গেল ফুরফুরে দখিনা হাওয়া গরম এসে যাওয়ার আভাস দিচ্ছে ঠিকই, তবে করোনা তো গায়েব হয়ইনি, উল্টে আরও জাঁকিয়ে বসেছে। করোনার পালে দক্ষিণ দিক থেকে আসা বাতাস কতটা হাওয়া জোগাচ্ছে জানা নেই, কিন্তু বিশ্বজুড়ে দক্ষিণপন্থীদের দক্ষিণায় মনে হচ্ছে সত্যিই এবার করোনার সঙ্গে বাস করাটাই আমাদের ভবিতব্য হতে চলেছে। নেশন স্টেটের তিন চ্যাম্পিয়ন ন্যাশনালিস্ট করোনা নিয়ে যা বিচিত্র সব অবস্থান এবং বক্তব্য রাখছেন, তাতে বিশ্ববাসীর ত্রাহি মধুসূদন দশা।



    আপাতত করোনা সংক্রমণে শীর্ষে থাকা তিনটি দেশেরই রাষ্ট্রপ্রধানদের সবজান্তা' হিসাবে বিশেষ খ্যাতি আছে। মানে, তাদের মুখনিঃসৃত বাক্যই অলিখিত আইন বা দেশবাসীর অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তারা সেই বিষয়ের অভিজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছেন, এমনটা কখনও শোনা যায়নি। আর একটি বিষয়েও এই তিনদেশের রাষ্ট্রপ্রধানই মিলে যান। এনাদের প্রত্যেকেই সমাজের বিশেষ একটা অংশকে শত্রু জ্ঞান করেন এবং দাবি করেন রাজনীতির পুরোনো কুশীলবরা শত্রুতা করে এই অংশটার সঙ্গে শলা করছেন। এনাদের মধ্যে দু'জন আপাতত করোনাকেও এক বৃহত্তর চক্রান্তের অঙ্গ হিসাবে দেখছেন।



    জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মার্কিন মুলুকে বর্তমানে দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে প্রায় 60 হাজার। মোট আক্রান্তের সংখ্যা 35 লক্ষের কাছাকাছি। মৃতের সংখ্যাও খুব শীঘ্রই দেড় লাখের ঘরে পৌঁছতে চলেছে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন নির্বিকার। উল্টে ট্রাম্পের ফতোয়া দেশের সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান, মায় স্কুল কলেজ অবিলম্বে খুলে দিতে হবে। নইলে সরকারি অনুদান থেকে বঞ্চিত হবে তারা। মহামারীর কবলেও যে মার্কিন মুলুকে সমাজ ও অর্থনীতির চাকা থামেনি, গোটা বিশ্বকে তা দেখাবার এত বাসনা যে, ছোট শিশুদেরও স্কুল-কলেজ অবধি টেনে আনতে চাইছেন ট্রাম্প। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে। এমনিতে তিনি নিজেও মাস্ক পরতে ভালবাসেন না। সগর্বে জানান, প্রয়োজন হলে তবেই মাস্ক পরবেন। এরপর তার প্রয়োজনবোধের উপরও বিশেষ ভরসা রাখা যায় না। মার্চ মাসেই করোনা ভাইরাসকে তিনি এক চিনা চক্রান্ত' বলেছিলেন। করোনা প্রতিরোধে তাঁর প্রশাসন যখন প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও পরিকাঠামো গড়ে তুলতে ব্যর্থ, তখন তাঁর যাবতীয় রাগ গিয়ে পড়েছিল চিন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপর। চিনের সঙ্গে বাণিজ্য শুল্ক আর দক্ষিণ চিন সাগর নিয়ে বিবাদ চলছিলই, এবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুদানও বন্ধ করলেন তিনি। সম্প্রতি সে দেশে করোনা মোকাবিলায় গঠিত টাস্ক ফোর্সের প্রধান অ্যান্টনি ফাউচির সঙ্গেও বিবাদ বাধিয়েছেন ট্রাম্প। ফাউচি যেভাবে করোনা মোকাবিলার পথ বাতলাচ্ছেন, তা না-পসন্দ ট্রাম্পের। ট্রাম্প মহলের দাবি, প্রেসিডেন্ট মনে করছেন এতে মানুষ বেশি ভয় পাবেন। যুক্তরাষ্ট্রের শুধু ফ্লোরিডাতেই যেখানে দিনে 15,000 মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন এবং বিভিন্ন প্রদেশের কোভিড হাসপাতালগুলি সাধ্যের বাইরে রোগীদের ভর্তি নিতে বাধ্য হচ্ছে, সেখানে ট্রাম্পের এমন ডোন্ট কেয়ার' ভাবভঙ্গিতে এমনিই আমেরিকাবাসী তটস্থ। প্রখ্যাত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ফাউচি সেই বাস্তব অবস্থাটা তুলে ধরেই শাসকের রোষানলে পড়েছেন।



    দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলেও অবিকল ট্রাম্পের মতোই একজন করোনা মোকাবিলা' করছেন। এমনিতেই তিনি স্বঘোষিত ব্রাজিলের ট্রাম্প': ব্রাজিলের সামরিক প্রেসিডেন্ট হায়ের বোলসোনারো। 26  ফেব্রুয়ারি— বিশ্বে করোনার আত্মপ্রকাশের প্রায় দু'মাস বাদে সে দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মেলে। তা সত্ত্বেও করোনা মোকাবিলায় উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয় বোলসেনারো প্রশাসন। ব্রাজিলে বর্তমানে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় 17 লক্ষ। তিনি নিজেও করোনা আক্রান্ত হয়ে কোয়ারান্টাইনে আছেন। অবশ্য এরপরেও তাঁর বিচিত্র ও বিপজ্জনক কাজকর্মে ছেদ পড়েনি। কয়েকদিন আগেই ঘরভর্তি সাংবাদিকদের সামনে নাটকীয় ভঙ্গিতে মাস্ক খুলে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আয়্যাম কোভিড পজিটিভ নাও।' এর আগে তাকে কেউ মাস্ক পরতে দেখেনি। ব্রাজিলের সরকারি সংবাদমাধ্যম প্রেসিডেন্টের এ হেন দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজে তাজ্জব। যে দেশে ইতিমধ্যে কয়েক লক্ষ মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, সেই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান অভয় দিচ্ছেন ব্রাজিলিয়ানরা এতটাই কর্মঠ আর পরিশ্রমী যে, করোনা তাদের ছুঁতেও পারবে না। ট্রাম্পের মতো তাঁরও দাবি এসব চক্রান্ত! এখন আবার খবর পাওয়া যাচ্ছে তিনি নাকি কোয়ারান্টাইনে থাকতে পারছেন না। কোয়ারান্টাইন থেকে সহসা জনসমক্ষে বেরিয়ে এসে হয়তো আর একবার সবাইকে চমকে' দেবেন বোলসোনারো। যদি বলেন, ‘করোনায় পজিটিভ হয়ে দেখলাম ব্যাপারটা আদৌ গুরুতর কিছু নয়,' তাহলেও বিশেষ অবাক হওয়ার থাকবে না।



    মার্চের গোড়াতেও ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রক প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল, এটা নিয়ে উদ্বেগের কিছু ঘটেনি। তারপর 24 মার্চ মধ্যরাত থেকে দেশজুড়ে শুরু হল এক কঠোর ও সুদীর্ঘ লকডাউন প্রক্রিয়া। মাঝে দেশের প্রধানমন্ত্রী এসে আলো নেভালেন, বাতি জ্বালালেন, কাঁসর-ঘণ্টা বাজালেন। কিন্তু সংক্রমণের গ্রাফ ঊর্দ্ধমুখীই রইল। বর্তমানে দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা 10 লক্ষের দিকে এগোচ্ছে। দিশাহীন অবস্থা দেশবাসীর, অথচ বাকপটু প্রধানমন্ত্রী এখন নিশ্চুপ। লকডাউনের আসল লক্ষ্য যে মানুষকে ঘরবন্দি করে রাখা নয়, দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে মহামারী মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখা, সেটা দেশের শাসক বোঝেননি, বা বুঝেও বুঝতে চাননি। দীর্ঘ লকডাউনে মুমূর্ষু অর্থনীতি ধুঁকছে, একটার পর একটা রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রকে বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে যার জন্য এত আয়োজন, সেই করোনা বহাল তবিয়তে নিজের ক্ষেত্র প্রসারিত করে চলেছে।



    কোথাও গিয়ে মনে হচ্ছে এসব শাসকরা এই সমস্যার গুরুত্বকে লঘু করে এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইছেন। প্রথমে তাঁরা এই মহামারীকেও নিজেদের ব্যক্তিপ্রচারের স্বার্থে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের পরস্পরবিরোধী অবস্থান, অবিমৃশ্যকারিতায় পরিস্থিতি যখন তাঁদের হাতের বাইরে যেতে চলেছে, তাঁরা তাঁদের দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন। চমকদারিতে যে বিশ্বব্যাপী এই মহামারীর সমাধান হবে না, সেটা তাঁরা বুঝেছেন। বিশ্বে করোনা আক্রান্তদের 50 শতাংশেরও বেশি এই তিনটে দেশের মানুষ হলেও, এই দেশনেতাদের বিশেষ ভাবান্তর লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এখন প্রশ্ন হল, বিশ্বজোড়া এই সমস্যাটাকে যদি এঁরা সমস্যা বলেই স্বীকার না করেন, তবে এর সমাধানসূত্র আদৌ মিলবে কি? তাঁদের খামখেয়ালিপনায় আরও অনেক মানুষকে আমাদের হারাতে হবে না তো?

     

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    ক্ষমতা প্রয়োগ করে মহামারীর মোকাবিলার সঙ্গে আইনগত এবং নৈতিক দায়িত্বও পালন করাও উচিত কেন্দ্রের।

    ‘সব খেলার সেরা’ আছে কিনা জানা নেই, তবে ফুটবলটাই আর বাঙালির নেই!

    কিন্তু আজকাল বড় ধাঁধা লাগে চোখে, খালি চোখে বোঝা যায় না আসলে কে কার পরীক্ষা নিচ্ছে

    শিল্পীর শিল্পে সমকাল ধরা পড়লে, শাসক সর্বদাই ভয়ে থাকে।

    রাজনীতির হরিদাসদের অনৃতভাষণ আর চমকদারিতে ঢাকা পড়ে যায় হরিচাঁদ ঠাকুর এবং তাঁর সমাজ সংস্কার আন্দোলন।

    দেশপ্রেমের রেসিপিতে একটু মুক্তিযুদ্ধের মশলা মেশালে ঝাঁঝ বাড়ে।

    দক্ষিণের হাওয়ায় ভিকট্রি স্ট্যান্ডে তিন চ্যাম্পিয়ন-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested