×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ওরা কলকাতার নীচে থাকে

    আত্রেয়ী সমাজপতি | 23-11-2021

    প্রতীকী ছবি।

    কলকাতার কুঁদঘাটে ম্যানহোল পরিষ্কার করতে গিয়ে মৃত্যু হওয়া সাবির হোসেন, লিয়াকত আলি, মহম্মদ আলমগির ও জাহাঙ্গির আলমদের মতো ঠিকা শ্রমিকদের কথা মনে করানো যাক। এঁরা শহরের বর্জ্য নিজে হাতে (manual scavenger) সাফ করে। কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া ম্যানহোল ও নিকাশি ব্যবস্থা পরিষ্কারের ক্ষেত্রে মূলত যন্ত্রের সাহায্য নেওয়ার কথা। কিন্তু এই ক্ষেত্রে কোনও রকম সুরক্ষাবিধি না মেনে কেবলমাত্র  চুক্তির ভিত্তিতে এই কাজে তাঁদের  ব্যবহার করা হয় এবং ম্যানহোলের ভিতরে ওই রকম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত তাঁদের এ ভাবেই মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়। শহরে এ ভাবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল গত ফেব্রুযারিতে।

     

     

    তবে পরিস্থিতির যে বিশেষ পরিবর্তন হয়নি তা সম্প্রতি বিধাননগরের এএ ব্লকে এক সাফাইকর্মীর ম্যানহোল পরিষ্কার করার ঘটনাতেই স্পষ্ট। বিধাননগর পুর প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘এটা হওয়ার কথা নয়, কাউকে ম্যানহোলে নামাতে হলে উপযুক্ত নিরাপত্তা দিয়েই নামানোর নিয়ম। সেটা আমাদের পুরসভাতেও মানা হয়। কী কারণে এমনটা হল খোঁজ নেব।’’ 118 নম্বর ওয়ার্ডের কোঅর্ডিনেটর তারক সিংহও জানিয়েছেন, কলকাতা পুরসভার অধীনে সব জায়গায় যন্ত্রচালিত নিকাশি ব্যবস্থার মাধ্যমে শহর পরিষ্কারের কাজ করার কথা।

     

     

    সাবির, লিয়াকত, জাহাঙ্গির, আলমগির— এঁরা চার জনেই ছিলেন মালদহ জেলার দরিদ্র দলিত মুসলমান পরিবারের যাঁরা আর্থ-সামাজিক দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে। অন্ধকার ওই ম্যানহোলে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে শহরের সব নালা-নর্দমা পরিষ্কার করতে হয় এই ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার’-দের। Prohibition of employment as manual scavenger and their rehabilitation rules, 2013 অনুযায়ী, ম্যানহোল ও নিকাশি ব্যবস্থা পরিষ্কারের কাজে ব্যক্তি নিয়োগ বর্তমানে নিষিদ্ধ। সবটাই যন্ত্রচালিত হওয়ার কথা এবং কয়েকটি  বিশেষ ক্ষেত্রে যেখানে ব্যক্তি নিয়োগ করা হবে সেখানে যথেষ্ট সুরক্ষাবিধি মেনে তবেই কাজের নির্দেশ আছে।

     

     

    এই বিশেষ ক্ষেত্রগুলিতে স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের চিফ এগজিকিউটিভ অফিসারের উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে  লিখিত অনুমতি থাকতে হবে। 2020 সালে এই বিলের সংশোধনীতে পুনরায় এই সাফাই ও নিকাশি ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ যন্ত্রচালিত ও দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন করার কথা বলা হয়েছে। কোনও রকম দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিপূরণের উল্লেখ আছে।

     

     

    এই বিলে আরও বলা হয়েছে, যে কোনও সংস্থা বা ব্যক্তি কাউকে এই কাজে নিয়োগ করলে শাস্তিস্বরূপ তাঁর পাঁচ বছরের কারাদণ্ড অথবা পাঁচ লাখ  টাকা পর্যন্ত জরিমানা কিংবা দুই-ই হতে পারে। 1994 সালে সাফাই কর্মচারী আন্দোলন শুরু হওয়ার ফলে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং-এর বিষয়টি জনসমক্ষে আসে। সারা দেশের চিত্র প্রায় একই।

     

     

    গত 3 অগস্ট হায়দরাবাদে শিবা নামের বছর পঁচিশের এক যুবক ও আনথাইয়া নামে বছর পঁয়তাল্লিশের দুই  দলিত ব্যক্তি এই ম্যানহোল পরিষ্কার করতে নামে। ম্যানহোলের ভিতরে শিবা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে উদ্ধার করার জন্য আনথাইয়াকে পাঠানো হলে শিবাকে উদ্ধার করলেও তিনি নিজে তলিয়ে যান। সবচেয়ে  আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে, তিন দিন কেটে গেলেও আনথাইয়ার দেহ উদ্ধারে পুলিশ প্রশাসন চরম উদাসীন ছিল। গত ফেব্রুয়ারি মাসে সংবাদ মাধ্যমের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, কর্নাটকের মাদ্দুর শহরে বছর সাঁইত্রিশের এক ব্যক্তিকে  ম্যানহোল পরিষ্কার করানোর কাজে জোর করানো হলে তিনি আত্মহত্যা করেন।

     

     

    ‘দ্য হিন্দু’-তে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, 2020-র 31 ডিসেম্বর পর্যন্ত বিগত পাঁচ বছরে 340 জন এই কাজে প্রাণ হারিয়েছেন এবং 2019 সালে এই সংখ্যাটি তুলনামূলক বেশি (110 জন), 2018 সালের তুলনায় যা প্রায় 61 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। 2019-এ WHO-র একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, 2003-এর এই আইনটি ঠিক ভাবে বলবৎ না করার জন্য এখনও এই সাফাইকর্মীরা এ ভাবেই কাজ করে চলেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা (ILO), জলবায়ু সহায়কের (WATER AID) একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সাফাইকর্মীদের অনিয়মিত ও কম পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের কয়েকটি দৃঢ় পদক্ষেপের কথা বলতেই হয়। যেমন গত বছর সাফাইমিত্র সুরক্ষা চ্যালেঞ্জ প্রকল্পটির মাধ্যমে সারা দেশের 243টি শহরে চলতি বছরের 30 এপ্রিলের মধ্যে সমস্ত সেপটিক ও নিকাশি ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভাবে যন্ত্রচালিত করার লক্ষ্য ধার্য হয়েছিল, তেমনই ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’-এ এই ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং প্রথা এ বছরের অগস্ট মাসের মধ্যে বন্ধ করার কিছু উদ্যোগের কথা ঘোষণা করেছিল কেন্দ্র।

     

     

    কিন্তু, বারে বারে অভিযোগ ওঠে, পুরসভা এবং সরকারএই ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জরদের মৃত্যুর সংখ্যাটি বেশ কমিয়ে দেখায়। সাফাই কর্মচারী আন্দোলন-এর (এসকে) বেজওয়াদা উইলসনের মতে, মূল সমস্যা হল নিকাশি ও সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কারে নিযুক্ত কর্মীদের সুরক্ষার জন্য নির্দিষ্ট কোনও পলিসি নেই। যদিও 2013-র আইনের আওতায় তাঁরা পড়লেও যার বাস্তব প্রয়োগ নেই।

     

    সঠিক পরিকল্পনা ও যন্ত্রের মাধ্যমে কী ভাবে কাজগুলি ঠিক ভাবে করা যেতে পারে সরকারের সে দিকে দেখা প্রয়োজন। এই কাজ করতে গিয়ে কোনও রকম দুর্ঘটনা ঘটলে পরিবারের সদস্যদের 10 লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ আছে সুপ্রিম কোর্টের। অনেক পরিবারই সময়মতো এই ক্ষতিপূরণ পান না। এ ক্ষেত্রে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার উভয়েই দায় এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে। কেন এই সব মানুষের কথা সরকার ভাববে না? এঁরা দলিত বলে, কোনও রাজনৈতিক সমর্থন পায় না বলে, এঁদের নিয়ে শিক্ষিত সমাজ মিছিল করে না বলে? এই অস্বাস্থ্যকর অমানবিক প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ যন্ত্রচালিত করলে সাবির, লিয়াকতরা অন্তত নাগরিক সুরক্ষাটুকু পেতেন।

     

     

    নাগরিক মঞ্চের অন্যতম কর্ণধার নব দত্ত  “এই শ্রমিক শ্রেণিকে নিজেদের দাবি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে, সংগঠিত হয়ে নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়ে লড়াই করতে হবে। সরকার-প্রশাসন সবাই উদাসীন, সভ্য নাগরিক সমাজ ক্ষমতার লোভে সরকারের মদতপুষ্ট হয়ে থেকে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। তাদের শ্রমিক শ্রেণির কথা ভাবার অবকাশ নেই। যে পুরপ্রতিনিধিরা এই কাজে যুক্ত তাঁদের যদি ব্যক্তিগত ভাবে চিহ্নিত করে দোষী সাব্যস্ত করা হয় তা হলে কিছুটা সমাধান নিশ্চয়ই হত।’’

     

     

    লিয়াকত, সাবিরদের মৃত্যু হয়তো সরকারের কাছে কেবল সংখ্যা মাত্র। কিন্তু পরিবারে তাঁরাই ছিলেন একমাত্র রোজগেরে। তাঁদের মৃত্যু এক একটি পরিবারকে ধ্বংসের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। দিনের পর দিন এই কাজ করতে করতে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জাররা হাঁপানি, যক্ষ্ণা, হেপাটাইটিস, মেনিনজাইটিস , কলেরা, বিভিন্ন ধরনের চামড়ার রোগ ও ক্যান্সারের মতো কঠিন রোগে আক্রান্ত হয় এবং নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে বিভিন্ন নেশায় ডুবিয়ে রাখে। যে আর্থিক সামাজিক ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে তাঁদের যেতে হয় সেই ক্ষতি কখনও আর্থিক ভাবে পূরণ করা সম্ভব নয়।


    আত্রেয়ী সমাজপতি - এর অন্যান্য লেখা


    পূর্ব কর্ণাটকে মাটির জলে ইউরেনিয়াম!

    প্রচারের বিপুল ঢক্কা নিনাদ সত্ত্বেও মোদী জমানায় সাত বছরে ভারত দুর্নীতির নিরিখে একই জায়গায় রয়ে গিয়েছে

    ভারতে অপুষ্টি দূরীকরণে খাদাসংক্রান্ত বিল ও প্রকল্পগুলি কতটা কার্যকর?

    উবার ইটসের মহাকাশ অভিযান

    ম্যানুয়াল স্ক্যাভেন্জারদের জীবনযুদ্ধের অমানবিক ও অবর্ণনীয় সংগ্রাম।

    ওরা কলকাতার নীচে থাকে-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested