পেট্রোরসায়ন (petrochemical) শিল্পে, পলিথিন প্লাস্টিক শিল্পে, খনিজ তেল পরিশোধন শিল্পে উৎপন্ন দূষিত পদার্থ, গৃহস্থালি ও হোটেল- রেস্তরাঁর আবর্জনা, চাষের জমিতে ব্যবহার করা বিভিন্ন কীটনাশক, সার, প্রতি মুহূর্তে দূষিত করছে জলকে। আর্সেনিকযুক্ত জল ব্যবহার করে কত মানুষ ক্যান্সার, বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ, পেটের সমস্যায় ভুগছেন। তেমনই জলে মাত্রাতিরিক্ত ইউরেনিয়ামের (Uranium) হদিশ মিলেছে কর্নাটকের বিস্তীর্ণ এলাকার বিভিন্ন গ্রামে।
কর্নাটকের 73টি গ্রামের মধ্যে ওই 57টি গ্রামে জলে ইউরেনিয়ামের মাত্রা অনেক বেশি। এক লিটার জলে 60 মাইক্রোগ্রামেরও বেশি আর বাকি গ্রামগুলির ক্ষেত্রে তা ন্যূনতম 30 মাইক্রোগ্রাম। হু (WORLD HEALTH ORGANISATION)-র মাপকাঠিতে 30 মাইক্রোগ্রাম/লিটার এবং অ্যাটোমিক এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ড (ATOMIC ENERGY REGULATORY BOARD) -এর মাপকাঠিতে (60 মাইক্রোগ্রাম/লিটার) এই সব গ্রামে মাটির জলে অত্যধিক ইউরেনিয়ামের হদিশ মিলেছে যা রীতিমতো চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।
ইউরেনিয়াম নামটির সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় স্কুলের পাঠ্যবইয়ের পাতায়। এটি একটি তেজস্ক্রিয় ধাতু। এটি নীলচে সাদা রঙের হয়, স্টিলের থেকে নরম, কিন্তু পরিশোধনের সময় এর বর্ণ সোনালী সাদা হয়ে থাকে। ইউরেনিয়ামের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় নিউক্লীয় চুল্লিতে যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম মাধ্যম, পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর ক্ষেত্রে। 1789 সালে বিজ্ঞানী মার্টিন হেনরিখ ক্লাপরথ ইউরেনিয়াম আবিষ্কার করেন ও 1896-তে হেনরি বেকারেল সর্বপ্রথম এর তেজস্ক্রিয়তা সর্বসমক্ষে এনেছিলেন। পরবর্তীতে সারা বিশ্ব 1945-এর হিরোশিমা ও নাগাসাকির পারমাণবিক বিস্কোরণ বিপর্যয়ের সাক্ষী হয়ে রইল। এই তেজস্ক্রিয় পদার্থ তার সর্বৈব শক্তি নির্দিষ্ট পরিসরে প্রদর্শন করবে এটাই কাম্য। কিন্তু তার ব্যাপ্তি যদি সাধারণ মানুষের রোজকার জীবনের সঙ্গে মিশে যায় তা হয়ে ওঠে বিপজ্জনক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ পশ্চিমে কলোরাডো নদীর গিরিখাত জুড়ে থাকা নাভাজো জনজাতি ইউরেনিয়ামের এই সোনালি বা হলুদ ধুলোর কবলে বিপন্ন। বলা যেতে পারে, কঙ্গোর শিঙ্কোলোবুই গ্রামের মানুষদের কথা। 1915 সালে ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদ্ রবার্ট রিচার্ড শার্প ইউরেনিয়ামের অস্তিত্বের সন্ধান দেন এই প্রদেশে। তারপর থেকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় যে ইউরেনিয়াম বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য গ্রামের মানুষদের কাজে লাগানো হত। এই অঞ্চলের মানুষ এখনও হলুদ ধুলোর বিষে জর্জরিত। বাসভূমি হারিয়ে ও ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন এই জনজাতিরাই।
ভারী ইউরেনিয়াম-238 ভেঙে তৈরি হয় বোরন, থোরিয়াম, রেডিয়াম, পোলোনিয়ামের মতো এমন কিছু তেজস্ক্রিয় ধাতু যা কোষের DNA-কে প্রভাবিত করে ক্যান্সার-সহ একাধিক মারণ রোগের সৃষ্টি করে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই রোগের শিকার হন। একই ছবি ধরা পড়ে ভারতের ঝাড়খণ্ড লাগোয়া জাদুগোড়াতে। এখানে যাঁরা থাকেন তাঁরা অবলীলায় তেজস্ক্রিয় পদার্থ খালি হাতে বহন করেন, খনিজ বর্জ্য নাড়াচাড়া করেন, বিপদসীমা পার হয়ে গিয়েছে, এমন জায়গাতেও খালি পায়ে হাঁটাচলা করেন চূড়ান্ত অসতর্ক ভাবে। কারণ তাঁরা ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা সম্বন্ধে চূড়ান্ত অসচেতন। এই সব জায়গায় ইয়েলো কেক, মানে ইউরেনিয়াম তৈরির পর বর্জ্য পুকুর কেটে টেলিং পন্ড-এ ফেলা হয়। ইউরেনিয়াম ছাড়াও রেডিয়াম, থোরিয়াম তেজস্ক্রিয় কণা জলে মিশে যায় এবং বিক্রিয়ার ফলে উদ্ভূত রেডন গ্যাস ও গামা রশ্মি পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। ওই পুকুরের জলে স্থানীয়েরা কাজ করেন, ট্রাকে করে পাথর নিয়ে যাওয়ার সময় পড়ে যাওয়া সেই পাথর তুলে কেউ কেউ আবার বানায় তেজস্ক্রিয় ঘর! প্রশাসনের তরফে হয়তো সেখানে দায়সারা ভাবে বোর্ড রয়েছে। সময় বিশেষে বিভিন্ন আন্দোলন হলেও মোটের উপর এই চিত্রের খুব একটা রকমফের হয়নি।
দিভেচা সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স, সেন্টার ফর অ্যাডভান্স রিসার্চ ইন এনভায়রনমেন্টাল অ্যাক্টিভিটি, ম্যাঙ্গালোর ইউনিভার্সিটি-র মতো প্রতিষ্ঠান কর্নাটকের এই 73টি গ্রামে মাটির জলে ইউরেনিয়ামের ঘনত্ব নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে ওই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ‘কারেন্ট সায়েন্স’ নামক পত্রিকায় প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, কর্নাটকের টুমকুর ও চিত্রদুর্গ জেলার একটি করে গ্রামে, কোলারের পাঁচটি গ্রাম, চিক্কাবল্লাপুরার সাতটি গ্রামে এক লিটার জলে 1000 মাইক্রোগ্রাম ইউরেনিয়ামের ঘনত্ব পাওয়া গিয়েছে। ইউরেনিয়ামের রাসায়নিক বিষক্রিয়া বেশি হওয়াই এ ক্ষেত্রে উদ্বেগের কারণ। ইস্টার্ন ধারওয়ার ক্রেটনে ইউরেনিয়ামের আধিক্যের মূল কারণ নিস শিলা ও গ্র্যানিটোড।
আরও পড়ুন: এক বার পৃথিবীর ডিপ ফ্রিজ দেখতে যাবেন না কি?
পূর্ব কর্নাটকের ল্যাটেরাইটযুক্ত দোঁয়াশ মাটি নির্দেশ করে যে আবহাওয়ার পরিবর্তনের সময় বেশি মাত্রায় জারণ ঘটে তার ফলেই ইউরেনাস থেকে ইউরেনিল আয়নে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই ইউরেনিল মাটির জলে মিশে ইউরেনিয়ামের মাত্রা বাড়ায়। অন্য দিকে জলস্তর ক্রমাগত কমে যাওয়ায় ও মাটির জলের সঙ্গে ঝর্নার জলের মিশ্রণ ও ইউরেনিয়াম বৃদ্ধির কারণ। ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তার ফলে কিডনি, মস্তিষ্ক, যকৃৎ, হৃৎপিন্ড-সহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘ দিন এর তেজস্ক্রিয়তার ফলে ক্যান্সার হয়ে থাকে।
শুধু হিরোশিমা ও নাগাসাকি নয়, 1979 সালে চার্চ রক ইউরেনিয়াম মিলে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় নাভাজো জনজাতির অনেকে প্রাণ হারিয়েছিলেন। এই ঘটনায় দূষিত হয়ে যায় নাভাজোদের নদী সমেত সমস্ত জলাধার। ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই মারণ রোগ বয়ে চলেছিল। শুধু ভারত, রাশিয়া, কাজাখস্তান নয়, সমগ্র বিশ্ব জুড়েই ইউরেনিয়ামের ভয়ঙ্কর প্রভাব। সত্তরের দশক থেকেই ইউরেনিয়াম দূষণ ও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে একাধিক আন্দোলন চলছে। নিউক্লিয়ার ফ্রি ফিউচার ফাউন্ডেশন, ইন্টারন্যাশনাল ফিজিসিয়ান ফর দ্য প্রিভেনশন অফ নিউক্লিয়ার ওয়ার-এর মতো সংস্থা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সবার আগে ওই খনি অঞ্চলে থাকা অধিবাসীদের তেজস্ক্রিয়তার ভয়াবহতা তুলে ধরে সচেতন করতে হবে, সর্বতো ভাবে সব দেশকে এগিয়ে আসতে হবে নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে, হলুদ ধোঁয়ার বিষ থেকে এই পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য।
প্রচারের বিপুল ঢক্কা নিনাদ সত্ত্বেও মোদী জমানায় সাত বছরে ভারত দুর্নীতির নিরিখে একই জায়গায় রয়ে গিয়েছে
ম্যানুয়াল স্ক্যাভেন্জারদের জীবনযুদ্ধের অমানবিক ও অবর্ণনীয় সংগ্রাম।
ভারতে অপুষ্টি দূরীকরণে খাদাসংক্রান্ত বিল ও প্রকল্পগুলি কতটা কার্যকর?
পূর্ব কর্ণাটকে মাটির জলে ইউরেনিয়াম!
উবার ইটসের মহাকাশ অভিযান