বাস থেকে নামার সময় হঠাৎ ধাক্কা লাগল। এক মহিলা, তাঁর জটপড়া চুল, গায়ের কাপড় অতি জীর্ণ, খিদে তেষ্টায় চোখেমুখে ক্লান্তি, কোলে 7-8 মাসের বাচ্চা। বাচ্চাটির মুখে একটু খাবার তুলে দেওয়ার জন্য পাগলের মতো কখনও সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলির কাচে টোকা মেরে, কখনও বাস থেকে নামা যাত্রীদের দিকে ছুটে যাচ্ছেন! রাস্তাঘাটে এই চেনা ছবি আকছার দেখে থাকি আমরা কমবেশি সকলেই।
যতই আমরা বলি শিক্ষায় শিল্পে ভারতের উন্নয়নের কথা, কিন্তু এখনও স্বাধীন দেশের নাগরিকের প্রাথমিক চাহিদাগুলি (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান) পূরণের ব্যবস্থা সরকার করতে পারেনি। আর তাই স্টেশনের ধারে, বাসস্ট্যান্ডের পাশে, খোলা আকাশের নীচে চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আধপেটা খেয়ে এ ভাবেই মিন্টু, তাপসীরা তাঁদের পরিবার নিয়ে লড়াই করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। গত 14অক্টোবর 116টি দেশ নিয়ে করা 2021-এর বিশ্বক্ষুধাসূচক রিপোর্ট (World Hunger Index Report) অনুযায়ী ভারতের স্থান 101, মানে মায়ানমার (71), নেপাল (76), বাংলাদেশ (76), পাকিস্তান (92)-এরও পরে, গত বছরের তুলনায় সাত ধাপ নীচে। যদিও 2020 -তে ভারতের যা স্কোর ছিল (35.5) তার তুলনায় কিঞ্চিত অগ্রগতি (27.5), তবুও ভারতের পরিস্থিতিকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ক্ষুধাসূচক স্কোর পরিমাপ করা হয় মূলত অপুষ্টি (প্রয়োজনের তুলনায় কম ক্যালোরি গ্রহণ), চাইল্ড ওয়েস্টিং (পাঁচ বছরের নীচে যে সব শিশুর উচ্চতার তুলনায় ওজন কম), চাইল্ড স্ট্যান্টিং (পাঁচ বছরের নীচে যে সব শিশুর বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম) ও পাঁচ বছরের কমবয়সি শিশুদের মৃত্যুর হারের উপর ভিত্তি করে।
আরও পড়ুন:সাগরে ঝঞ্ঝা, মাঠের ফসল প্লাবিত হয়ে মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা
করোনা মহামারী যে দেশের অর্থনীতি, স্বাস্থ্যের উপর ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলেছে, এই ক্ষুধাসূচক তারই বড় প্রমাণ। ভারতের প্রায় 15.3 শতাংশ মানুষ অপুষ্টির শিকার যা 2005-2006-এ 19.6 শতাংশের তুলনায় কিছুটা কম এবং শিশুমৃত্যুর হার অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেকটাই কমে হয়েছে 3.4 শতাংশ। অতএব এই দুই ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন হলেও তা মোটেই সন্তোষজনক নয়।
কিন্তু এই অপুষ্টির কারণ কী? প্রধানত বলা যেতে পারে লিঙ্গবৈষম্য, মায়েদের শিক্ষাগত সীমাবদ্ধতা, শারীরিক গঠনগত তারতম্যের কথা। এ ছাড়া বাল্যবিবাহ, দারিদ্র, প্রয়োজনীয় বাসস্থানের অভাব, সঠিক খাদ্যাভ্যাস না থাকার জন্য কম বডি মাস ইনডেক্স বা BMI, অতি মাত্রায় অ্যানিমিয়া ও ডায়েরিয়া, জন্মনিরোধক বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকা এবং শৌচাগারের সংখ্যা প্রয়োজনের নিরিখে কম থাকা এর জন্য বহুলাংশে দায়ী।
অথচ ভারত খাদ্যে স্বয়ম্ভর। বিগত কয়েক দশকে ভারতে খাদ্যশস্য উৎপাদন রীতিমতো অবাক করার মতো, কিন্তু দারিদ্রসীমার নীচে থাকা এই পরিবারগুলোকে উন্নতমানের পুষ্টিকর খাবারের জোগান দেওয়া এখনও এক আকাশকুসুম কল্পনা। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সরকার নির্ধারিত সুষম খাদ্যের যে তালিকা সেই অনুযায়ী সম্ভাব্য সবচেয়ে সস্তা খাবারও ভারতের গ্রামীণ অঞ্চলের চার জনের মধ্যে তিন জনই জোগাড় করতে পারে না।
পুষ্টি ও খাদ্যসুরক্ষার (Food Security) বহুবিধ সমস্যা মোকাবিলা জন্য ভারতে প্রচুর প্রকল্প কার্যকরী রয়েছে যেমন খাদ্যসাথী প্রকল্প, পোষণ অভিযান, প্রধানমন্ত্রী মাতৃবন্দনা যোজনা, সুসংহত শিশু উন্নয়ন পরিষেবা বা ICDS। প্রয়োজন শুধু মানুষের কাছে সঠিক ভাবে পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া বা কোন কোন ক্ষেত্রে প্রকল্পের পুনর্বিন্যাস করা যার লক্ষ্য হবে, খাদ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি নয়, পুষ্টির নিরিখে খাদ্যের গুণমান উন্নত করা। কৃষিতে বিনিয়োগগুলিকে যদি অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলির দিকে চালনা করা যায়, গণবণ্টন ব্যবস্থায় যদি স্বচ্ছতা আনা যায়, আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল পরিবারকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র দুঃস্থ গরিব পরিবারগুলিকে খাদ্যসাথী প্রকল্পের আওতায় আনা যায় এবং প্রশাসনের যাঁরা নিজেদের মুনাফার জন্য এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি করছেন তাঁদের চিহ্নিত করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় তবে নিশ্চিত ভাবে এই অন্ধকার থেকে আলোর পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
পূর্ব কর্ণাটকে মাটির জলে ইউরেনিয়াম!
প্রচারের বিপুল ঢক্কা নিনাদ সত্ত্বেও মোদী জমানায় সাত বছরে ভারত দুর্নীতির নিরিখে একই জায়গায় রয়ে গিয়েছে
ভারতে অপুষ্টি দূরীকরণে খাদাসংক্রান্ত বিল ও প্রকল্পগুলি কতটা কার্যকর?
ম্যানুয়াল স্ক্যাভেন্জারদের জীবনযুদ্ধের অমানবিক ও অবর্ণনীয় সংগ্রাম।
উবার ইটসের মহাকাশ অভিযান