এই ঠাণ্ডায় বরফ গলছে না
দেশের রাজধানীতে এখন তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। রাত্রে পারদ নামছে 3 ডিগ্রি সেলসিয়াসে। পাঞ্জাব-হরিয়ানা-পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ থেকে এসে দেশের রাজধানী দিল্লির চারদিকে রাজপথে অবস্থান করে অবরোধ গড়ে তোলা কৃষকদের মধ্যে ঠান্ডা লেগে বা হার্ট অ্যাটাকে মৃতের সংখ্যা এক ডজন ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু নয়ডা-দিল্লি রাজপথের সংযোগস্থল সিংঘু মোড়ে শিবির খাটিয়ে তৈরি করা আন্দোলনকারী সংযুক্ত মোর্চার নেতৃত্ব দেওয়া চল্লিশটি ইউনিয়নের অস্থায়ী সদর দপ্তরে কেউ পিছিয়ে আসার বা সমঝোতার কথা ভাবছেন না।
সরকার ও কৃষকেরা নিজেদের পূর্ব-অবস্থানে অনড়। সুপ্রিম কোর্টে অবস্থানকারী কৃষকদের সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে বেশ ক’টি মামলা দায়ের হয়েছে। পাল্টা মামলা দায়ের হয়েছে ওই তিনটি কৃষি আইন সংবিধানসম্মত কিনা তার বিচার করতেও। আদালত কৃষকদের আন্দোলনের অধিকার স্বীকার করেও অন্যের অসুবিধে না করে আন্দোলনের অন্য পদ্ধতি খোঁজার পরামর্শ দিয়েছে।
সরকারের ভাবভঙ্গি নেতিবাচক। কৃষিমন্ত্রী আন্দোলনকারী কৃষকদের উদ্দেশে আট পাতার চিঠি লিখে মিডিয়াকে জানিয়েছেন। কিন্তু অখিল ভারতীয় কিষান সমন্বয় সমিতির মুখপাত্র বলেছেন, এই চিঠিতে কংগ্রেস, অকালি ও অন্যান্য বিরোধী দল নিয়ে তেতো মন্তব্য আছে, বর্তমান সরকারের কাজকর্মের ফিরিস্তি আছে, নেই শুধু কৃষকদের আপত্তিগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ ও জবাব।
কৃষকেরা এখনও পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে তাঁদের পক্ষে কোনও আইনজীবী নিযুক্ত করেননি। নেতাদের বক্তব্য, তাঁরা বার কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট দুষ্যন্ত দাভে বা মানবাধিকার আইনজীবী প্রশান্তভূষণ ও কলিন গঞ্জালভেসদের সঙ্গে পরামর্শ করে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন।
এ দিকে, দিল্লির আম আদমি পার্টির সরকার বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডেকে কৃষকদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে ওই তিনটি কৃষি সংস্কার আইন বাতিলের দাবিতে প্রস্তাব পাশ করেছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণকে কৃষকরা তাঁদের নৈতিক জয় বলে দেখতে চান। কারণ, এর ফলে আর ওই আন্দোলনকে মাওবাদী-খালিস্তানি বা কংগ্রেসিদের উস্কানিপ্রসূত বলা লোকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।
দিল্লি, পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও কেরলের দশজন কৃষি অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, তাঁদের মধ্যে জওহরলাল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অরুণ কুমার ও অধ্যাপক হিমাংশুও রয়েছেন, কৃষিমন্ত্রীকে খোলা চিঠি লিখে এই তিনটে আইন বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা পাঁচটি যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন কেন এই সংস্কার ছোট ও প্রান্তিক চাষিদেরও সর্বনাশ করবে।
এই কুয়াশা কাটতে একটু সময় লাগবে মনে হয়।
আসুন, ততক্ষণ আমরা এক পারস্পরিক অবিশ্বাসের আবহাওয়ায় দুই ইকো-সিস্টেমের লড়াইকে বোঝার চেষ্টা করি।
আরও পড়ুন: রাজপথে কৃষক 1: পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দু’টো আলাদা ইকোসিস্টেমের লড়াই
পিঠ চাপড়ানি ও অবিশ্বাস
শান্তিপূর্ণভাবে দিল্লির দিকে এগোতে থাকা আন্দোলনকারীদের হরিয়ানা সরকার তিন সপ্তাহ আগে প্রথম অভ্যর্থনা করে লাঠি, টিয়ার গ্যাসও জলকামান দিয়ে এবং রাস্তা খুঁড়ে বাধা দিয়ে। অবিশ্বাসের ভিত তখন থেকেই গাঁথা হচ্ছিল। সঙ্গে জুটছিল অপমান ও কুৎসা।
প্রশ্ন হল যে রাজ্য বা অঞ্চল থেকে আন্দোলনকারীরা এসেছেন, সেখান থেকে মোদী সরকার গত সংসদীয় নির্বাচনে প্রচুর ভোট পেয়েছেন। কিন্তু আজ এদের সরকারের প্রতি আস্থায় ফাটল ধরল কেন?
· গত কয়েকবছর ধরে চাষিরা সমানে ফসলের ন্যায্য দামের দাবিতে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে বাড়তি দরে (অর্থাৎ সমগ্র উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে 50% বেশি) ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (এমএসপি) চেয়ে মিছিল ধর্না সব করেছেন। প্রতিবারই কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার বিবেচনা করার আশ্বাস দেয়। কিন্তু এবার বিশাল সমর্থনে ক্ষমতায় আসা সরকার লকডাউনের মধ্যে এপ্রিল মাসে তিনটে অর্ডিন্যান্স এনে চাষিদের মাথার উপর থেকে ভরসার হাত সরিয়ে নিল।
· সেপ্টেম্বরে সংসদের অধিবেশন ডেকে তিনদিনে তাড়াহুড়ো করে বিলগুলো পাশ করানো এবং পরের মাসেই রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে সই করিয়ে তাকে আইন বানিয়ে ফেলা! কৃষিব্যবস্থায় কাঠামোগত পরিবর্তনের এই আইনগুলো নিয়ে কারও সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা নয়, বিলগুলো সংসদের সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো নয়। এমন প্রথাবিরুদ্ধ কাজ কেন? করোনা ঠেকানো কি ফসলের খোলাবাজার তৈরি করা? কোনটা বেশি দরকারি?
· নিন্দুকে বলে, তাড়াহুড়োর কারণ আছে। গৌতম আদানির আদানি অ্যাগ্রো লজিস্টিক্স লিমিটেড দশ বছর আগে থেকে ভারত সরকারের ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছে যে ওরা আধুনিকতম ফসলের গুদাম বানাবে যাতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং স্বচালিত সিস্টেমের মাধ্যমে ফসল সংগ্রহ, ঝাড়াই বাছাই সব খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। কৃষক চাইলে সোজা ওই গুদামে এসেও ফসল সাপ্লাই দিতে পারে। কোনও কমিশন এজেন্ট বা আড়তদারের দরকার নেই। চাষির এবং সরকারের চটের বস্তা, ত্রিপল এবং মাল তোলা নামানোর খরচা বাঁচবে। এই ভাবে সরকার ও আদানির যৌথ উদ্যোগে ফুড সাপ্লাইয়ের চেন তৈরি হয়ে খাদ্য সুরক্ষার সহায়তা হবে। আদানির বেস ডিপোগুলোকে ‘নোটিফায়েড মার্কেট ইয়ার্ডস’ বা কৃষিপণ্যের ‘ঘোষিত মুক্তাঙ্গন’ বলা হয়। এভাবে এফসিআইয়ের হয়ে আদানির কোম্পানি প্রায় 5,75,000 মেট্রিক টন খাদ্যশস্য পাঞ্জাব, হরিয়ানা, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গের জন্যে গুদামজাত করেছে। মধ্যপ্রদেশে এরা আরও 3,00,000 মেট্রিক টন গম সংগ্রহ করেছে। ফলে গত আর্থিক বছরে মধ্যপ্রদেশ থেকে সরকারের গম সংগ্রহ প্রথমবার পাঞ্জাবকে ছাড়িয়ে গেছে।
এখন এদের পরিকল্পনা হল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মধ্যপ্রদেশ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র ও গুজরাতে আরও 4,00,000 এমন ভাণ্ডারের মজুত করার ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা । এ জন্যে বহু জায়গায় জমি কিনে সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলে জায়ান্ট গোডাউন বা ‘সিলো’ বানানো চলছে। সূত্রঃ আদানি পোর্টস এন্ড লজিস্টিক্স এর সাইট।
· এর মধ্যে 2017 সালে হরিয়ানার একটি গ্রামে 100 একর জমি কিনে বিশ্বের আধুনিকতম ফসল ভান্ডার গড়ে তোলার চেষ্টা চলছিল। কিন্তু কম দামে কৃষিজমি কিনে সেটাকে অ-কৃষি কাজে ব্যবহার করার জন্যে দরকারি অনুমতি চেয়ে আবেদন হরিয়ানা ভূমি-রাজস্ব বিভাগে দু’বার খারিজ করে শেষে গত মার্চ 2020তে মঞ্জুর করেছে।
আরও পড়ুন: রাজপথে কৃষক 3: নীল আকাশে বাজপাখি ও টিয়া একসঙ্গে উড়বে?
তৃষ্ণায় কাতর হয়ে চাহিলাম জল, তাড়াতাড়ি এনে দিলে একজোড়া বেল!
তার একমাসের মধ্যেই কৃষি পণ্যের বেচাকেনা নিয়ে তিনটি অর্ডিন্যান্স জারি করল সরকার।
কার স্বার্থে?
· চার বছর আগে এমন ভাবেই রাত আটটায় ঘোষণা করা হয়েছিল রাতারাতি 500 এবং 1000 টাকার সব নোট বাতিল। বলা হয়েছিল এর ফলে নাকি কালো টাকা ধরা পড়বে, কাশ্মীর ও অন্যান্য জায়গায় সন্ত্রাসবাদের কোমর ভেঙে যাবে এবং নতুন 2000 টাকার বিশেষ নোট জাল করা যাবে না। কিন্তু আজ চাষিরা দেখছে এর কোনওটাই হয়নি বরং জাল নোট বাজারে দেখা যাচ্ছে এবং কৃষি উৎপাদন ও পণ্যের যে নগদ লেনদেন ভিত্তিক খুচরো বাজার ভীষণ ভাবে মার খেয়েছে।
· কাজেই সরকারের মুখের কথায় শুকনো আশ্বাসে চিঁড়ে ভিজছে না।
· প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন ওঁর আর্থিক নীতিতে 2024 সাল নাগাদ সমস্ত কৃষকের আয় দ্বিগুণ হবে। কিন্তু কী ভাবে হবে তার কোনও স্পষ্ট রোডম্যাপ এখনও কারও কাছে নেই। তা হলে কি বিদেশ থেকে কালো টাকা উদ্ধার করে সব গরিবের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে 15 লাখ টাকা এবং 21 দিনে করোনা বধের মত এটাও কেবল কথার কথা?
কৃষকেরা বলছেন—এই উপহার কি আমরা চেয়েছি ? আমরা তো খালি স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ মেনে C2 cost (পরে ব্যাখ্যা করছি) এর ওপর 50% বেশি এমএসপি দেবার দাবি করেছিলাম। তৃষ্ণায় কাতর হয়ে চাহিলাম জল, তাড়াতাড়ি এনে দিলে একজোড়া বেল!
উপহারটি দেয়ার আগে আমাদের একবার জিজ্ঞেসও করলেন না?
ভারত কিসান ইউনিয়নের নেতারা বলছেন—অর্ডিন্যান্স জারি হওয়ার পর আমরা আমাদের শংকা জানিয়ে সরকারের কাছে সাত বার চিঠি পাঠিয়েছিলাম, কোনও উত্তর আসেনি।
· উলটে আজ প্রধানমন্ত্রী মধ্যপ্রদেশের কৃষকদের ‘ভার্চুয়াল’ বাণী দেবার সময় বলে চলেছেন –এ সব হেরে যাওয়া হিংসুটে বিরোধী দলগুলোর কাজ।
· আন্দোনকারীরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে পাঞ্জাবের প্রধান বিরোধী দল অকালি গোড়া থেকেই মোদীর সহযোগী ছিল। আজ কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে ওঁরা বিজেপির সঙ্গে জোট ছেড়ে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ সিং বাদল ‘পদ্ম- সম্মান' ফিরিয়ে দিয়েছেন।
· এই যে প্রধানমন্ত্রী কৃষকদের বড্ড সাদাসিধে, ওদের মুখে স্বার্থান্বেষী উন্নয়নবিরোধী তামাক খেয়েছে গোছের কথা বলে চলেছেন, এতে কৃষকরা অপমানিত হচ্ছেন বলে আন্দোলনকারীরা মনে করেন। কৃষকরা চান সরকার ওঁদের সম্মান দিয়ে কথা বলুক। দেশের সীমান্তে রক্ষাকর্তা সৈনিক (বেশিরভাগই কৃষকঘরের সন্তান) এবং দেশের অন্নদাতা কিষান—দু’জনই সমান গুরুত্ব এবং সম্মান পাওয়ার অধিকারী।
· কুৎসা রটনা চলছে। এরা শুধু হরিয়ানা পাঞ্জাবের। এরা ধনী কৃষক। এরা ড্রাই ফ্রুট খাচ্ছে। এদের লঙ্গরের পয়সা কে জোটাচ্ছে? আসলে আমরা শহুরে মধ্যবিত্তরা কৃষক বলতে দিলীপকুমারের "নয়া দৌড়’, নার্গিসের ‘মাদার ইণ্ডিয়া’, মনোজ কুমারের ‘উপকার’ সিনেমায় মাথায় পাগড়ি, হেঁটো ধুতি, কাঁধে লাঙল বা কোদাল চরিত্রে মজে আছি।
· অবিশ্বাস গ্রাম-শহরের মধ্যেও। সবুজ বিপ্লবের পরে পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে। আজকের ট্রাক্টর চালানো এবং ছেলেকে শহরে পড়তে পাঠানো পাঞ্জাব-হরিয়ানার চাষির সঙ্গে এ ছবি মেলে না। তাই আমাদের বামপন্থী অন্তরাত্মা সরকারি প্রচারতন্ত্রের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলে ওঠে—এ হল কুলাকদের আন্দোলন। দলিত- শোষিত- নিপীড়িত চাষি কোথায়?
আসলে আমরা শুধু শ্রেণিচেতনার কথা বলি, গোষ্ঠীচেতনা বা গোষ্ঠী সংস্কৃতির কথা আমাদের হৃদয়ে নেই।
তাই বোঝা সম্ভব নয় রাস্তায় বসে পড়া লাখো কিসানদের দু’বেলা খাওয়াতে কেন গুরুদ্বারা লঙ্গর খোলে? কেন জনপ্রিয় শিল্পীরা এদের পাশে দাঁড়িয়েছেন? কেন রাষ্ট্রীয় সম্মানপ্রাপ্ত লেখক এবং খেলোয়াড়েরা কৃষকদের আন্দোলনের সমর্থনে ‘লও ফিরে তব স্বর্ণমুদ্রা, লও ফিরে তব পুরস্কার’ ধ্বনি তোলেন?
(ক্রমশ)
সেরা ভোজনরসিক না বুঝলেও মাংসের হালাল ঝটকা বিচারে নেমেছে দিল্লি পুরসভা
রাষ্ট্রীয় বিচার নীতি: শত নির্দোষ জেলে পচে পচুক, একজন অপরাধীও যেন বাইরে না থাকে!
দুটি শ্লোকে নারী দেবী, বাকি দুই শতে লাঠির বাড়ি
সরকার আগে মন্দার কথা অস্বীকার করলেও লকডাউন তাকে চলতি বছরে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেবে!
মনু যাদের পূজ্য তাদের পক্ষে জন্মভিত্তিক জাতিভেদের উপরে ওঠা অসম্ভব।
সেলুলার জেলের নাম পালটে তাঁর নামে রাখা হল। এ বার দাবি তাঁকে ‘ভারতরত্ন’ দেওয়া হোক।