×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • রাজপথে কৃষক 1: পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দু’টো আলাদা ইকোসিস্টেমের লড়াই

    রঞ্জন রায় | 17-12-2020

    প্রতিবাদের পথ ছাড়তে রাজি নয় অন্নদাতারা।

    সরকার ও কৃষক: ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে

    ভারত সরকারের তিনটে কৃষি সংস্কার আইনের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেল কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আন্দোলনরত কয়েকশো কৃষক ইউনিয়নের 40 প্রতিনিধির আলোচনা পাঁচবার বৈঠকের পরও ব্যর্থ। কোনও সমাধান-সূত্র বেরোল না। কৃষকদের দাবি, তাড়াহুড়ো করে পাশ করানো তিনটে কৃষি সংস্কার আইন বাতিল করতে হবে, কারণ ওগুলো কৃষকের স্বার্থবিরোধী এবং কর্পোরেট সংস্থার স্বার্থে তৈরি। সরকার বলছে, আইন বাতিল করা যাবে না। কিছু কিছু ধারা বদলানো যেতে পারে শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে 10 জন কৃষক প্রতিনিধির ‘ইনফর্মাল’ আলোচনার পর ভারত সরকার কৃষি সচিবের তরফ থেকে দশ দফা সংশোধনের লিখিত প্রস্তাব কৃষক প্রতিনিধির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

    কিন্তু কৃষকদের এক কথা। ওই তিনটে খামতি ভরা গন্ডগোলের আইনে কোনও আধাখ্যাঁচড়া পুলটিস লাগানো চলবে না। আগে তিনটি আইন বাতিল করতে হবে। তারপর সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে নতুন ত্রুটিহীন আইন পাশ করতে হবে। কৃষকদের ইউনিয়নের সংযুক্ত কমিটি লিখিতভাবে সরকারের সংশোধনী প্রস্তাবে অসম্মতি জানিয়ে দিয়েছে। এবার কী হবে?

    কৃষকেরা বলছেন করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে! না জিতে ফিরব না। আরও ছ’মাস ধর্নায় বসতেও তৈরি তাঁরা। কৃষকদের হুঁশিয়ারি, আন্দোলনের পরিধি বাড়বে। প্রথম দফায় 12 ডিসেম্বর দিল্লি-জয়পুর ন্যাশনাল হাইওয়ে বন্ধ করা হয়েছিলওই দিন কোনও টোল ট্যাক্স আদায় হয়নি এর পর জেলায় জেলায় বিজেপির অফিস ঘেরাও করা হবে, ঘেরাও করা হবে ওই দলের সংসদ ও বিধায়কদের, বাদ যাবেন না মন্ত্রীরাও। 14 ডিসেম্বর অনশনও করেছেন তাঁরা। ভবিষ্যতে হয়তো আরও একবার ভারত বন্‌ধ হবে।

    এতদিন আন্দোলন শান্তিপূর্ণ পথে চলেছে। যদিও সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়কেরা এবং মিডিয়ার একাংশ ক্রমাগত আন্দোলনকারীদের পিছনে খালিস্তানি ও মাওবাদীদের উস্কানি ও মদতের কথা বলেছেন। কিন্তু তার কোনও প্রমাণ দেখানো যায়নি। দিল্লি-গুরগাঁও-নয়ডার রাজপথে লাখো কৃষক 7 ডিগ্রি সেলসিয়াসের প্রচণ্ড শীতেও রাস্তা অবরোধ করে তাঁবু খাটিয়ে বসে আছেন।

    কিন্তু এরপর? এ ভাবে অনন্তকাল তো চলতে পারে না।  

    মিডিয়ার মাধ্যমে সরকারের প্রতিনিধিরা দাবি করেন যে কৃষকদের সমস্ত আপত্তি মেনে নিয়ে ওই প্রস্তাবিত সংশোধনের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। কৃষকরা কেন অবুঝ? কারা ওদের মাথা খাচ্ছে? যারাই করুক, তারা সত্যিকারের কৃষকহিতৈষী নয়।  

    আন্দোলনকারীরা বলছেন—বাজে কথা। আমরা কোনও দলের কথায় নাচি না। সরকার আমাদের মূল দাবিকে এড়িয়ে যাচ্ছে। সরকার নিজের অবস্থান থেকে সরতে নারাজ, ফলে আন্দোলন চলবে।

    দু’পক্ষ নিজের নিজের অবস্থানে অনড়। ধনুকের ছিলা টানটান।

    সরকারের দাবি, গোটা দেশে ব্লক স্তরে বৈঠক এবং প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের কৃষক এবং আমজনতাকে বোঝানো হবে ওই তিনটি কৃষি সংস্কার আইন কৃষকদের ভালর জন্যই আনা হয়েছে এবং আন্দোলনকারীদের আশঙ্কাগুলি কেন ভিত্তিহীন।

    আমরা বরং বোঝার চেষ্টা করি দু’পক্ষের বক্তব্য। দেখা যাক, আন্দোলনের গোড়ার দিকে কৃষকদের আইনগুলো নিয়ে কী সমস্যা ছিল, ওদের যুক্তির পক্ষে কী বলা হত। পরের পর্বে সমঝোতা প্রস্তাব ও আন্দোলনকারীদের আপত্তি।

    সরকারের সংশোধনী প্রস্তাবগুলো:

    আইন তিনটের মধ্যে এসেনশিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্ট বা খাস্যশস্য মজুত করার অবাধ স্বাধীনতা নিয়ে কোনও প্রস্তাব নেই। কিন্তু বাকি দুটো নিয়ে আছে।

    এপিএমসি অ্যাক্ট বা মান্ডি তুলে দেওয়া এবং এমএসপি বাতিল করা নিয়ে সংশোধনী প্রস্তাব:

    • আইনে কোথাও মান্ডি বা এপিএমসি তুলে দেওয়ার কথা তো বলা হয়নি। তবু আমরা লিখে দিচ্ছি দুটোই থাকবে। মান্ডির ভেতরে ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (এমএসপি) থাকবে, বাইরে থাকবে খোলা বাজার।
    • কৃষকেরা বলছেন, বাইরে ট্যাক্স ও কমিশন নেই, ভেতরে আছে। তা হলে বাইরের ক্রেতা সহজেই মান্ডির চেয়ে বেশি দামে কিনবে। এ ভাবে দ্রুত মান্ডি এবং এমএসপি উঠে যাবে। আইনে লেখা নেই তো কি হয়েছে? তাই তাদের দাবি আইন করা হোক যে এমএসপির চেয়ে কম দামে কেউ কিনলে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। সেটাই তাদের রক্ষাকবচ।
    • সরকারের বক্তব্য, সেটা সম্ভব নয়।

    কারণ, ক) এমএসপি কোনও দিন আইন ছিল না, সরকারি আদেশে শুরু হয়েছিল, সরকারের আদেশে বলবৎ থাকবে।

            খ) ন্যূনতম দাম বেঁধে দিলে আর ‘খোলা বাজার’ কথাটার কী মানে? বাজারদর ক্রেতা-বিক্রেতার দরাদরির মাধ্যমে ঠিক হবে। সরকার নাক গলাবে না।

      • কিন্তু রাজ্য সরকার চাইলে বাইরের ক্রেতার জন্যেও মান্ডির সমান ট্যাক্স লাগাতে পারে।
      • কৃষকদের আপত্তি ছিল যে নতুন আইন মোতাবেক মান্ডির বাইরে যে কেউ এসে প্যান কার্ড দেখিয়ে ফসল কিনতে পারে। এতে কৃষকদের ঠগের হাতে পড়ার সম্ভাবনা। নকল প্যানকার্ড তৈরি আকছার হচ্ছে। তাই সরকারের সংশোধনী হল বাইরেও ক্রেতাকে নামধাম রেজিস্টার করতে হবে, যাতে কোনও অজ্ঞাতকুলশীল এসে মাল নিয়ে টাকা না দিয়ে কেটে পড়তে না পারে।
      • এর পরে আর কী চাই?
      • বিচার ব্যবস্থার মধ্যস্থতা চাই। চাষির কোর্টে যাবার অধিকার চাই। সরকার বলছে, ক্রেতা-বিক্রেতা মতভেদ হলে সাব ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা কালেক্টরের তৈরি সমিতির মধ্যস্থতায় সমঝোতা করে ঝামেলা মিটিয়ে নাও। কেন খামোখা উকিলের পয়সা খরচ করে আদালতে সময় নষ্ট করবে!
      • কৃষকদের বক্তব্য: মিছিমিছি কেউ আদালতের দরজায় কড়া নাড়ে না। কিন্তু যদি কালেক্টরের রায় আমার না পোষায় তা হলে কোর্টে যাব। সেই অধিকার কেন কেড়ে নিলে?
      • -বেশ, কৃষি বিবাদ সমাধানের জন্যে আলাদা একটা কোর্ট গোছের ব্যবস্থা করছি। আর কিছু?
      • কন্ট্রাক্ট ফার্মিং বা চুক্তিভিত্তিক চাষ নিয়েও প্রশ্ন আছে। এই আইনে ক্রেতার বা অগ্রিম দাদন দিয়ে নির্দিষ্ট দামে নির্ধারিত গুণমানের ফসল কেনার চুক্তির পরও বাজারে দাম চড়লে ক্রেতা (যাকে আইনে ‘স্পনসর’ বলা হচ্ছে) কোয়ালিটি বা কীটনাশক বেশি এইসব অজুহাতে ফসল কিনতে অস্বীকার করতে পারে। উলটে চাষিদের থেকে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে। পাঞ্জাবে পোট্যাটো চিপস বানানোর জন্যে আলু কেনার কন্ট্র্যাক্টে আলুচাষিদের থেকে এক কোটি ক্ষতিপূরণ চেয়ে পেপসি কোম্পানির মামলার ঘা এখনও শুকোয়নি।
      • সরকার বলছে, কৃষকের স্বার্থে এতে ভারতীয় কন্ট্র্যাক্ট অ্যাক্টের ফোর্স মেজর’ (Force Majeure) শর্ত ঢোকানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা আকস্মিক মৃত্যু ইত্যাদির জন্য যদি কৃষক চুক্তির শর্ত পূর্ণ করতে না পারে, তাহলে তাকে কোনও পেনাল্টি দিতে হবে না। বা কোনও কারণে কালেক্টরের বা কোর্টের বিচারে যদি কৃষক লোকসানের জন্য দোষী হয় তা হলে তাকে শুধু বিবাদের টাকার মূল ফেরত দিতে হবে। যদি অন্য পক্ষ বা ক্রেতা শর্ত পূরণ না করে তাহলে তাকে শর্তের চেয়ে 50% বেশি পেনাল্টি দিতে হবে।
      • আন্দোলনকারীদের ভয়, বড় কোম্পানি কোনও না কোনও অজুহাতে কৃষকের জমি নিয়ে নেবে বা বেচতে বাধ্য করবে। সরকার বলছে, আইনের 15 নম্বর ধারায় আছে, স্পনসর বা দাদন দেওয়া পার্টি চাষির জমি বন্ধক রাখতে পারবে না বা জমিতে কোনও স্থায়ী কাঠামো খাড়া করতে পারবে না। যদি কোনও অস্থায়ী কিছু বানায় সেটা চুক্তি শেষ হতেই স্পনসরের নিজের খরচায় ভেঙে দিতে হবে, নইলে চাষি এর মালিক হয়ে যাবে।

    কৃষকের আশঙ্কা

    কৃষক সন্তুষ্ট নয়। ভারত কিষাণ ইউনিয়নের নেতা বলছেন এই আইনের 16 নম্বর ধারাতে তো বলা হয়েছে- যদি রায় চাষির বিরুদ্ধে যায় তাহলে সরকার ল্যান্ড রেভেনিউ অ্যাক্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। তার মানে তো, সেই দাঁড়াল যে ওর জমি নিলাম করে বকেয়া টাকা আদায় হবে।

      • কট্র্যাক্ট অ্যাক্টে দরাদরি করে দাম নির্ধারণের পদ্ধতি কী হবে? যদি খোলা বাজারে দাম বেড়ে যায়? তবে তো চাষির লোকসান!
      • সরকার বলছেন—দু’রকম দামের ব্যবস্থা রয়েছে। একটা হল আগে থেকে ফিক্সড প্রাইস। তাতে বাজারে দাম পড়ে গেলেও কৃষকের ক্ষতি নেই, বেড়ে গেলে লোকসান।
    •  অন্যটি হল, একটা অংশ ফিক্সড বা পূর্ব নির্ধারিত , অন্য অংশটি ভ্যারিয়েবল বা বাজার দামের ওঠাপড়া (ধরুন এমএসপির চেয়ে খানিকটা বেশি বা কম) হিসেবে দু’পক্ষ মিলেমিশে বা দরাদরি করে জুড়ে নেবে। এতেও আন্দোলনকারী কৃষক সন্তুষ্ট নয়?
      • কৃষকেরা বলছেন ও সব হল শুদ্ধ আইনের কথা। গরিব বা সাধারণ কৃষক কবে আম্বানি আদানিদের সঙ্গে মামলা লড়ে পেরে উঠবে? সরকার কেন নিজের দায়িত্ব ফেলে পালাচ্ছে? ছোট ও ক্ষুদ্র শিল্পের জন্যে ব্যাঙ্ক লোনের ব্যাপারে যেমন 100% গ্যারান্টি নিয়েছে তেমনই চাষিদের জন্যে এগিয়ে আসতে কেন অনীহা?
      • তাই চাষিদের দাবি: 1) ন্যূনতম সমর্থন মূল্যের জন্যে আইন হোক। এর নীচে কেনা বেচা – মান্ডির ভেতরে বা বাইরে, পাঞ্জাবে বা বাংলায়—আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ ঘোষিত হোক। ওটাই হবে বেঞ্চমার্ক, ওটাই সরকারের পক্ষ থেকে চাষির জন্যে গ্যারান্টি।

    2) ওই এমএসপি স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে C2 উৎপাদন মূল্যের দেড়গুণ বা 150% হোক।

    সরকার এটা মানতে রাজি নয়।

    মামলা এখন দেশের শীর্ষ আদালতেসুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে বলেছে উদার হয়ে খোলা মনে কৃষক আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে।

    কেন এই অচলাবস্থা? প্রতিবেদকের মতে এ হল পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দুটো আলাদা ইকোসিস্টেমের লড়াই

    আগামী কিস্তিতে আমরা আলোচনা করব বাকি দুটো পয়েন্ট নিয়ে। এমএসপি কেন এল, খাদ্য সুরক্ষা আইন, রেশন ব্যবস্থা এবং উন্নত দেশের কৃষি ও খোলা বাজার নিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসবে এই আন্দোলন শুধু দুটি রাজ্যের কৃষকের সমস্যা কিনা? এমএসপি কি শুধু কৃষকের স্বার্থে নাকি দেশের স্বার্থেও? সবশেষে আমাদের দেশে কৃষির সংস্কার চাই কিনা ও চাইলে কেমন সংস্কার চাই।   

    (ক্রমশ)


    রঞ্জন রায় - এর অন্যান্য লেখা


    আয়ুষ মন্ত্রক তাদের তিনটি ওষুধের প্যাকেজ দিব্য করোনিল, দিব্য শ্বাসারি বটি এবং দিব্য অনুতৈল-কে ‘প্রত

    হারামজাদাদের কি কোনও উদ্ধার নেই?

    দুটি শ্লোকে নারী দেবী, বাকি দুই শতে লাঠির বাড়ি

    সরকার আগে মন্দার কথা অস্বীকার করলেও লকডাউন তাকে চলতি বছরে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেবে!

    নীরব মোদী, মেহুল চোকসির মতো গুজরাতের স্বর্ণ ব্যব্যসায়ীদের কেচ্ছা তো সর্বজনবিদিত।

    ভালবাসার কাঙাল সেই মানুষটি যিনি জাতপাত-ভাষা-ধর্মের বা দেশকালের বিভেদ মানতেন না

    রাজপথে কৃষক 1: পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দু’টো আলাদা ইকোসিস্টেমের লড়াই -4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested