×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • নারীকে ‘রাখা হবে’ কোথায়: বিশ একুশে মনুসংহিতা (2)

    রঞ্জন রায় | 02-06-2021

    প্রতীকী ছবি

    নারীদের সম্পর্কে মনুস্মৃতি কী বলে?

    দার্শনিক নিৎশে বলেছেন “I know of no book in which so many delicate and kindly things are said of woman as in the Law book of Manu.” [1]

    আবার মনু তো এটাও বলেছেন, “যত্র নার্য্যন্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ অর্থাৎ, যে গৃহে নারীকে সম্মান দেওয়া হয় বা পুজো করা হয় সে গৃহ তো দেবালয়। এ তো বেশ কথা, তাই তো  হওয়া উচিৎ। কিন্তু নিন্দুকেরা মনুস্মৃতিতে নারীর স্থান নিয়ে আকথা-কুকথা বলে কেন?

    আসলে হাতির দেখানোর দাঁত আর চিবোনোর দাঁত আলাদা হয়। ঠিক তেমনই মনুস্মৃতিতে মেয়েদের পুরুষের সমান বলে এবং দেবী বানিয়ে সাকুল্যে দুটো শ্লোক বরাদ্দ আছে। কিন্তু বাকি অধ্যায়গুলো জুড়ে মেয়েদের জন্যে বিধান দিয়ে যে প্রায় দুশো শ্লোক আছে। সেগুলো খতিয়ে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায় কেন মনুবাদী সমাজ নারীর কাছে অসহনীয় দুঃখের আকর।

    গোড়ায় সৃষ্টিতত্ত্বে বলা হচ্ছে স্রষ্টা নিজদেহ দ্বিধা বিভক্ত করে অর্ধভাগে পুরুষ হলেন, বাকি অর্ধে নারী। তার থেকে বিরাট পুরুষ সৃষ্ট হল, যিনি মনুর স্রষ্টা (1/32)

    এ তো একেবারে কবি নজরুলের লাইন- বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির  কল্যাণকর; অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।“ (সাম্য)

    তবে তো নারী-পুরুষ সমান সমান, কোনও পক্ষপাতের প্রশ্নই ওঠে না। তবে রামায়ণ ও মহাভারতে নিশ্চয়ই নারীদের বিশেষ সম্মান দেয়া হয়েছে। কারণ মহাপুরাণের চরিত্ররা, মায় বশিষ্ঠের মত কুলগুরুরা কথায় কথায় মনুস্মৃতির দোহাই দেন। তাহলে মায়ের মুখের কথায় দ্রৌপদী পঞ্চস্বামীর মধ্যে ভাগ হয়ে যান কী করে? তাঁর কী ইচ্ছে কেন জিজ্ঞেস করা হয় না? এরপর যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে পাশাখেলায় পণ রেখে হেরে যান কী করে? এবং সর্বসমক্ষে পত্নীকে বিবস্ত্রা করা হলে কোন ধর্মশাস্ত্রের নীতি মেনে মাথা নিচু করে গুডবয় হয়ে বসে থাকেন? নারী কি জমিজিরেত টাকাপয়সা গয়নার মতো লুটের মাল? মনু কী বলেন?

    n      স্ত্রীলোক হল রথ, অশ্ব, ছত্র, ধন, ধান্য, পশু, জিনিসপত্র বা তামার মতোই লুটের মাল; যে জিতে নেবে তার (7/96)

    এই জন্যেই বোধহয় পঞ্জিকায় বিশেষ বিশেষ তিথিতে কোন কোন জিনিস সেদিন খাওয়া যাবে না তার লিস্টিতে স্ত্রী সম্ভোগ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন, মৎস্য, মাংস, অলাবু ও বার্তাকু ভক্ষণ এবং স্ত্রীসম্ভোগ নিষিদ্ধ

    মহাভারত হল, এবার রামায়ণের সাক্ষ্য দেখা যাক

    মর্যাদা পুরুষোত্তম রামচন্দ্র মনুবাদী দৃষ্টিতে আরাধ্য

    কোটি কোটি ভারতীয়র কাছে আদর্শ পুরুষ রামের পত্নীর প্রতি ব্যবহারও তো আদর্শ হওয়া উচিত। অথচ বাল্মীকি রামায়ণে দেখছি উনি সীতাকে দুদুবার সতীত্বের অগ্নিপরীক্ষা দিতে বললেন। আসন্ন প্রসবের সময় গুপ্তচরের মন্ত্রণায় সীতাকে বনবাসে পাঠালেন। শুধু তাই নয়, লঙ্কা বিজয়ের পর পতির দেখা পেয়ে আনন্দিত সীতাকে কটুবাক্যে বললেন— ‘সীতা, ভেবো না আমি তোমার জন্যে এই যুদ্ধ করেছি। আমি রাবণকে পরাজিত করে লঙ্কা দখল করেছি নিজের সম্মান ও হৃতগৌরব উদ্ধার করতে। আজ আমার পৌরুষ তৃপ্ত। সীতা অবাক, সীতা কাঁদো কাঁদো

    রামের ক্রোধ বেড়ে গেল। চোখ পাকিয়ে সীতার দিকে তাকিয়ে উনি উপস্থিত সমস্ত রাক্ষস ও বানর সেনার সামনে সীতাকে বললেন-

    সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছ, কিন্তু তুমি আমার চক্ষুশূল। কারণ তোমার চরিত্র নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে। কাজেই তোমাকে অনুমতি দিলাম- দশ দিকের যে কোনও দিকে সোজা চলে যাও। দূর হয়ে যাও। পরগৃহে এতদিন ছিলে, কোনও উচ্চবংশীয় পুরুষ এমন নারীকে ফিরিয়ে নেবে? তুমি রাবণের অঙ্কশায়িনী। আমি যা বলছি তা অনেক ভেবে বলছি। যদি মন চায় তো লক্ষ্মণ, ভরত, বানরশ্রেষ্ঠ সুগ্রীব বা রাক্ষস শ্রেষ্ঠ বিভীষণ যার কাছে ইচ্ছে হয় চলে যাও। রাবণ তোমার অপরূপ স্বর্গীয় রূপ দেখেছিল। নিশ্চয়ই ওর গৃহে তোমাকে ছুঁয়েছে। সীতা কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান হারালেন। [2] (মূল বাল্মীকি রামায়ণের সংস্কৃত থেকে নীতি আয়োগের প্রাক্তন সদস্য বিবেক দেবরায়ের করা ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ; আগ্রহী পাঠক এই প্রসঙ্গে ড: সুকুমারী ভট্টাচার্য্যের প্রবন্ধ ওঁর রচনাসংগ্রহে দেখে নিতে পারেন) অবশ্য কৃত্তিবাসী বা তুলসীদাসী রামায়ণ ভক্তের দৃষ্টিতে রচিত, তাই সেখানে এরকম বেশ কিছু অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে

    যদিও বর্তমান সমাজের মূল্যবোধের মানদণ্ডে পত্নীর প্রতি রামের ব্যবহার ও কটুবচন শুধু অন্যায় নয়, অকল্পনীয়। কিন্ত সেই সময়ের মূল্যবোধে? তখন তো মনুস্মৃতিই পঞ্চম বেদের মর্যাদা পেয়েছিল

    বোঝাই যাচ্ছে, পুরুষ যখন সামাজিক প্রথা, আইনকানুন বানাতে শুরু করল, তখন নিজেদের দিকে টেনে খেলল। নারী আর সুখে-দুঃখে সমান অংশীদার রইল না। ওরা এবং আমরার খেলা শুরু হয়ে গেল। এ বাণী প্রেয়সী হোক মহীয়সী, তুমি আছ, আমি আছি শুধু কবির ইচ্ছেয় রয়ে গেল। মনুসংহিতায় এবার সেই খেলাটাই পর্বে পর্বে দেখব

     ‘রামচরিত মানস রচয়িতা ভক্তকবি গোস্বামী তুলসীদাস বলেছেন-

    চোর ঢোর গাঁওয়ার শূদ্র অউ নারী,

      ইয়ে সব হ্যায় তাড়ণ অধিকারী।

    বাংলায় বললে- চোর মোষ গোঁয়ার, শূদ্র ও নারী,

                    এদের সামলে রাখতে চাই লাঠির বাড়ি।

    n      নারীদের স্বভাবই হল পুরুষদের দূষিত করা। সাধু সাবধান! (2/213)

    সত্যিই তো, ইডেন গার্ডেনে সাদাসিধে আদমকে আপেল খেতে কে প্ররোচিত করেছিল?

    n      অতএব, পুরুষ যেন মা, বোন বা কন্যার সঙ্গে শূন্যগৃহে না থাকে। (2/215)

    n      রাজা মন্ত্রণাকালে জড়বুদ্ধি, বোবাকালা, অঙ্গহীন, ম্লেচ্ছ, রুগ্ন, অতিবৃদ্ধ, টিয়েপাখি এবং স্ত্রীলোককে ওখান থেকে সরিয়ে দেবেন। কারণ এরা গোপন খবর ফাঁস করতে পারে (7/149-150)

    n      স্ত্রী, পুত্র ও দাস এই তিনজনই ধনহীন থাকবে। এরা যদি কিছু উপার্জন করে তাহলে সেটা তাদের মালিকেরই সম্পত্তি হয়ে যাবে (8/416)

     

    মনুস্মৃতি অনুসারে স্ত্রীজাতির উপনয়ন বা দ্বিতীয় জন্ম হয় না, ওরা দ্বিজ নন; তাই ওদের বেদ পাঠে অধিকার নেই। তাহলে ওঁদের সংস্কার বলতে কী রয়েছে?

    স্ত্রীলোকের জন্যে বিবাহবিধিই বৈদিক সংস্কার, পতিসেবাই গুরুগৃহে বাস এবং গৃহকর্মই তাঁদের যজ্ঞ বা অগ্নি-পরিচর্যার সংস্কার (2/67)

    দুর্গাপুজোয় অঞ্জলি দিতে গিয়ে অনেকেরই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে পুরুতমশাই বলছেন, ব্রাহ্মণেরা ওঁ বলবেন। অন্যেরা এবং সমস্ত মা-বোনেরা নমঃ বলবেন। ঠাকুরমশাইয়ের দোষ নেই। ওঁ হল প্রণব, বৈদিক মন্ত্র; উপবীতধারী বিনা কারও অধিকার নেই উচ্চারণ করার। ব্রাহ্মণের স্ত্রী হলেও নয়। মনুর বিধান যে!

     

    আরও পড়ুন:মনুর মূর্তি প্রতিষ্ঠা: বিশ একুশে মনুসংহিতা

     

    লালন গেয়েছেন, 

    যদি সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারীজাতির কী হয় বিধান,  বামন চিনি পৈতে প্রমাণ, বামনি চিনি ক্যামনে?

    স্ত্রীজাতির ধর্ম

    সে না হয় হল, কিন্তু স্ত্রীজাতির ধর্মাচরণ, মানে দৈনন্দিন জীবন কেমন হবে, সেব্যাপারে মনু কিছু বলে যাননি? আলবাৎ বলেছেন

    n      নিজের ঘরেও বালিকা, যুবতী বা বৃদ্ধা নারী স্বাধীনভাবে কিছু করবেন না। (5/147)

    n     বাল্যে পিতুর্বশে তিষ্ঠেৎ পাণিগ্রাহস্য যৌবনে

    পুত্রাণাং ভর্তরি প্রেতে ন ভজেৎ স্ত্রী স্বতন্ত্রতাম।। (5/148)

    নারী বাল্যে পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রদের অধীন; কখনও স্বাধীনভাবে থাকবেন না

    n      পতি দুশ্চরিত্র, কামুক বা গুণহীন হলেও তিনি সাধ্বী স্ত্রী-র কাছে সর্বদা দেবতার মতো সেবা পাওয়ার যোগ্য (5/154)

    বোঝাই যাচ্ছে কেন সতী অনসূয়া কুষ্ঠরোগী স্বামীর ইচ্ছে মেটাতে তাকে কাঁধে করে পতিতালয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন; সে রবীন্দ্রনাথ এই আখ্যানটিকে পুরুষের কাপুরুষতার চরম উদাহরণ বলে যতই গালমন্দ করুন না কেন! [3]

    n      স্ত্রীলোকের আলাদা কোনও যজ্ঞ, ব্রত বা উপবাস নেই। তিনি যে পতিসেবা করেন তাতেই স্বর্গে পূজো পাওয়ার যোগ্য হন। (5/155)

    n      পতি মৃত হলে স্ত্রী পবিত্র ফল-মূল খেয়ে দিন কাটাবেন, কিন্তু অন্য পুরুষের নাম পর্যন্ত নেবেন না। (5/157)

    n      স্ত্রী সন্তানের মা না হলেও পতির মৃত্যুর পরে ব্রহ্মচর্য পালন করে স্বর্গে যাবেন। (5/160)

    n      সন্তান লোভে যে নারী স্বামীকে এড়িয়ে ব্যভিচারিণী হন, তিনি ইহকালে নিন্দিত, এবং পরকালে পতিলোক থেকে পতিত হন। (5/161)

    n      স্ত্রী-স্বামীকে অবহেলা করে ব্যভিচারিণী হলে সংসারে নিন্দে হয়, সে পরের জন্মে শেয়াল হয়ে জন্মায় এবং যক্ষ্মা, কুষ্ঠ ইত্যাদি পাপরোগের শিকার হয়। (5/164)

    n      স্ত্রী মারা গেলে শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ স্বামী ওঁর চিতায় আগুন দিয়ে ফের বিয়ে করবেন। (5/168)

    n      যে নারী পিতার ধনের গর্বে বা নিজ সৌন্দর্যের অহংকারে স্বামীকে ত্যাগ করে, তাকে রাজা সবার সামনে কুকুর দিয়ে খাওয়াবেন। (8/371)

     

    স্বামী-স্ত্রীর পালনীয় ধর্ম

    নবম অধ্যায়ে এ ব্যাপারে বিস্তৃত নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। এখানে স্থানাভাবে তার কয়েকটি উল্লেখ করছি

    n      পুরুষেরা স্ত্রীদের দিনরাত পরাধীন রাখবেন। (9/2)

    n      স্ত্রীলোক স্বাধীনতার যোগ্য নয়। (9/3)

    n      বিয়ের বয়স হলে কন্যা সম্প্রদান না করলে পিতা, ঋতুকালে পত্নীগমন না করলে পতি, পিতা মৃত হলে মায়ের দেখাশোনা না করলে পুত্র নিন্দের পাত্র হয়। (9/4)

    n      অরক্ষিত স্ত্রীলোক পিতৃ, মাতৃ উভয়কুলের দুঃখের কারণ। (9/5)

    n      মদ্যপান, দুষ্টলোকের সংসর্গ, স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি, ঘুরে বেড়ানো, অকাল নিদ্রা, পরগৃহে বাস এই ছয়টি নারীর ব্যভিচারাদি দোষের কারণ। (9/13)

    n      এরা রূপ দেখে না, বয়স দেখে না; পুরুষ রূপবান বা কুরূপ যাই হোক, পুরুষ দেখলেই সম্ভোগরত হয়। (9/14-15)

    n      ব্রহ্মা এদের এমন স্বভাব দিয়েই সৃষ্টি করেছেন, কাজেই পুরুষ স্ত্রীলোকের রক্ষার ব্যাপারে বিশেষ প্রযত্ন করবে। (9/16)

    n      মনু স্ত্রীদের স্বভাবে দিয়েছেন শয়ন, উপবেশন, অলংকার, কাম, ক্রোধ, কুটিলতা, হিংসুটেপনা, মন্দ আচরণ। (9/17)

    n      স্ত্রীলোকের ব্যভিচারের প্রায়শ্চিত্তের শ্রুতি বা বৈদিক মন্ত্র হল- আমার মাতা যে অসতী হয়ে পরপুরুষ সম্ভোগ করতে চেয়েছেন, ওই ইচ্ছায় অপবিত্র হওয়া (মাতৃরজঃস্বরূপ) শুক্রকে আমার পিতা শুদ্ধ করুন। (9/20)

    n      তবে নীচকুলে জাত স্ত্রী উচ্চকুলের পতির সঙ্গে মিলিত হলে পতির ভাল গুণ প্রাপ্ত হন। যেমন শূদ্রজাতীয় অক্ষমালা বশিষ্ঠের সঙ্গে এবং শারঙ্গী মন্দপালের সঙ্গে মিলিত হয়ে মাননীয় হয়েছিলেন। (9/23)

    n      নারী হল খেত, পুরুষ হল বীজ। দুয়ের মিলনে সন্তান। কখনও খেত প্রধান, কখনও বীজ। উভয়েই সমান হলে সন্তান ভাল হয়ে জন্মাবে। (9/33, 34)

    n      সন্তানের জন্ম দেওয়া, তাদের বড় করা এবং প্রতিদিনের অতিথিসেবা আদি রীতিনীতির জন্যে স্ত্রীলোকেরা লক্ষ্মী। (9/26, 27)

     

     

    সন্তান ধারণে নিয়োগ প্রথা

    প্রাচীন ভারতে নিয়োগ প্রথা ছিল । মহাভারতে কুরুবংশে দুই রাণী অম্বিকা ও অম্বালিকা নিঃসন্তান। তাই মাতা সত্যবতীর আগ্রহে সম্পর্কে দেবর বেদব্যাস এসে দুই রাণীর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডু এবং শূদ্রাণীর গর্ভে বিদুরের জন্মের কারণ হয়েছিলেন। এবার দেখুন নিয়োগ নিয়ে মনু কী বলছেন:

    n      সন্তানের অভাবে পতি প্রভৃতি গুরুজনের দ্বারা সম্যকরূপে নিযুক্ত হয়ে নারী দেবর বা সপিণ্ড [4] (নীচের টীকা দেখুন) কারও থেকে সন্তানলাভ করতে পারে, কিন্তু একটির বেশি নয় (9/59)

    n      বিধবা নারীতে, নিয়োগ ব্যাপারটা নিয়মমাফিক সম্পন্ন হলে তারপরে তারা দুজন পুত্রবধূ ও বড় ভাইয়ের মতো আচরণ করবে (9/62)

    n      কিন্তু ব্রাহ্মণের বিধবা অন্য পুরুষের সঙ্গে এভাবে নিযুক্ত হতে পারে না। তাহলে সনাতন ধর্ম নষ্ট হবে (9/64)

    মনে হয় নিয়োগ বা বিধবার যৌনতা নিয়ে মনু দ্বিধায় ছিলেন, তাই সাবধান করছেন- একের বেশি সন্তান নয়, এরপর কামবশে ফের মিলিত হওয়া পাপ (9/61, 63)

    n      কিন্তু বিবাহ সংক্রান্ত মন্ত্রে কোথাও নিয়োগ’-এর উল্লেখ নেই। বিবাহ বিধায়ক শাস্ত্রে কোথাও বিধবা-বিবাহ’-এর কথা বলা হয়নি

    n      অথচ নিয়োগ প্রথা নিয়ে স্বয়ং মনুরই যে যথেষ্ট দ্বিধা ছিল, তার প্রমাণ এই কথায় ধরা পড়ে। তিনি বলছেন, পণ্ডিত দ্বিজগণ এই নিয়োগপ্রথা’-কে পশুধর্ম বলেছেন। এসব অধার্মিক বেনরাজার কীর্তি। উনিই কামের পরবশ হয়ে এসব শুরু করিয়ে পৃথিবীতে বর্ণসংকর’ (বাস্টার্ড) সৃষ্টি করেছিলেন (9/66, 67)

    স্বামী-স্ত্রী-নিয়োগ এসব নিয়ে ঢের হল। এবার খোদ বিবাহ নিয়েই মনুর বিধান নেড়েচেড়ে দেখা যাক। এতে অবধারিতভাবে জাতিভেদের প্রশ্ন উঠবে

     

    আরও পড়ুন: শববাহিনী গঙ্গা

     

    মনুবাদী ভাবনায় বিবাহ

    প্রথমে মেয়ে দেখা হোক

    n      নিজ বর্ণের সুলক্ষণা মেয়ে বিয়ে করা উচিত। যে কন্যা মাতার সপিণ্ড এবং পিতার সগোত্র নয়, সেই মেয়েই দ্বিজের (অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য, যার পৈতে হয়েছে) বিবাহে এবং মৈথুনে উপযুক্ত (3/4-5)

    n      কিন্তু স্বজাতেও বিয়ে করার ক্ষেত্রে নানা বাধা আছে। নীচের দশ রকমের পরিবারের মেয়ে আনতে নেই-

    o      যেসব পরিবার হীন কাজ করে, পুরুষসন্তান নেই, বেদপাঠহীন, শরীর লোমে ভরা, অর্শ, যক্ষ্মা, অ্যাসিডিটি, শ্বেতি বা কুষ্ঠরোগগ্রস্ত (3/7)

    o      যে মেয়ে কপিলবর্ণা, মানে যার গায়ের রঙ পাঁশুটে, হাত-পায়ে বেশি আঙুল, রোগী, লোমহীনা, বেশি লোম, বাচাল আর যাদের নামে নক্ষত্র, বৃক্ষ, নদী, পর্বত, পক্ষী, সর্প, দাস আছে বা ভীতিজনক নাম তাদের বিয়ে করা যাবে না

    এটা মানলে তো আমাদের ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় অবস্থা হবে (3/8-9)

    o      বিয়ে করবে এমন মেয়েকে যে অঙ্গহীন নয়, হংসগতি বা গজগামিনী, যার নাম ধরে সহজে ডাকা যায়, যার লোম ও কেশ কোমল, দাঁত ছোট, অঙ্গ মৃদু। (3/10)

    উঃ! যেন গোহাটে গরু কিনছে!

    o      যে মেয়ের ভাই নেই, পিতা কে জানা যাচ্ছে না, বিজ্ঞ ব্যক্তি তাকে বিয়ে করবে না কারণ কী জানি যদি সে তার কন্যাসমা হয়! (3/11)

    o      এক কন্যা বরকে দেখিয়ে অন্য কন্যা দান করলে এক শুল্ক দিয়েই পাত্র দুজনকেই বিয়ে করতে পারবে এই হল মনুর বিধান (8/204)

     

    n      প্রথম স্ত্রী তো নিজেদের বর্ণের হতে হবে। (প্রথম বিয়ে তো বংশরক্ষার জন্যে; পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা) কিন্তু কামবশে ফের বিয়ে করতে চাইলে কন্যার যোগ্যতা নীচে দেওয়া হল-

    o      ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী ও তিন বর্ণের মেয়েকে

    o      ক্ষত্রিয় ক্ষত্রিয়া এবং বৈশ্য ও শূদ্রের মেয়েকে

    o      বৈশ্য বৈশ্য ও শূদ্রের মেয়েকে

    o      শূদ্র- শুধু শূদ্রের মেয়েকে (3/12-13)

    n      কিন্তু ব্রাহ্মণের শূদ্র বউ নিয়ে মনুমহারাজের বড্ড অস্বস্তি ছিল। গোটা পাঁচেক শ্লোকে অমন বিয়ে করলে ব্রাহ্মণের কী কী ঝামেলা হতে পারে তা নিয়ে তিনি সতর্ক করেছেন। দুটো তুলে দিচ্ছি-

    o      ব্রাহ্মণ শূদ্রাকে শয্যায় নিলে অধোগতি প্রাপ্ত হয়। তাতে পুত্রোৎপাদন করলে ব্রাহ্মণত্বই চলে যায় (3/17)

    o      যে ব্রাহ্মণ শূদ্রার অধররস পান করেন, তার শ্বাস নিজের শ্বাসে যুক্ত করেন এবং  গর্ভে সন্তান উৎপাদন করেন, তাঁর শুদ্ধি হয় না (3/19)

    মেয়েও পছন্দ হল, এবার বিয়ে। কিন্তু বিবাহ যে আট রকম। কোনটা করব কীভাবে ঠিক হবে? ঠিক হবে বরের জাত দিয়ে

    বিবাহের প্রকারভেদ

    n      বিয়ে আট রকম- ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ। এর মধ্যে প্রথম চারটি (ব্রাহ্ম থেকে প্রাজাপত্য) ব্রাহ্মণের জন্যে, রাক্ষস ও গান্ধর্ব ক্ষত্রিয়ের জন্যে, বৈশ্য ও শূদ্রের জন্যে আসুর প্রশস্ত। পৈশাচ বিবাহ কারও করা উচিত নয়। (3/21, 24  25)

    n      কিন্তু কার নাম দুন্দুভি? কাকে বলে অরণি?

    o      ব্রাহ্ম- বিদ্বান চরিত্রবান পাত্রকে আহ্বান করে কাপড়চোপড় উপহার দিয়ে সম্মানিত করে কন্যাদান। (3/27)

    o      দৈব- যজ্ঞের সময় কাপড়ে গয়নায় সাজিয়ে গুছিয়ে কন্যাকে পুরোহিতের নিকট দান। (3/28)

    o      আর্য- বরের থেকে ধর্মার্থে একটি করে বৃষ ও গাভী নিয়ে কন্যাদান (3/29)

    o      প্রাজাপত্য- সোজা কথায় প্রজাপতির নির্বন্ধ।  দুজনে একত্র হয়ে ধর্মাচরণ কর বলে বরের পুজো করে কন্যাদান (3/30) আজকাল হিন্দুমতে এরকম বিয়েই আকছার হচ্ছে

    o      আসুর- বর যদি মেয়ের বাবা বা জ্ঞাতিদের যথাশক্তি ধন দিয়ে নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে। এটাও বহুদিন ধরে আমাদের দেশে চলে আসছে (3/31)

    o      গান্ধর্ব- গান্ধর্বঃ স তু বিজ্ঞেয়ো মৈথুনাঃ কামসম্ভবঃ।।‘ (3/32)

    কন্যা ও বরের ইচ্ছানুসারে মিলন, মনুর মতে এই বিবাহ কামবশে মৈথুনের ইচ্ছায় ঘটে! আজকাল এরকমও হচ্ছে বটে, যাকে আমরা হরদম লাভ ম্যারেজ বা প্রেম করে বিয়ে বলে থাকি

     

    o      রাক্ষস- কন্যাপক্ষের লোকজনকে আহত বা হত্যা করে, আর্তনাদ করতে থাকা কন্যাকে বলপূর্বক হরণ করে বিয়ে করা (3/33) এটা হামলা এবং ধর্ষণ, যেমন ডাকাত দলের কাণ্ড

    o      পৈশাচ- নিদ্রিতা, মদ্যপানে বিহ্বল বা পাগল কন্যাকে নির্জনে সম্ভোগ করলে সর্বাধিক পাপজনক ও নিকৃষ্ট বিয়ে (3/34) এটা অবশ্যই ধর্ষণ

    একটা জিনিস খেয়াল করার মতো। তখন বরকে কন্যাপণ দিতে হত, যদিও এই প্রথাকে মনু কয়েক জায়গায় গর্হিত এবং মেয়ের বাপের দিক থেকে এটা টাকার লোভে কন্যা বিক্রয় বলে নিন্দে করেছেন। কিন্তু লক্ষণীয় যে তখন আজকের মতো মেয়ের বাবাকে যৌতুক দিতে হত না

    অন্তত মনুস্মৃতি তাই বলছে। বিয়ে হয়ে গেল। এবার সন্তান জন্মের রহস্য জেনে নিন

     

    আরও পড়ুন: ত্রাসের দেশ উত্তরপ্রদেশ

     

    n      প্রথম চারপ্রকারের বিয়ের ফলে ভদ্রজনের মান্য বেদাধ্যয়ন করা তেজস্বী পুত্র হয় । রূপ, গুণ, যশ ও প্রচুর ভোগের অধিকারী হয় এবং তার একশ বছর আয়ু হয়। কিন্তু বাকি চারটে নিকৃষ্ট বিয়ের ফলে নিষ্ঠুর, মিথ্যেবাদী এবং বেদ ও যাগযজ্ঞের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন পুত্র জন্মায় (3/39,40, 41)

    n      শোণিতস্রাবযুক্ত প্রথম চার রাত্রি, একাদশ ও ত্রয়োদশ রাত্রি এবং অমাবস্যাদি মনুর বিধিতে নিন্দিত। বাকি সময়ে গৃহস্থ স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত হয়ে রতিকামনায় দারগমন করবেন (3/45, 46, 47)

    n      ওই প্রশস্ত রাত্রিগুলোর মধ্যে জোড় সংখ্যার রাতে, যেমন ষষ্ঠ ও অষ্টম, ছেলে হয় এবং বিজোড় সংখ্যার রাতে, যেমন পঞ্চম বা সপ্তম, মেয়ে। তাই ছেলে চাইলে জোড় সংখ্যার রাত্রিতে দারগমন করিবেন (3/48)

    n      পুরুষের শুক্র বেশি হলে পুত্র, স্ত্রীর শুক্র বেশি হলে কন্যা জন্মায়। দুজনেরই সমান সমান হলে জোড়া সন্তান বা হিজড়ে জন্মায়। কিন্তু দুজনের শুক্র খুব অল্প হলে গর্ভ হয় না (3/49)

     

    পাঠকদের মনে পড়বে যে মাত্র কবছর আগে সল্টলেকে এবং আরও দুয়েকটা জায়গায় হিন্দু বা বৈদিকশাস্ত্র মতে উত্তম মেধাবী সন্তান জন্মানোর গ্যারান্টি দিয়ে রীতিমতো ওয়ার্কশপ খোলা হয়েছিল, অবশ্য ভাল ফি নিয়ে। বেশ কিছু দম্পতি নাম লিখিয়েছিলেন যেমন পুত্রসন্তানের গ্যারান্টি পেয়ে অনেকে হাতুড়ে ডাক্তারের নার্সিংহোমে নাম লেখান। অনেক বাপ-মা চাইবেন যে তাঁদের সন্তান বিদ্যাদিগগজ মহাধনুর্ধর হয়ে উঠুক। তো বিশ্বাসীরা নিজেরা যদি বৃহদারণ্যক উপনিষদের পাতা ওল্টাতেন তো দেখতে পেতেন যে, এর জন্যে নানান ফর্মুলা তার ষষ্ঠ অধ্যায়ে দেওয়া আছে। তার একটি হল কালো বাছুর বা ষাঁড়ের মাংসের পলান্ন (বিরিয়ানি?) রন্ধন করে স্বামী-স্ত্রীর খেয়ে নেওয়া

    n      কন্যাপণ নেওয়া নিয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে। কোনও কোনও স্মৃতি এবং মেধাতিথির ভাষ্য যেন পণের পক্ষে; কিন্তু মনু বেশ কড়া

    o      কন্যার পিতা সামান্য শুল্কও নেবেন না, নইলে মেয়ে বিক্রয় করা হল। (3/51)

    o     আর্য বিবাহে যে গাইবলদ নেওয়ার প্রথা, তাকে পণ না বলে কেউ কেউ শুল্ক বলেন। ওটা মিথ্যা। পণ কম বা বেশি যাই হোক, নিলে মেয়ে বিক্রিই হল।’ (3/53)

    দেখাই যাচ্ছে, সে সময়ে ছেলের বাড়ি পণ নিত না, উল্টে ছেলের পরিবার মেয়ের বাবাকে দিত

    n     যত্র নার্য্যন্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ

      যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ।।” (3/56)

    যেখানে নারীগণ সম্মানিত হন, সেখানে দেবগণ প্রীত হন। এঁরা সম্মানিত না হলে সকল কর্ম নিস্ফল হয়

    মনুস্মৃতিতে নারীর কত উঁচু স্থান প্রমাণ করতে এই শ্লোকটি সর্বত্র উল্লেখ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর হিন্দুবিবাহ প্রবন্ধে মনুস্মৃতিতে ওই শ্লোক এবং মনুসংহিতায় আরও কয়েকটি শ্লোক উল্লেখ করে প্রাচীন কোড অব কন্ডাক্টে নারীকে উঁচু স্থানে বসানোর মিথকে কাটাছেঁড়া করেছেন

    এবার নারীরাই ভাবুন তাঁদের মর্যাদা কত উঁচুতে রেখেছে মনুর বিধান। আপনারাই আমার জুরি

     আই রেস্ট মাই কেস, মিলর্ড!

    1) মনুসংহিতা, সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূমিকার আগের পৃষ্ঠায়

    2) বাল্মীকি রামায়ণ, যুদ্ধকান্ড, অধ্যায় 6/103, বরোদা ওরিয়েন্টাল ইন্সটিটিউটের অনুমোদিত মূল সংস্কৃত থেকে বিবেক দেবরায়ের ইংরেজি অনুবাদ, পেঙ্গুইন বুকস

    3) ‘স্ত্রীর পত্র’; মৃণালের উক্তি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    4) সপিণ্ড মানে পিণ্ড দানের অধিকারী যেমন, (1) কোনও ব্যক্তির পিতার থেকে ঊর্ধ্বতন (ঠাকুরদা, তার বাবা এইভাবে) ছয় পুরুষ, মানে 7 জন তার সপিণ্ড এবং নিজের থেকে অধস্তন (ছেলে, নাতি, তার সন্তান এইভাবে ছয় প্রজন্ম) ছয় পুরুষ, মানে 6 জন তার সপিণ্ড এভাবে সে উপরের পিতা  আরও ছয় জনের পিণ্ডদানের অধিকারী এবং তার ছেলেকে ধরে নীচের ছয়জন তার উদ্দেশ্যে পিণ্ডদানের অধিকারী (2) কিন্তু মায়ের দিক থেকে উর্ধ্বতন চার পুরুষ এবং মায়ের অধস্তন চার পুরুষ তার সপিণ্ড

     


    রঞ্জন রায় - এর অন্যান্য লেখা


    মনু যাদের পূজ্য তাদের পক্ষে জন্মভিত্তিক জাতিভেদের উপরে ওঠা অসম্ভব।

    নারীদিবস বছরে একদিন কেন? এটা আলাদা করে পালন করার দরকার কী? কই, ঘটা করে পুরুষদিবস তো হয় না!

    অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের জমি কেনা নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির তদন্ত কি আদৌ হবে?

    এই বিপুল সংখ্যক মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে বলে দাবি করা হচ্ছে সরকারের পক্ষে থেকে।

    হারামজাদাদের কি কোনও উদ্ধার নেই?

    হাসবেন না; এটা সত্যি ভাববার কথা। এই সব গান-টানের পেছনে ঘাপটি মেরে থাকা গভীর চক্রান্তের হদিশ পাওয়া যা

    নারীকে ‘রাখা হবে’ কোথায়: বিশ একুশে মনুসংহিতা (2) -4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested