কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠন মিলিত ভাবে বীরভূমের জেলাশাসকের কাছে গত 6 ডিসেম্বর দেউচা পাঁচামির প্রস্তাবিত কয়লা খনি সংক্রান্ত একটি স্মারকলিপি জমা দেয়। বীরভূম জেলার মহম্মদবাজার ব্লকের দেউচা পাঁচামি অঞ্চলে এশিয়ার সর্ববৃহৎ কয়লা খনির সন্ধান পাওয়া গেছে। এই কয়লাখনি নিয়ে যথারীতি উন্নয়নের ঢক্কানিনাদ শুরু হয়ে গেছে, রঙিন ভবিষ্যতের আষাড়ে গল্পের ফেরিওয়ালারা আবার ময়দানে নেমে পড়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই সংগঠনগুলির প্রতিনিধিরা দাবি করেন যে, 2013-র জমি অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জনসমক্ষে আনতে হবে। প্রকল্পের বিরুদ্ধে সরব হওয়া প্রতিবাদকারীদের উপর থেকে সরকারকে মামলা তুলে নিতে হবে, এবং সর্বোপরি ‘বিপর্যয়কর’ হওয়ার কারণে প্রকল্পটিকে বাতিল করতে হবে।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে জেলাশাসক জানান, জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে না, জমি কেনা হচ্ছে। সুতরাং অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ করার প্রশ্ন আসছে না। প্রতিনিধিরা পাল্টা প্রশ্ন করেন, অধিগ্রহণ যখন হচ্ছে না, তা হলে পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হচ্ছে? জেলাশাসক এর কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। একই ভাবে গ্রামবাসীদের উপর থেকে মামলা কেন তুলে নেওয়া হচ্ছে না সেটারও কোনও জবাব তিনি দিতে পারেননি। স্পষ্টই বোঝা যায় প্রশাসন এই প্রকল্প সম্পর্কে নিজেরাই বিভ্রান্ত।
স্থানীয় প্রশাসন ও এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন মানুষজনদের নিয়ে গত 20 নভেম্বর রাজ্য সরকার একটা সভা করে। সভাটি বিতর্কিত, কারণ বহু মানুষের অভিযোগ যে এখানে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ মানুষদেরই শুধু ডাকা হয়েছে, সম্ভাব্য প্রতিবাদকারীদের সভা সম্পর্কে কোনও খবরই দেওয়া হয়নি। প্রশাসন বলছে জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে না, কিন্তু এই সভায় পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের প্যাকেজের খতয়ান সংবলিত কাগজ বাংলা ও সাঁওতালি ভাষায় বিলি করা হয়। নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। যেমন: (1) যাঁদের জমি নেওয়া হবে তাঁদের পরিবারের এক জনকে জুনিয়র কনস্টেবলের চাকরি দেওয়া হবে। (2) বিঘা প্রতি 10-13 লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। (3) 600 বর্গফুটের বাড়ি দেওয়া হবে ও স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য অতিরিক্ত 1.2 লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। (4) পাথর ভাঙার কাজ যাঁরা করেন তাঁদের এককালীন 50,000 টাকা ও এক বছর প্রতি মাসে 10,000 টাকা দেওয়া হবে। (5) কৃষি শ্রমিকদের এককালীন 50,000 টাকা এবং জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পে 500 দিনের কাজ দেওয়া হবে। (6) পাথর ভাঙার সংস্থাগুলিকে প্রকল্পক্ষেত্রের কাছে একটি পার্কে পুনস্থাপিত করা হবে।
গ্রামবাসীদের অনেক প্রশ্ন, সংশয়। যেমন (1) বহু মানুষের জমির দলিল বা যথাযথ নথি নেই, তাদের কী হবে? জেলাশাসক জমির প্রকৃত মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। কথা হচ্ছে ‘প্রকৃত মালিক’ন কে, তা কী ভাবে যাচাই হবে? তাই এই ধোঁয়াটে আশ্বাসে গ্রামবাসীরা বিশ্বাস রাখতে পারছেন না। (2) পরিবারে এক ভাই পুলিশের চাকরি পেলে অন্যদের কী হবে? (3) গ্রামবাসীরা মূলত অশিক্ষিত, কেউ বড়জোর ক্লাস এইট পাস, তাঁরা কী করে এই প্রকল্পে চাকরি পাবেন? (4) অনেকের বড় পরিবার, 600 বর্গফুট ঘরে তাদের কী হবে? (5) সর্বোপরি গ্রামবাসীরা বলছে, ধর্মীয় ও সংস্কৃতিগত ভাবে এই জমি, ভূমির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য, কয়েক প্রজন্ম ধরে তা অব্যাহত, এই জায়গা ছেড়ে তারা কোথায় যাবে? তারা বলছে আমাদের যা আছে, তাতেই আমরা সন্তুষ্ট, এখান থেকে অন্যত্র আমরা যেতে চাই না।
বহু আগে থেকেই দেউচা পাঁচামি নিয়ে সরকার মিথ, স্বপ্নের ফানুস নির্মাণ করার চেষ্টা করছে। তারা বলছে এখান থেকে প্রাপ্ত বিপুল কয়লার কারণে বিদ্যুতের দাম কমবে। দ্বিতীয়ত, বিদ্যুতের জোগান বৃদ্ধির ফলে রাজ্যে উন্নয়নের জোয়ার আসবে। তৃতীয়ত, এই প্রকল্পকে ঘিরে বহু শিল্প, কারখানা গড়ে উঠবে, যা নতুন চাকরি তৈরি করবে। চতুর্থত, সরকার আশ্বাস দিচ্ছে যে পরিবেশজনিত যে ক্ষতি হবে, তা বৃক্ষরোপণ এবং অন্যান্য পরিবেশ-বান্ধব কর্মসূচি দ্বারা পুষিয়ে দেওয়া হবে। পঞ্চমত, তারা দাবি করছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য সেরা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে।
রাজ্যের বিশিষ্টজনেরা সরকারের এই দাবিগুলি খণ্ডন করেছেন। তাঁরা বলছেন, দেউচাতে কয়লার অবস্থান মাটির অনেক নীচে। মাঝে রয়েছে ব্যাসল্ট পাথরের পুরু স্তর। এই পাথরের স্তর ভেদ করে কয়লা উত্তোলন করতে হবে, যা যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের পুরো ভারটা গ্রাহকদের ঘাড়ে এসে পড়বে। যার ফলে বিদ্যুতের দাম তো কমবেই না, বরং বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া প্রশ্ন জাগে, রাজ্যে তো বর্তমানে বিদ্যুৎ ঘাটতি নেই, বরঞ্চ তা অতিরিক্ত, তা হলে এখন নতুন শিল্প সৃষ্টি হচ্ছে না কেন? পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ হলেই প্রচুর শিল্প হবে এবং হুড়হুড় করে কর্মসংস্থান বাড়বে এটা আর একটি অতিকথন। এ ছাড়া শিল্প নিয়ে যে সাবেক ধারণা আছে সেটা বাতিল করার সময় পেরিয়ে গেছে। শিল্প হলেই অনেকে চাকরি পাবে, আজকের যুগে এই ভাবনা হাস্যকর!
আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্সের যুগে শিল্প হলেই প্রচুর কর্মসংস্থান হবে, এটা যাঁরা বলছেন হয় তাঁরা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যে গুণগত পরিবর্তন ঘটে গেছে সেটা ধরতে পারছেন না, নয় তাঁরা মানুষকে স্রেফ ভাঁওতা দিচ্ছেন। বিপুল যান্ত্রিকীকরণের ফলে শিল্পে আজ মনুষ্য শ্রমের প্রয়োজনীয়তা সামান্য মাত্র। তাই শিল্প হলেই চাকরি হবে এটা একটা ডাহা মিথ্যা। কয়লা উত্তোলনের কাজে দৈহিক শ্রমের প্রয়োজন আছে, কিন্তু খনন কাজের জন্য একটা বিশেষ দক্ষতারও দরকার আছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি এই কাজের বরাত পাবে; নবান্নে ইতিমধ্যেই তাঁদের লাইন পড়ে গেছে। তাঁরা এই ধরনের দক্ষ শ্রমিকই নিয়োগ করবে। দেউচাতে যেহেতু বেশির ভাগ মানুষই পাথর ভাঙা বা কৃষিকাজে যুক্ত, তাঁদের কয়লা উত্তোলনের কাজের পক্ষে উপযুক্ত না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি; তাই এই প্রকল্প হলেই তাঁদের কর্মসংস্থান হবে এটাও একটা ফাঁকা প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছু নয়।
আরও পড়ুন: দেউচায় বিক্ষোভ, আদিবাসীরা নারাজ ভিটে ছাড়তে
পরিবেশগত ভাবে এই অঞ্চলের যা ক্ষতি হবে তা অপূরণীয়। এই খনি এলাকা 11,222 একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, যার মধ্যে 9,100 একর আদিবাসী অধ্যুষিত। বলা হচ্ছে 11টি গ্রামের 10,000 মানুষকে উচ্ছেদ করা হবে, আরও 53টি গ্রামের 70,000 মানুষ নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এমনিতেই পাথর খাদানের কারণে এই অঞ্চলের জলবায়ু বিষাক্ত। পানীয় জল দূষিত। চারপাশ ধূসর, সবুজের ছিঁটেফোঁটা চোখে পড়ে না, সর্বত্র পুরু ধুলোর স্তর, যার মধ্যেই আবালবৃদ্ধবনিতা জীবন অতিবাহিত করছেন। প্রায় প্রত্যেকেই নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত— হাঁপানি, যক্ষ্মা, ব্রঙ্কাইটিস, ক্রনিক জ্বরকাশি, ফুসফুস ও পেটের নানা অজানা অসুখ। এর উপরে যদি এই প্রকল্প হয়, তা হলে এলাকার পরিবেশ অবর্ণনীয় হয়ে দাঁড়াবে। খোলা মুখ বা মাটির নীচে খনন যেটাই হোক না কেন, সেটার ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে জমে থাকা মাটির বিভিন্ন স্তর উপড়ে ফেলা হবে। প্রকৃতি বিদীর্ণ করে যে মৃত্তিকা উদগিরীত হবে, তা নদী নালা রুদ্ধ করে দেবে, জমি মাটির আস্তরণে ঢেকে যাবে, অনুর্বর হয়ে যাবে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে, বহু গাছপালা, উদ্ভিদ, কীটপতঙ্গ চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মানুষের সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকাই অসম্ভব হয়ে যাবে। যাঁরা বলছেন যে এই ক্ষতি শুধু বৃক্ষরোপণ করে শুধরে দেওয়া যাবে, তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন।
স্বভাবতই প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু হয়ে গেছে, যার সর্বাগ্রে আছেন এলাকার মানুষেরা, বিশেষ করে নারীরা। প্রধান বিরোধী দলগুলি জল মাপছে। বিজেপি বলছে তারা নীতিগত ভাবে শিল্পের পক্ষে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, কারণ আমরা জানি তাদের টিকি কর্পোরেট কেষ্টবিষ্টুদের সঙ্গে বাঁধা আছে এবং তারা চায় খননের বরাত যেন তাদের পরমপ্রিয় আদানি গোষ্ঠী পেয়ে থাকে। তারা শুধু ইনিয়ে বিনিয়ে আরও উন্নত প্যাকেজ এবং পরিবেশ রক্ষা ইত্যাদি বাঁধা বুলি আওড়াচ্ছে। সিপিএম কিছুটা ফাঁপরে, কারণ তারা তো এখনও ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’-এর সেই বাঁধা গত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তারা এখনও বুঝতেই পারছে না যে উৎপাদন শিল্প লুপ্ত হওয়ার মুখে, এমনকি পরিষেবা শিল্পে যান্ত্রিকীকরণের ফলে কর্মী সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। যে কোনও ব্যাঙ্কের একটি শাখা দেখলেই বোঝা যাবে যে, কর্মীর সংখ্যা পাঁচ বছরের আগের থেকে অর্ধেক হয়ে গেছে। নতুন নিয়োগ প্রায় নেই। স্থায়ী চাকরি হ্রাস পাচ্ছে; ক্যাজুয়াল, অস্থায়ী, চুক্তি শ্রমিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। কর্মসংস্থানের ভরকেন্দ্র অর্থনীতির অন্যত্র সরে গেছে। আগামী কয়েক বছরে সেটা যে কী রূপ ধারণ করবে সেটা কেউ এখনও ভেবে উঠতে পারছে না। তাই তারা আদিবাসীদের উপর পুলিশি সন্ত্রাসের বিরোধিতা করছে, পরিবেশ রক্ষার কথা বলছে, কিন্তু পুরনো চিন্তাতেই নিমজ্জিত থাকার ফলে প্রকল্প বাতিল করতে হবে, সেটাও সরাসরি বলতে পারছে না।
সুতরাং, এই ভয়ঙ্কর প্রকল্পের বিরোধিতায় এগিয়ে এসেছে সিপিআই (এমএল)-এর মতো কিছু ছোট দল, গোষ্ঠী ও বিভিন্ন মানবাধিকার ও গণসংগঠন। এলাকার মানুষ তাদের সাহায্য করছে, নেতৃত্ব দিচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী বলছেন দেউচা পাঁচামিকে তিনি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম হতে দেবেন না, কিন্তু এখানেও একই কায়দায় ধমক চমকের খেলা শুরু হয়ে গেছে। বাইকে করে শাসক দলের বাহিনী এলাকায় টহল দিচ্ছে, যাঁরা প্রতিবাদ করছেন তাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাঁদের উপর বিভিন্ন মামলা চাপানো হচ্ছে। সিঙ্গুরের মতো এখানেও ইচ্ছুক-অনিচ্ছুকের গল্প শুরু হয়ে গেছে। প্রশাসন মাঝেমধ্যেই কত লোক জমি দিতে ইচ্ছুক, তার তালিকা ঢাক পিটিয়ে প্রচার করছে এবং এলাকায় বিভাজন সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। সরকার যদি এর পরেও জনমতকে উপেক্ষা করে, পেশীশক্তির প্রয়োগ করে প্রকল্প বিরোধী আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করে, তা হলে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পরবর্তী ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
প্রশাসক প্যাটেলকে দিয়ে মুসলিম প্রধান লক্ষদ্বীপের স্বাতন্ত্র্য ধ্বংস করতে চায় বিজেপি।
এটা পরিষ্কার কেন্দ্রীয় সরকার করোনা মহামারীর সুযোগ নিয়ে সমস্ত বিরোধী স্বর স্তব্ধ করার চেষ্টা করছে
শেষ পর্যন্ত এবারের ভোটে মুসলিম ভোট বাংলায় মমতার ঝুলিতেই যাবে।
জনজীবনকে ধ্বংস করে উন্নয়নের মোড়কে দেউচা পাঁচামিকে পুঁজিপতিদের মুক্তাঞ্চল করতে চাইছে তৃণমূল সরকার।
শাসকের সদ্ভাবনা অসম্ভব, সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞাই অপ-প্রযুক্তি দমনের পথ।
বিচারব্যবস্থার সরকারের অনুগত হয়ে পড়াটাই ভয়ঙ্কর বিপদ