×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • লক্ষদ্বীপকে আরেকটি কাশ্মীর বানানোর চাল

    সোমনাথ গুহ | 03-06-2021

    প্রতীকী ছবি

    সেভ লাক্ষাদ্বীপ নামে সোশল মিডিয়ায় ইদানিং একটি প্রচার দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিজেপি দেশের মূল ভূখণ্ডের চারপাশে যে ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জগুলো আছে, সেগুলির হিন্দুত্বকরণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। লাক্ষাদ্বীপ যা তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীববৈচিত্র্যর জন্য পরিচিত, সেখানে এখন জোরদার হিন্দুত্বের প্রকল্প শুরু হয়েছে। এই দ্বীপপুঞ্জের জনসংখ্যা মোটে 65,000 এবং সব দ্বীপগুলি নিয়ে এর আয়তন সর্বসাকুল্যে 32 মাইল। এখানকার মানুষ শিক্ষিত। শিক্ষার হার প্রায় 92 শতাংশ, মহিলাদের ক্ষেত্রে 96.5 শতাংশ জনসংখ্যার প্রায় 96 শতাংশ মুসলিম। মাছ ধরা এবং নারকেলের উৎপাদন এখানকার মানুষের প্রধান জীবিকা। টুনা মাছ প্রধান রফতানিযোগ্য পণ্য 2020-র ডিসেম্বর মাসে বিজেপির প্রফুল খোদা প্যাটেল এখানে প্রশাসক নিযুক্ত হন। ইতিপূর্বে আইএএস বা আইপিএস অফিসারদের এই দ্বীপগুলির প্রশাসক নিয়োগ করা হত। কিন্তু 2016 থেকে এই পদগুলিতে বিজেপি নেতাদের নিয়োগ করা শুরু হয়েছে এবং পুরোদমে হিন্দুত্বের চাষ শুরু হয়ে গেছে। প্রসঙ্গত শ্রী প্যাটেল দমন  দিউ এবং দাদরা  নগর হাভেলিরও প্রশাসক। 2010 সালে তিনি গুজরাতে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, যখন নরেন্দ্র মোদী ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। দমন  দিউতে নিযুক্ত হওয়ার পরেই তিনি সেখানে উন্নয়নের নামে জেলেদের ঝুপড়ি উচ্ছেদ করেন। এর প্রতিবাদে প্রবল বিক্ষোভ শুরু হয়। তিনি 144 ধারা জারি করে সবাইকে গ্রেপ্তার করেন এবং জেলে স্থান সংকুলান হওয়ার কারণে অভিযুক্তদের বিভিন্ন স্কুলে ঢুকিয়ে দেন। তাঁদের জমি, ক্ষতিপূরণ কিছুই দেওয়া হয় না উল্টে তিনি সবাইকে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় ঋণ নিয়ে বাড়ি করার নিদান দেন। এই হল গিয়ে এই ব্যক্তির পরিচয়।

     

     

    প্রথমেই তিনি লাক্ষাদ্বীপের কোভিড বিধি পাল্টে দেন। আগে নিয়ম ছিল সেখানে পৌঁছেই টেস্ট করাতে হত ও নিভৃতবাসে থাকতে হত। এর ফলে দ্বীপে কোভিড কেস ছিল শূন্য। প্যাটেল নিভৃতবাস তুলে দেন। এখন সেখানে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা 6884 এবং মৃত্যু 24এটা দ্বীপবাসদের কাছে তাঁর প্রথম উপহার! এরপর তিনি পরপর কতগুলি পদক্ষেপ নেন, যেগুলির ওপর চোখ বোলালে তাঁকে আধুনিক যুগের মহম্মদ বিন তুঘলক বলা যেতে পারে। (1) ‘লাক্ষাদ্বীপ ডেভেলপমেন্ট অথরিটি রেগুলেশন, 2021’ নামে একটি খসড়া বিল প্রস্তুত করেন। এর ফলে সরকার যে কোনও উন্নয়নমূলক কাজের জন্য স্থানীয় মানুষের জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে। যার জমি অধিগৃহীত হবে তিনি আইনের কোনও সাহায্য নিতে পারবেন না যার ফলে তাঁর নিজের জমি উদ্ধার করার কোনও রাস্তাই তার কাছে আর খোলা থাকবে না। মনে করা হচ্ছে এটা করে কর্পোরেটরা যাতে অনায়াসে এখানে জমি কিনতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই খসড়ার ওপর 31 মে-র মধ্যে মতামত চাওয়া হয়েছে। এই খসড়ার বিরুদ্ধে স্থানীয়রা ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। (2) তিনি এমন একটা রাজ্য থেকে এসেছেন, যেখানে মদ্যপান নিষিদ্ধ, এমনকি মদের ব্যবসা করাও বেআইনি। অথচ তিনি এই দ্বীপে এসে ঢালাও মদের লাইসেন্স দেওয়া শুরু করেন। আগে শুধুমাত্র একটি রিসর্টে মূলত পর্যটকদের জন্য মদ্যপান বৈধ ছিল। দ্বীপের জনসংখ্যা প্রধানত মুসলিম এবং এখানকার বাসিন্দারা মদ্যপান সংক্রান্ত বিষয়ে রক্ষণশীল হওয়ার কারণে, প্রশাসনের এই পদক্ষেপ মানুষের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে প্রবলভাবে আঘাত করেছে (3) তিনি অ্যানিম্যাল প্রিজারভেশন বিল, 2021’ প্রণয়ন করেন, যার দ্বারা গো-হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়। ছাত্রছাত্রীদের জন্য মিড-ডে মিলেও গো-মাংস নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। অথচ গো-মাংস এখানকার মানুষের প্রধান খাদ্য। গরু, বাছুর, ষাঁড়, মহিষ ইত্যাদি মাংস গুদামজাত করা, সরবরাহ ও বিক্রি করা অনেকের জীবিকা এই বিলের ফলে অনেক মানুষ তাঁদের জীবিকা হারাবেন। (4) তিনি পঞ্চায়েত আইনে এমন পরিবর্তন আনেন, যা হাস্যকর- দুটির বেশি সন্তান আছে এমন কেউ পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থ হতে পারবেন না। সংসদে এই আইন চালু হলে অন্তত 94 জন সাংসদ পদ হারাবেন। (5) লাক্ষাদ্বীপে অপরাধের হার প্রায় শূন্য। অথচ উনি এখানে একটা গুন্ডা দমন আইন চালু করতে চাইছেন, যেটাকে অনেকে মিনি ইউএপিএ বলছেন। এতে যে সমস্ত বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলি শুধুমাত্র অপরাধপ্রবণ এলাকার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু এত কঠোর আইন কেন? মনে করা হচ্ছে ভবিষ্যতে যাতে জমি অধিগ্রহণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে কোন প্রতিবাদ সংগঠিত না হতে পারে, সেটার জন্যই এই ব্যবস্থা। (6) বিভিন্ন এলাকায় জেলেদের ঝুপড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। এঁদের কোনও ক্ষতিপূরণ বা বিকল্প জমি দেওয়া হবে না। (7) রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য প্রচুর গাছ কাটা হচ্ছে। তিনি এখানে একটা স্মার্ট সিটি বানাতে চাইছেন। কর্পোরেটদের আকৃষ্ট করতে চাইছেন, যাতে লাক্ষাদ্বীপকে মরিশাস করে তোলা যায়।

     

     

    খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই সমস্ত পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ সরব হন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং স্থানীয় সাংসদ মহম্মদ ফয়জল রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিবাদ জানাদ্বীপপুঞ্জের সাংসদ অভিযোগ করেন যে, প্রশাসক এইসব পদক্ষেপ নেওয়ার আগে কার সঙ্গে কোনও আলোচনা করেননি। সর্বোপরি দ্বীপের বিজেপি প্রধান মহম্মদ কাসিমও এই প্রতিবাদে সামিল হন। বিজেপির মধ্যে এই প্রশ্নে স্পষ্টতই দুটি ভাগ। স্থানীয় আর এক বিজেপি নেতা এপি আবদুল্লাহ কুট্টি তোতাপাখির বুলি আওড়াচ্ছেন, বলছেন এসবই বিরোধীদের চক্রান্ত, রাজনৈতিক কারসাজি, প্রশাসক যা করছেন তা এলাকার উন্নয়নের জন্যই করছেন। দিল্লির নেতারাও তাঁর কথায় সুর মেলাচ্ছেন। এবং অবাক হবেন না এটা শুনে যে, ইতিমধ্যেই দুএকটি দ্বীপে রাষ্ট্রদ্রোহ কাজকর্ম হচ্ছে এমনও অভিযোগ উঠে গেছে!

     

     

    এটা মোটামুটি ধরে নেওয়া যায় যে, প্রধানমন্ত্রী বা বিজেপি নেতৃত্ব বিরোধীদের অভিযোগে কোনও কর্ণপাত করবেন না। এটা পরিষ্কার যে এই পদক্ষেপগুলি হিন্দু রাষ্ট্র প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এর জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা খর্ব করা এবং দিল্লি থেকে মনোনীত প্রতিনিধির ক্ষমতা বৃদ্ধি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটা শুরু হয়েছে জম্মু কাশ্মীর ভাগ করে যখন দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল করে দেওয়া হয়। জম্মু কাশ্মরে সরকার হলেও সেটি সেখানকার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে থাকবে। একই পদক্ষেপ নেওয়া হল দিল্লির ক্ষেত্রে, সেখানে অরবিন্দ কেজরিওয়াল এখন পুতুল মুখ্যমন্ত্রী, যে কোনও ব্যাপারে গভর্নর তাঁকে ভেটো করতে পারেন। 2016 থেকেই ছোট কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোতে আমাদের অজান্তে বিজেপি নিজেদের ক্ষমতা কায়েম করা শুরু করেছে। এর পিছনে হিন্দু রাষ্ট্র গড়ে তোলা যদি একটা উদ্দেশ্য হয় তো, আর কটা উদ্দেশ্য হল সেখানে কর্পোরেটদের ঘাঁটি গাড়ার পাকাপোক্ত রাস্তা করে দেওয়া। দৃশ্যতই বিজেপি শাসন আর একটি মহামার, এখন যদি আমরা সতর্ক না হই আর কবে হবে?


    সোমনাথ গুহ - এর অন্যান্য লেখা


    শাসকের সদ্ভাবনা অসম্ভব, সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞাই অপ-প্রযুক্তি দমনের পথ।

    দেশের গরিব মানুষের খাবার নেই, দুর্বলের অবস্থা আরও খারাপ, সেই খবর প্রকাশেও বাধা

    হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির গণহত্যার আহ্বানে সরকার নীরব থাকলে নাৎজি জার্মানির স্মৃতি ফিরে আসতে বাধ্য।

    গুজরাতে ধর্ষণকারীদের মুক্তি দিয়ে বিজেপি-র স্বাধীনতার অমৃত পান

    প্রশাসক প্যাটেলকে দিয়ে মুসলিম প্রধান লক্ষদ্বীপের স্বাতন্ত্র্য ধ্বংস করতে চায় বিজেপি।

    বইটির প্রকাশনা থেকে ব্লুমসবেরির সরে যাওয়া তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করে।

    লক্ষদ্বীপকে আরেকটি কাশ্মীর বানানোর চাল-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested