×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • রাজনীতির হরিবোলে অলক্ষ্যে রয়ে যান হরিচাঁদ

    বিতান ঘোষ | 05-04-2022

    নিজস্ব ছবি

    সপ্তাহের মধ্যে উপরি একটা ছুটি পেয়ে কচিকাঁচার দল উল্লসিত। স্কুল-ফেরত সেই কচিকাঁচাদের মুখেই শোনা গেল, জনৈক হরিচরণের জন্মদিনে নাকি মুফতে একটি ছুটি মিলেছে। কিন্তু কে এই হরিচরণ, বঙ্গীয় শব্দকোষ প্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি? না, প্রায় সমনামী হলেও, ইনি হরিচাঁদ ঠাকুর (Harichand Thakur)মতুয়া (Matua) ধর্মগুরু। যাঁর জন্মদিনে গত 30 এপ্রিল রাজ্য সরকার সমস্ত সরকারি স্কুল, কলেজে ছুটি ঘোষণা করেছিল। কিন্তু যাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এই ছুটির আয়োজন, তাঁর সম্পর্কে ন্যূনতম পড়াশোনা নেই কারও? স্বয়ং রাজ্যপাল পর্যন্ত হরিচাঁদকে "হরিচন্দ্র' করে ফেললেন!

     

    ইতিহাসের গলিপথ দিয়ে একটু পিছন ফিরে হাঁটলে দেখা যাবে, বাঙালির প্রচলিত সমাজ, সাহিত্য কিংবা সংস্কৃতিতে হরিচাঁদ, তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ এবং মতুয়া আন্দোলনের কথা প্রায় অনুল্লিখিতই থেকে গেছে। অথচ উপমহাদেশের এতবড় একটি দলিত ও মূলবাসী আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেওয়ার পরেও উপেক্ষার অন্তরালে রয়ে গেছেন হরিচাঁদ।

     

    হরিচাঁদের পূর্বপুরুষেরা খুব সম্ভবত বৈষ্ণব ছিলেন। কিন্তু আদতে "বিশ্বাস' পদবীধারী নমঃশূদ্র হরিচাঁদের পরিবারকে উচ্চবর্ণ প্রধান গ্রামে কার্যত একঘরে হয়েই থাকতে হত। হরিচাঁদের পিতা যশোমন্ত বিশ্বাস হরিচাঁদের ঠাকুরদার উপাধি হিসাবে পাওয়া 'ঠাকুর' উপাধিকে পদবী হিসাবে ব্যবহার করতে থাকেন।

     

    গ্রামের উচ্চবর্ণের হিন্দুদের চোখে এই নমঃশূদ্ররা ছিলেন চন্ডাল, অপভ্রংশে চাঁড়াল— যাঁদের ছায়া মাড়ানোও পাপ হিসাবে গণ্য হত। অথচ পেশাগত ঐতিহ্য অনুসারে কর্মঠ কৃষিজীবী হিসাবে অবিভক্ত বাংলার অর্থসম্পদের একটা বড় অংশে অবদান ছিল এই নমঃশূদ্রদের। হরিচাঁদ এই সামাজিক, অর্থনৈতিক শোষণের বিপ্রতীপে নমঃশূদ্র শ্রেণীকে একজোট করলেন, দিলেন নতুন দিশা। তবে নিছক কোনও ধর্মাশ্রয়ী আন্দোলন দিয়ে মতুয়া সমাজের মুক্তি খোঁজেননি তিনি, বরং আর্থ-সামাজিক মানদণ্ডে পিছিয়ে পড়া এই সমাজের সার্বিক উন্নতিই ছিল হরিচাঁদের লক্ষ্য। হরিচাঁদের অসম্পূর্ণ কাজকে পূর্ণতা দিয়েছিলেন তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ এবং পৌত্র প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর।

     

    আরও পড়ুন:হাউ হাউ করে কাঁদছে গো হাই হাই কোর্ট!

     

    হরিচাঁদের ব্যক্তিগত দর্শন এবং ধর্মদর্শন উভয়ই ছিল তীব্র ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী। "ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা'র মতো বৈদিক দর্শনকে তিনি প্রত্যাখান করেছিলেন। দেশভাগের পর হরিচাঁদদের পুরনো সাকিন, বর্তমান বাংলাদেশের ওড়াকান্দি থেকে মতুয়া সমাজ যখন প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের হাত ধরে এপার বঙ্গে এল, তখন তাঁদের রাজনৈতিক চেতনাও প্রখর। তবে সমাজের অন্দরেও ভাঙন এসেছিল। মতুয়া সমাজের উল্লেখযোগ্য নেতা যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল আম্বেদকরের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কংগ্রেসের প্রতি বিরাগভাজন হয়ে মুসলিম লিগের হাত ধরে পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা অবশ্য তাঁর জন্য খুব একটা সুখকর হয়নি। অন্যদিকে প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর মতুয়া সমাজের উন্নতির লক্ষ্যে নেহরু এবং কংগ্রেসের ওপরেই ভরসা রেখেছিলেন, কংগ্রেসের সদস্য হিসাবে সাংসদও নির্বাচিত হয়েছিলেন।

     

    মালিকানাহীন জমির পাট্টা বিলি, ভূমি সংস্কারের মতো কর্মসূচীর মাধ্যমে এই রাজ্যের বাম সরকার মতুয়াদের মন জয় করতে সক্ষম হয়। আবার প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের স্ত্রী বীণাপানি দেবী (বড় মা নামে সমধিক পরিচিত)-র "আশীর্বাদ'-কে পাথেয় করে, রাজ্যের বর্তমান শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস ক্রমে মতুয়া ভোটে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে। বীণাপানি দেবীর বড় ছেলে কপিলকৃষ্ণ সেই সময় ছিলেন বাম মনোভাবাপন্ন, আর ছোট ছেলে মঞ্জুলকৃষ্ণ তৃণমূলের সক্রিয় সমর্থক ও কর্মী। রাজনীতির পাশা খেলায় এখন প্রয়াত কপিলকৃষ্ণের স্ত্রী, প্রাক্তন সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর তৃণমূলের হয়ে মতুয়া ঠাকুরবাড়ি সামলাচ্ছেন আর মঞ্জুলকৃষ্ণের ছেলে শান্ত্বনু ঠাকুর বিজেপির সাংসদ!

     

    উত্তর 24 পরগণার ঠাকুরনগর এই রাজ্যের মতুয়াদের ধাত্রীভূমি। এই রাজ্যের কোনও রাজনৈতিক দলই মতুয়াদের এড়িয়ে যেতে পারেনা, কারণ উত্তর 24 পরগণার 33টি, নদীয়া জেলার 17টি এবং দক্ষিণ 24 পরগণার প্রায় 31টি বিধানসভা কেন্দ্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জয় পরাজয় নির্ধারণ করেন মতুয়ারা। তাই মতুয়াদের মন জয় করতে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি সেই বাম আমল থেকে খোদ ঠাকুরবাড়িকেই যুযুধান দু'টি শিবিরে ভাগ করে দিয়েছে।

     

    আরও পড়ুন:অ্যাক্টিভ নয় প্যাসিভ— মুখ্যমন্ত্রীর ভয়েস পরিবর্তন জরুরি!

     

    2019-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বলছে, সেবার মতুয়া ভোটের সিংহভাগ অংশ তৃণমূলের থেকে বিজেপি শিবিরে গিয়ে ভিড়েছিল। এর পিছনে নয়া নাগরিকত্ব আইন (CAA) নিয়ে বিজেপির আগ্রাসী প্রচার এবং "শরণার্থী' মতুয়াদের নতুন করে নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছিল। 2021-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি সেই পুরনো অস্ত্রেই শাণ দিতে চেয়েছিল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঠাকুরনগরে ভোট প্রচারে এসে বলেছিলেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই নয়া নাগরিকত্ব আইন কার্যকর করা হবে। পরে অবশ্য নয়া নাগরিকত্ব আইন নিয়ে আপাতত পিছু হাঁটারই ইঙ্গিত দেয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। আর তৃণমূলের তরফে বলা হয়, মতুয়ারা ইতিমধ্যেই এই দেশের নাগরিক, কেউ কেউ জনপ্রতিনিধিও বটে। নাগরিকত্ব দেওয়ার নামে মতুয়াদের আদতে ঠকানো হচ্ছে। পালটা এই প্রচারে ফল-ও মেলে। তফসিলি জাতি সংরক্ষিত আসনগুলি বাদে উত্তর 24 পরগণা ও নদীয়ার প্রায় সব মতুয়া অধ্যুষিত বিধানসভা কেন্দ্রে পদ্ম সরিয়ে জোড়াফুল ফোটে। দক্ষিণ 24 পরগণার মতুয়া অধ্যুষিত অঞ্চলে নিরঙ্কুশ জয় পায় তৃণমূল।

     

    মতুয়া ভোটের গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বাংলার নির্বাচনের সময় ওড়াকান্দি গিয়েছিলেন। হরিচাঁদের মূর্তির সামনে তাঁর সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করার ছবি ভোটমুখী বাংলার টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠাকুরনগরের নির্বাচনী জনসভায় গিয়ে ঘোষণা করেছিলেন তাঁর সরকার ক্ষমতায় এলে হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিবসে ছুটি ঘোষণা করা হবে। হরিচাঁদের জন্মতারিখ 11 মার্চ হলেও, মতুয়ারা মধু কৃষ্ণ ত্রয়োদশী তিথিতে তাঁর জন্মদিবস পালন করেন৷ সেই উপলক্ষ্যে ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়িতে মেলা বসে, বিপুল ভক্তসমাগম হয়। চলতি বছরে এই তিথিটি 30 মার্চ পড়েছিল।

     

    পরিতাপের বিষয় রাজনীতির এই দড়ি টানাটানিতে কোথাও অলক্ষ্যে থেকে গিয়েছে হরিচাঁদের সামাজিক আন্দোলন, বস্তুমুখী চিন্তাদর্শন। "হাতে কাম, মুখে নাম' আপ্তবাক্যকে সহায় করে ছিন্নমূল মতুয়ারা যে এখন আর্থ-সামাজিক ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন তাঁর মূলেও ছিল হরিচাঁদের বাস্তবমুখী চিন্তাভাবনা। যে ব্রাহ্মণ্যবাদ, ধর্মীয় আচারসর্বস্বতার বাইরে বেরিয়ে হরিচাঁদ মতুয়া সমাজকে কর্মঠ, শ্রমমুখী, সহিষ্ণু হওয়ার পাঠ দিয়েছিলেন, সেই ব্রাহ্মণ্যবাদ, ধর্মীয় রাজনীতিরই ক্রীড়ানকে পরিণত হয়েছেন মতুয়ারা। আর এই প্রবণতাকে রুখতে কখনও ছুটি ঘোষণা, কখনও বা হরিচাঁদের নামাঙ্কিত স্কুল-কলেজ গড়ার 'চমকদারি' ঘোষণায় ঢাকা পড়ে গেছেন হরিচাঁদ এবং তাঁর এই প্রগতিশীল সমাজ আন্দোলন। ভদ্রজনেদের তৈরি করা বায়বীয় শিক্ষা-সংস্কৃতির অঙ্গনে, ভারতবর্ষের দলিত জাগরণের মুখ হিসাবে আম্বেদকর কিংবা কাঁসিরামের সঙ্গেই হরিচাঁদ ঠাকুরের নাম উচ্চারিত হওয়া উচিত।

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    বকলমে লোকাল ট্রেন চলছে, খুশি নিত্যযাত্রীরা; দায় না নিয়ে সেফটি ভালভ থিওরি রাজ্য সরকারের?

    রাজবংশী ভোটই বিজেপির প্রাপ্তি, বিয়োগের খাতায় মতুয়া ও আদিবাসী ভোট।

    সৃষ্টি আর লয় হাত ধরাধরি করে চলে বর্ষায়, তবু আমরা বর্ষার জলে ভিজতে চাই, ভাসতে চাই।

    স্বাধীনতার 75 তম বছরে যে গণ-আন্দোলন প্রতিস্পর্ধী শাসককে নতজানু করল, সেই আন্দোলনেরও প্রেরণা মহাত্মা।

    শ্রীরামপুরের গির্জা বলতে ভোলা ময়রা এই সেন্ট ওলাফস গির্জার কথাই বলেছেন

    নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রে গণতন্ত্রের চূড়ান্ত অবমাননা থেকে নিষ্কৃতির পথ কি আমেরিকার গৃহযুদ্ধ?

    রাজনীতির হরিবোলে অলক্ষ্যে রয়ে যান হরিচাঁদ-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested