×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • নেই রাজ্যের বাসিন্দাদের বিরোধের নিষ্পত্তি হিংসাতেই হতে বাধ্য

    বিতান ঘোষ | 27-03-2022

    প্রতীকী ছবি।

    বীরভূম এখন বধ্যভূম। সহজিয়া বাউল দর্শনের আঁতুড়ঘর এই জেলা এখন শিরোনামে আসে বন্দুক, মাস্কেট, রাজনৈতিক খুনোখুনি আর গোলাগুলির সৌজন্যে। শাসকভেদে, সময়ভেদে কেন অবাধ্যরয়ে যায় এই জেলা? নাকি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতাই দুষ্কৃতকারীদের মুক্তাঞ্চল করে তোলে এই জেলাকে? ‘ওরে কেষ্টা, মিটিয়ে নে কেসটাবললে হয়তো আপাতত ঘটনাটিকে ভুলিয়ে দেওয়া যাবে, কিন্তু ধারাবাহিক হিংসাক্রমের একটু গভীরে গেলে বোঝা যায় এই কেস সহজে মেটার নয় এবং এইভাবে এই জাতীয় হিংসার মাধ্যমেই এই জাতীয় বিরোধের নিষ্পত্তি হবে। কারণ, এই কেস মেটানোর জন্য আদালতের দ্বারস্থ হওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। এটা গৃহস্থের ঘরে চুরির কাহিনি নয়, চোরের উপর বাটপারির কাহিনি।


    এই জেলার প্রতি লক্ষ্মীর বরাবরই একটি কৃপাদৃষ্টি রয়েছে। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে বালি খাদান, কয়লা খাদান ও পাথর খাদান। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ যার কাছে, লক্ষ্মীও তার কাছে। আক্ষরিক অর্থেই এখানে অর্থনীতি রাজনীতিকে পরিচালিত করে। দেউচা পাচামি খোলামুখ কয়লাখনি এক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের ভাগ্য আর একটু সুপ্রসন্ন করবে, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

     


    বগটুই গ্রামের ভাদু শেখ প্রথম জীবনে গাড়ি চালক, তারপর কিছুদিন মুরগির ব্যবসা করেছেনরাজনৈতিক জীবন কংগ্রেসে শুরু করে প্রায় এক দশক ধরে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণসদস্য। মানে তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসা ইস্তক ভাদু বর্তমান শাসকদলের সঙ্গে। চকিত রাজনৈতিক উত্থানে পঞ্চায়েতের উপপ্রধান বনে যাওয়া ভাদুর যে শত্রুর অভাব ছিল না, তা তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরাই স্বীকার করেছেন। তাঁদের কথায় এ-ও উঠে এসেছে যে, এই শত্রুতা রাজনৈতিক নয়, পুরোদস্তুর ব্যবসায়িক! ভাদুর মৃত্যুতে শোকাতুর স্ত্রী-র বিলাপবার্তায় ‘"আমার স্বামী তো সবাইকে দিয়ে খেত, একা খেত না।''



    ভাদু শেখ যে কোনও মাধুকরী করে আনা চাল-ডাল সকলের মধ্যে অকাতরে ভাগ করে দিতেন, এমন তো নয়। তবে এই খাবারটা কেমন? তার স্বাদই বা কেমন? জেলার পর্যবেক্ষক, মায় রাজনীতি-রহিত গ্রামবাসীদের কথাতেও উঠে আসছে এই খাবারের কথা। এই খাবার বেশি খেয়ে ফেলাতেই হয়তো বদহজম হয়ে গেল ভাদু শেখের, অর্থাৎ তাঁকে খুন হয়ে যেতে হল। জেলাজুড়ে বিভিন্ন খাদানে খানিক বৈধ আর বেশিরভাগটাই অবৈধ উপায়ে বালি, কয়লা, পাথর তোলা হচ্ছে। প্রতিদিন এই কাজে আসা অসংখ্য ট্রাক থেকে টোলহিসাবে তোলা অর্থ চলে যাচ্ছে কোনও এক বা একাধিক অদৃশ্য মাথার কাছে। এই মাথা বা মাথাদের এজেন্ট হচ্ছেন ভাদুরা। অবিকল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মডেল। কার কী দায়িত্ব, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়াই আছে। ব্যক্তিগত ভাবে এই ব্যবসার শরিক হওয়া যাবে না, তা নয়। তবে ওপরের মাথাদের যথাবিহিত সময়ে প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে হবে। নয়তো...



    সংশয়ীরা প্রশ্ন করবেন, তবে পুলিশ প্রশাসন কোথায় গেল? আসলে পুলিশ, শাসক দলের নেতা, সিভিক ভলান্টিয়ার— সবাই যে আমাদেরলোক! রাষ্ট্র (যার অংশ পুলিশ), শাসক দল, সরকারি ব্যবস্থার সমান্তরাল নিপুণভাবে পরিচালিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা – সবই একই সিস্টেমের অংশ। পুলিশ লোকাল নেতাকে আবার লোকাল নেতা পুলিশকে চমকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, তোমার এই দায়ভাগেঅংশ ছিল আমারও! ভাদু শেখের দো-তলা বাড়ি তিনতলা হলে, কে বা কারা রুষ্ট হতে পারেন বা কাদের ভ্রুকুঞ্চিত হতে পারে, তা যেমন পুলিশ ও গ্রামবাসীরা জানত, তেমনই ভাদু শেখ খুন হওয়ার পর কাদের প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলতে হবে, তা-ও তাদের অজ্ঞাত ছিল না। অতশত বুম, ফ্ল্যাশবালবের ঝলকানিতেই হোক কিংবা কোনও রাজনৈতিক অঙ্গুলিহেলনে গ্রামবাসীরা মুখে কুলুপ আঁটলেন, কেউ কেউ পরদিনই গ্রাম ছাড়লেন, আর পুলিশের ওসি এবং এসডিপিও-কে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সরিয়ে দেওয়া হল। মুখ্যমন্ত্রী কলকাতা থেকেই কর্তৃবাচ্যে বললেন, ‘দু'জনকে সরিয়ে দিয়েছি।এদের দুজনের কাছেই থাকত ভাদু শেখের দুটি গাড়ি!

     


    মুখ্যমন্ত্রী অকুস্থলে পৌঁছেই তাঁর নিজের দলের রামপুরহাট-1 ব্লকের সভাপতি আনারুল শেখকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিলেন। মৃতদের পরিবার নাকি এই পরিকল্পিত হত্যার জন্য আনারুলকেই দুষেছিল। তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীবিন্যাসে আনারুল ভাদু শেখের ঘনিষ্ঠ, আর সোনা শেখের বিরোধী। সোনা শেখ— যার পরিবারের ওপর প্রতিহিংসার রোষানল আছড়ে পড়ল। আনারুল আর ভাদু শেখের প্রাসাদোপম বাড়ি দেখে অনেকেই চমকিত হচ্ছেন, বিরোধীরা প্রশ্নও তুলছেন, গ্রামের অজস্র বাড়ির সারির মধ্যে এমন বিসদৃশ বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি করার রসদ কোথায় পেলেন এঁরা? আনিরুল রাজনৈতিক নেতা হওয়ার আগে, পূর্বাশ্রমে রাজমিস্ত্রী ছিলেন। ভাদু আনারুলদের বৈভব দেখে প্রান্তজনেদের ক্ষমতায়ন মনে করার কোনও কারণ নেই। কারণ ভাদু বা আনারুলদের বাড়িগুলির আশেপাশে তাঁদের প্রতিবেশীদের বাড়িগুলো নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। বরং তত্ত্বকথায় বলা যেতে পারে, এটি একেবারেই সাব-অল্টার্নদের ক্ষমতা ও অর্থের ললিপপ দেখিয়ে রাজনৈতিক বশংবদ করে রাখার চিরায়ত একটা খেলা।

     

    আরও পড়ুন: এত রক্ত কেন? বাংলার রক্তেই কি রক্তের নেশা?



    হেস্টিংসের পর কর্নওয়ালিস যখন বাংলার ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে চাইলেন, তখন তাঁকে যে বিষয়টি ভাবিয়েছিল তা হল, চাষির কাছ থেকে খাজনা আদায় করবে কারা? শাসক দলের ছোট মেজ নেতাদের দ্বারা পরিচালিত ও প্রযোজিত সুপারস্ট্রাকচারে এই প্রশ্নটিই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। বহুক্ষেত্রেই বল্গাহীন ক্ষমতা ও অর্থের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই ওপরমহলের। বাম আমলের মতো নেই কোনও কেন্দ্রীভূত সিস্টেমতাই সব হিসেব মিলছে না, অপরিমিত লালসারও শেষ হচ্ছে না। বধহচ্ছেন কখনও ভাদু শেখ, কখনও বা তপন কান্দুরা।



    স্থানীয় প্রশাসন ও অর্থনীতির পাশাপাশি একটি সমান্তরাল প্রশাসন ও অর্থনীতির এক অসম পরীক্ষাগার এই বীরভূম জেলা। বাম আমলে, 2000 সালের সূচপুর (নানুর) কান্ডে 11 জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যার পিছনে রাজনৈতিক সংঘর্ষকে ছাপিয়ে জমি সংক্রান্ত বিবাদই প্রধান কারণ হিসাবে উঠে এসেছিল। লক্ষ্মীর বখরা নিয়ে কোন্দল এই জেলায় নতুন নয়। রাজনৈতিক প্রভাবের জোরে অর্থনৈতিক ভাবে বলীয়ান হওয়া বহু ভাদু শেখদের জন্ম দিয়েছে এই জেলা। আবার সময়ের নিয়মেই ভাদুদের সরিয়ে উঠে এসেছে অন্য কোনও ক্ষমতাশালী ভুঁইফোড়। এই অবৈধ অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য ও ধূসর অর্থনীতির কথা প্রাতিষ্ঠানিক সমীক্ষা কিংবা অডিটে ধরা পড়ে না। কিন্তু অজয়, ময়ূরাক্ষীর উভয় পার জুড়ে কার্যত টাকা ওড়ে। আর সেই টাকার প্রলোভনেই কোনও রাজনৈতিক প্রভাবশালীর স্যাঙাত হয়ে যান ভাদুরা। সমান্তরাল প্রশাসনও তখন প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানকে কার্যত চ্যালেঞ্জ করে বসে।



    বিগত কয়েক দশক ধরেই রাজ্যে বড় কোনও শিল্প আসেনি। বেকারত্বের ছাপ দিকে দিকে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমেছে যুব সমাজের। এমতাবস্থায় গ্রাসাচ্ছদনের জন্য এই ধূসর অর্থনীতির অঙ্গীভূত হয়ে গেছে রাজ্যের যুব সমাজের বড় একটি অংশ। অনৈতিক উপায়ে উদ্বৃত্ত অর্থের হাতছানিতে দৌড়ে বেড়াচ্ছে এরা। এদের পরিচয় পাওয়া যেতে পারে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের বিখ্যাত ছন্নছাড়াকবিতায়। ‘‘ওরা যে নেই-রাজ্যের বাসিন্দে- ওদের জন্য কলেজে সিট নেই / অফিসে চাকরি নেই / কারখানায় কাজ নেই / ট্রামে বাসে জায়গা নেই...।‘’ এক্ষেত্রে বীরভূম কিন্তু কোনও বিচ্ছিন্ন একটি জেলা নয়, তা যতই সেই জেলার এই সংক্রান্ত একটি পূর্ব ইতিহাস থাকুক।



    কিন্তু এই অনুমোদিত তোলাবাজি, লুঠতরাজে যদি প্রশাসন এখনই লাগাম পরাতে না পারে, বচনবাগীশ নেতাদের শর্ট-শার্কিট তত্ত্ব’-কে নিবৃত্ত করতে না পারে, তবে শুধু বীরভূম নয়, রাজ্যের অনেক জেলাই বধ্যভূমে পরিণত হবে।

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    কিন্তু আজকাল বড় ধাঁধা লাগে চোখে, খালি চোখে বোঝা যায় না আসলে কে কার পরীক্ষা নিচ্ছে

    রাজনীতির বল্গাহীন লাটাই কাটাকুটি খেলে গেল, ভো-কাট্টা হল আমাদের ছেলেরা।

    প্রবাসী সন্তানের অভাব ভুলিয়ে সন্তানের মতোই প্রবীণদের আগলাচ্ছেন তুর্ণীরা।

    অহোম জাতীয়তাবাদে ভর করে আজ হিমন্তরা উচ্চপদে, আর কত মানুষ অসমের অ-সম রাজনীতির বলি হবে?

    নিউ নর্মাল সময়ে মহামারী অনেক কিছু বদলে দিয়ে গেলেও বাঙালির এই চিরায়ত অভ্যাসে বদল আনতে পারেনি।

    মানবাধিকার নয়, নাগরিকত্ব প্রদানও নয়, শাসকদলের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নটাই মূলকথা।

    নেই রাজ্যের বাসিন্দাদের বিরোধের নিষ্পত্তি হিংসাতেই হতে বাধ্য-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested