×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • 2020: তবু, মনে রেখো...

    বিতান ঘোষ | 30-12-2020

    প্রতীকী ছবি।

    শিবরাম চক্রবর্তী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে একবার বলেছিলেন নতুন বছর নতুন বছর করে মাতামাতি করার কিছু নেই। আমি দেখেছি কোনও নতুন বছরই একবছরের বেশি টেকেনি।' আপাতভাবে এই কথায় চপল হাস্যরস থাকতে পারে, তবে এর একটা নিগূঢ় অর্থও আছে বইকিবহতা নদীর মতো সময়ের স্রোতকে আমরা দিন, মাস, বছরের বাঁধ দিয়ে কয়েকটা ভাগে ভাগ করেছি। কিন্তু নিছক কেঠো সংখ্যা দিয়ে কি সময়ের চালচিত্রকে পড়ে ফেলা যায়? 1991-এর সোভিয়েত পতনের প্রভাব আর গুরুত্ব কি ওই একটা বছরেই সীমিত ছিল? নাকি 1945-এর হিরোসিমা-নাগাসাকি ওই একটা বছরেই সব ক্ষত মুছে ফেলেছিল? তবু, এই ঘটনাগুলির সঙ্গে ওই বছরগুলি আপাদমস্তক জড়িয়ে রয়েছে। চালু ধারণা হল, ইতিহাস মানেই তো সাল-তারিখ মুখস্থ করা। কিন্তু ইতিহাস মানে যে কালানুক্রম, ইতিহাস মানে যে স্মৃতি আর অভিজ্ঞতার আদানপ্রদান, সে কথা ভুলি কী করে?

    2020 সালটা আমাদের কাছে এমন একটা বছর যাকে আমরা অনেক কারণে মনে রাখব। আবার হয়তো অনেক কারণেই মনে রাখতে চাইব না। ভাবীকাল 2020-কে করোনা মহামারীর বছর হিসাবে দেখতে পারে। যদিও এই করোনার যাত্রা শুরু হয়েছিল গত বছরের শেষে, তবু কালান্তক মহামারী হয়ে এর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার সূচনা 2020-তেই। ভুবনায়িত পৃথিবী মনে রাখবে এই বছরেই গোটা বিশ্ব সংক্রামক রোগের হাত থেকে বাঁচতে ঘরের দুয়ার এঁটেছিল। প্রাচীনকালে ভিসুভিয়াসের অগ্নুৎপাত আর আধুনিক যুগে বিশ্বযুদ্ধ ব্যতীত এই প্রথম অন্য কোনও কারণে নির্ধারিত সময়ে অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হল না। পোপের শুভেচ্ছাবার্তা শুনতে ভ্যাটিকান সিটিতে সমাবেশ হল না, সারা বিশ্ব থেকে মক্কা-মদিনায় হজের জনসমাগম হল না, আমাদের বাংলায় দুর্গাপুজোর পর হল না বিজয়ার কোলাকুলি2020 নিয়ে এল এক অন্য দুনিয়ায়, যে দুনিয়ায় আমরা প্রত্যেকে যেন এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা। মেধাবী পড়ুয়াকে পেটের টানে সবজি বিক্রি করতে বসাল এই বছর, আবার এই পেটের টানেই দিল্লির কনকনে ঠান্ডায় কৃষকদের রাত জাগতে শেখাল এই বছর

    বিশ্বের রত্নভান্ডার থেকে অনেকগুলো রত্ন খোয়া গেল এবার। বাঙালিও অনেকটা নিঃস্ব হল, রিক্ত হল। ইতিহাসের ফলকে এই সবকিছুর জন্যই 2020 সালটার উল্লেখ থাকবে। কিন্তু যে সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিক ভিনরাজ্যে কাজ হারিয়ে মরিয়া হয়ে ঘরে ফিরলেন, ফেরার পথে ক্লান্তি, ক্ষুধায় রাস্তাতেই লুটিয়ে পড়লেন, তাদের কথা কি মনে রাখব আমরা? 2020-র অতীতচারণ করতে গিয়ে কখনও কি এদের কথা মনে পড়বে আমাদের? কেন্দ্রের মন্ত্রী দেশের জনগণের একাংশকে গদ্দারবললেন, এমনকি তাদের ওপর গুলি চালানোরও নিদান দিলেন। সংখ্যালঘু মহল্লায় ঢুকে নির্বিচারে খুনজখম চলতে লাগল। হয়তো এরপরেও সেই মন্ত্রী জনতার কাছে ভোটভিক্ষা করবেন, ভোটে হয়তো জিতবেনদাঙ্গা বাঁধানোর সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ মুছে ফেলা হবে। কিন্তু যে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের শবদেহ 3 দিন পর নর্দমা, পোড়া দোকানবাড়ি থেকে উদ্ধার করা হল, তাদের কথা আমরা মনে রাখব তো? হে আগামী, 2020-কে এই কারণে ভুলো না

    বিপদের দিনে বন্ধু চেনা যায়— এ এক প্রাচীন শিক্ষা আমাদের সকলের কাছে। 2020 কিন্তু চেনাল বিপদের দিনে রাষ্ট্রনায়কও চেনা যায়। যে সমস্ত রাষ্ট্রনায়ক অন্যান্য সময় কারণে-অকারণে তাদের শৌর্যের পরীক্ষা দেন, শত্রুদেশকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে হাততালি আর ভোট কুড়োন, করোনা মহামারী তাঁদের প্রায় সকলকেই দিশাহীন করে তুলল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসংলগ্নও। বোঝা গেল সত্যিকারের বিপদের দিনে আমেরিকার বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতোই তাঁরা জনগণের ত্রাতা নন তো বটেই, বিপদ সংহারকও নন। কালের নিয়মে করোনার শক্তি হ্রাস পাবে, এই শাসকরা হয়তো তখনও দাবি করবেন, তাঁদের জন্যই ভাইরাসটি হাপিস হয়েছে। কিন্তু আমরা কি ভুলে যাব তাঁদের গরমাগরম দাবির উল্টোদিকে তাঁরা প্রত্যেকেই আসলে এক একটা কাগুজে বাঘ? হে আগামী, 2020-কে এই কারণেও ভুলো না

    প্রকৃতিকে আমরা ক্ষতবিক্ষত করেছি। সহায় সম্বলহীন কোনও মানুষকেও কাছে টেনে নিইনি। কান পেতে বউ কথা কও’-এর ডাক শুনিনি। বিকেলের নরম আলোয় ঘুড়ি উড়ে যেতে দেখিনি। 2020 আমাদের ব্যস্ততায় লাগাম পরিয়ে এই সবকিছুই দেখিয়ে গেল আমাদের। তুচ্ছ জিনিসেও যে এত মাধুর্য, তা বোধহয় এর আগে বোঝা হয়ে ওঠেনি। 2020 আমাদের মুখ ঢেকে দিল, কতকাল কত পরিচিত মুখের সঙ্গে দেখা হল না। প্রণয়ী প্রেমিকের হাত ধরল না। আমরা তো ধরে নিয়েছিলাম একা থাকায় ভারী সুখ। বিকেলের মাঠগুলো কয়েকবছর ধরেই ফাঁকা পড়ে থাকত। সব শিশুরাই নাকি ওইসময় পড়াশোনা করত। কেউ কেউ গিটার ক্লাস বা ভিডিও গেমসে থাকত। 2020-র শেষে গিয়ে দেখলাম মাঠগুলো আবার অল্প অল্প করে ভরে উঠছে। দীর্ঘ বন্দিজীবনে ক্লান্ত মানুষ আজ মনোবৈকল্যের শিকার। সকলের বেঁধে বেঁধে থাকাটা যে কত জরুরি, খুব কর্কশভাবেই তা বুঝিয়ে দিয়ে গেল এই বছরটা। খেরোর খাতায় বিয়োগের হিসাব মেলাতে গিয়ে যোগের পাতাটাও এভাবেই ভরে উঠল

    আর কয়েকদিন মাত্র। তারপর 2020 সালটাও ইতিহাসের পাতায় চলে যাবে। যারা 2020-কে অপয়াএকটা বছর বলে ভেবেছি, তারা হয়তো মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলব। কিন্তু নতুন বছর মানে তো কিছু সংখ্যার বদল। তার হাতেও তো কোনও জাদুকাঠি নেই, যার মিডাস টাচে সব দুঃখ ক্লান্তি মুছে যাবে। চলমান সময়ের সামনে আমরা সামান্য পর্যবেক্ষক মাত্র। এই একটা বছরে যা গড়তে দেখলাম, ভাঙতে দেখলাম অনুপুঙ্খ ভাবে তার বিবরণ লিখে যাওয়া কিংবা স্মৃতির পাতায় রেখে দেওয়াতেই তো আমাদের দায়। কিন্তু সেই পাতা ওল্টানোর আগে 2020 একটু থামতে বলে। সব হারানোর বেদনা নিয়েও উপলব্ধি করতে বলে। ভুলে যেতে তো সময় লাগে না। তবু আগামীর জন্যই ফেলে আসা অতীতকে মনে রাখতে হয়। 2020 আমাদের বহু অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করেছে। আগামীর যে কোনও প্রতিকূলতায় সেগুলোই আমাদের হাতিয়ার। তাই ধিকৃত হয়েও 2020 বলে যায়, ‘তবু মনে রেখো...।'


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    পুরুষ সদস্যের মুখাপেক্ষী না থেকে, আর্থসামাজিক স্বাবলম্বনকে বুঝি 'ভিক্ষাবৃত্তি' বলে?

    শাসক গ্যাস চেম্বারে সময়কে মারতে পারেনি, আমরা তাকে সবসময় আগলে রেখেছি।

    শিল্পীর শিল্প কালোত্তীর্ণ হয় মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সরকারের দেওয়া রাষ্ট্রীয় খেতাবে নয়।

    নাবালিকা 'ধর্ষণ' নিয়ে মমতার এমন অসংবেদনশীল মন্তব্য ও ভাবনার শরিক বহু সাধারণ মানুষ, সে আমরা প্রকাশ্যে

    কথা রাখে না সরকার, রেললাইনে মরাই যেন ভবিতব্য পরিযায়ী শ্রমিকদের।

    বোরখা পরা নাজমার বর 2002-এর গুজরাতে খুন হয়, এখন মুশকানরা আল্লা হো আকবর বললেই দোষ হয়ে যাবে?

    2020: তবু, মনে রেখো...-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested