ভারতের এলিজিবল ব্যাচেলরের তালিকায় একটা নতুন নাম সংযুক্ত হয়েছে— নীরজ চোপড়া। সারা দেশ নাকি জানতে আগ্রহী নীরজের প্রেমিকা আছেন কিনা, থাকলেও সেই ‘ভাগ্যবতী’ কে? নীরজ অলিম্পিক্সের শেষ লগ্নে সোনার পদক জয় করে দেশবাসীর ‘প্রাণে খুশির তুফান’ এনেছেন। নীরজের খেলা, কিংবা জ্যাভলিন সম্পর্কে যাঁরা বিন্দুমাত্র ওয়াকিবহাল ছিলেন না, তাঁরাও ভীষণই খুশি। এর মধ্যে অবশ্য কোনও দোষ নেই। ভ্যান গঘের "স্টারি নাইট’ দেখে উচ্ছ্বসিত হওয়ার প্রাথমিক শর্ত নিশ্চয়ই বড় চিত্রসমালোচক হওয়া হতে পারে না।
নীরজের কষ্টার্জিত সোনা যে আমাদের সকলকে গর্বিত করেছে, এই বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই। একই ভাবে মীরাবাই চানু, লাভলিনা বরগোঁহাই, রবি দাহিয়া, ভারতীয় হকি দলের সাফল্যও সকলকে গর্বিত করেছে। তবে নীরজের সোনা জয়ের প্রাথমিক উচ্ছ্বাস পর্ব স্তিমিত হয়ে এলে আমরা বেশ কিছু জিনিস প্রত্যক্ষ করলাম। নীরজ যে কত বড় দেশহিতৈষী, পর্যায়ক্রমে তা জানান দিলেন সরকারের কেষ্টবিষ্টুরা। নীরজ যত প্রচারমাধ্যমের মধ্যমণি হয়ে উঠলেন, ততই যেন লাভলিনা, মীরাবাইদের নিয়ে উচ্ছ্বাস, আলোচনা থেমে এল। নীরজ সোনা পেয়েছেন, তাই জন্যই কি তাঁর একটু বেশি কদর? কারণ নীরজের সোনার দ্যুতি নিষ্প্রভ হয়ে আসা জাতীয়তাবাদকে পুনরুজ্জীবিত করলেও করতে পারে। সেক্ষেত্রে সোনার পদক নীরজের একান্ত ব্যক্তিগত হলেও তা দেখিয়ে অনেক কিছু ঢাকা দেওয়া যাবে। স্বাধীনতার 75 বছর পূর্তি উপলক্ষে সরকারের তরফে অমৃত মহোৎসবের সূচনা করা হয়েছে। কিন্তু হলাহলের মাঝে অমৃত কোথায়? জিডিপির মতো জটিল সংখ্যাতত্ত্বের ব্যাপার না হয় বাদ রাখা গেল। উর্ধ্বমুখী বেকারত্বের হার, পরিযায়ী শ্রমিক সংকট, কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলায় সার্বিক ব্যর্থতা— জাতীয়তাবাদের মরা গাঙে বান আনার মতো আছেটা কী? যুদ্ধ যুদ্ধ রব নেই, দেশপ্রেমে ম্যারিনেট করা জাতীয়তাবাদী রেসিপির বলিউডি সিনেমাও নেই। অন্দরের বিবাদ ক্রমশ মাথাচাড়া দিচ্ছে। শাসকদল পরিচালিত দুই রাজ্য সরকারের মধ্যে বিবাদ ঘোচাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ব্যতিব্যস্ত হতে হচ্ছে। কৃষকরা নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এই ক্ষতে প্রলেপ জোগাতে একটা অলিম্পিকের সোনার বড় প্রয়োজন ছিল।
সুবিধা আরও অনেক আছে। নীরজ কিন্তু আর্যাবর্তের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হরিয়ানার ছেলে। যথেষ্ট স্বচ্ছল পরিবার। জীবনের গোড়ার দিন থেকে নীরজের সামনে অপ্রাপ্তির তালিকাটা দীর্ঘায়িত হয়নি, যা হয়েছিল মীরাবাই বা লাভলিনাদের ক্ষেত্রে। স্মরণে রাখতে হবে মীরাবাইরা সেই উত্তর-পূর্ব ভারতের মেয়ে, যেখানে গ্রামের কেউ পদক বা খেতাব জুটলে পানীয় জলের কল বসে বা রাস্তা পাকা হয়। তাই তাঁদের জয়ে রাষ্ট্রের যতই আত্মশ্লাঘা হোক, অস্বস্তির জায়গাটাও কম নয়। একটু অন্যভাবে দেখলে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও লাভলিনাদের এই সাফল্য যেন সাম্যের ধ্বজাধারী রাষ্ট্রের প্রতি এক নির্মম চপেটাঘাত। রাষ্ট্র সেই ব্যথা ভুলে তবু হাসার চেষ্টা করে।
তার ওপর নীরজ পুরুষ। মনুর দেশে নীরজকে হাফপ্যান্ট পরে ভারোত্তোলন করতে হয় না বা হকি খেলতে হয় না। তাঁর দেহসৌষ্ঠবও নজরকাড়া। মুখশ্রীটাও গড়পড়তা ভারতীয়ের মতো, দেখে একটুও ‘নেপালি’ বা ‘চাইনিজ’ মনে হয় না। সংবাদমাধ্যমগুলিতে নিরন্তর নীরজের প্রতি নানা বিশেষণ প্রযুক্ত হচ্ছে— ‘হ্যান্ডসাম’, ‘স্বপ্নপুরুষ’ ইত্যাদি। সোনার খেতাব নিয়ে নীরজ হ্যান্ডসাম হলে, রূপো বা ব্রোঞ্জ নিয়ে মীরাবাইরা কেন আবেদনময়ী নন, কেন স্বপ্নসুন্দরী নন? শুধু তীব্র পুরুষাকারের সামনেই আমরা মাথা ঝোঁকাব, নারী শুধু অবলা-দুবলা হয়েই বেঁচে থাকবে?
নীরজ সেনাবাহিনীতে কর্মরত। স্বভাবতই তাঁর এই সাফল্যে সেনাবাহিনীর সকলে খুশি। কিন্তু অবাক হতে হয় যখন দেখি রাষ্ট্র নীরজের সাফল্যকে সেনাবাহিনীর সাফল্যের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চাইছে। বীরপুজোর দেশে এই আদি বীররসাত্মক কাহিনী দিয়েই কি নিশ্চিন্তে রাজসিংহাসনে বসে থাকবে শাসক? একটু পিছনে তাকিয়ে বলবে না, সাম্যের অধিকারে নীরজ আর মীরাবাইরা সমান নয়? বলবে না নীরজদের সাফল্যে সেনার কৃতিত্ব থাকলেও, মীরাবাইদের পড়শিদের অনেক ক্ষতির জন্য সেনাবাহিনী দায়ী?
আরও পড়ুন: তপস্বিনী আদি ভারতমাতা তেজস্বিনী রণরঙ্গিনী নন
এতটা পড়ে অনেকে অখণ্ড জাতীয়তাবাদে বিভাজন প্রচেষ্টার কুচক্রী বলে দেগে দিতে পারেন আমায়। কিন্তু বিভাজনটা তো রাষ্ট্রই এতকাল জিইয়ে রেখেছে। এই বিভাজন উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাকি ভারতের, কখনও পুরুষের সঙ্গে নারীর, কখনও বা তীব্র পুরুষাকারের সঙ্গে অবগুন্ঠন ঢাকা অবলা নারীর। এরপরও হয়তো মীরাবাইদের নিয়ে সিনেমা তৈরি হবে। সেই সিনেমার নামভূমিকায় তো থাকবেন কোনও বলিউডের শিল্পীই। অনেকটা যেমন কালো মেয়ের চরিত্রে কালো মেকআপ নিয়ে অভিনয় করেন ফর্সা অভিনেত্রী! সিনেমার বক্স অফিস কালেকশনও এনে দেবে বৃহত্তর ভারত, কারণ নীরজের বাড়ির কাছে পিঠে মাল্টিপ্লেক্স থাকলেও, মীরাবাইদের গ্রামে হয়তো পানীয় জলের কলটুকুও নেই। হলে বসে সিনেমা দেখা সেখানে খানিক বিলাসিতাই। বলিউড, যুদ্ধ জিগির আর আরোপিত জাতীয়তাবাদী জিগির দিয়ে কি সব ফাটল ঢাকা দেওয়া যায়?
সম্প্রতি অবশ্য বাংলার নির্বাচন একটা অন্য আলোর সন্ধান দিয়েছে। এর মূল্য যতটা না রাজনৈতিক, তার অনেক বেশি সামাজিক। প্রধানমন্ত্রীর তীব্র পুরুষতান্ত্রিক আস্ফালনের সামনে এক আঞ্চলিক নেত্রী লড়ে জয় ছিনিয়ে এনে প্রমাণ করে দিয়েছেন জাতীয়তাবাদ, ক্ষমতা, পেশী, পুরুষ— এই চার অক্ষের সমন্বয়ে সবকিছু জিতে নেওয়া যায় না, আঞ্চলিক, প্রান্তিক স্বার্থগুলোও এই দেশে যথেষ্ট স্পর্শকাতর। অবশ্য বাংলায় মঙ্গলকাহিনীগুলোতেও নারীদের যেভাবে মহিমান্বিত করা হয়েছে, তা বাকি ভারতে কখনওই দেখা যায়নি। যাইহোক, নীরজ আপনার জন্য অনন্ত শুভেচ্ছা। আপনার জয়ে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। মাফ করবেন, এই তিক্ত কথাগুলো বলতে হল বলে। পরিশেষে একটা অনুরোধ। আপনার সোনা যেন রাষ্ট্রের মিথ্যা গরিমা প্রচারে ব্যবহৃত না হয়, সেদিকে একটু খেয়াল রাখবেন।
মানুষের মনোলোকে আড়ি পাতা ফেসবুকের অন্তর্লোকে আলো ফেলবে এই বই।
সঙ্গীতের মহাকাশে ধ্রুবক হয়েই থাকবেন সন্ধ্যা-তারা।
বিশ্বে দেশ নামক ধারণাকে যত কঠিন করা হচ্ছে, দেশহীন শরণার্থীদের সংখ্যা ততই বাড়ছে।
জীবনের সায়াহ্নে এসে পরিচিত মানুষদের শঠতা, কৃতঘ্নতায় আঘাত পেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর।
জীবনের সকল অন্ধকারে ভালবাসা আর মমত্বের রোদ্দুর পড়ুক, ক্রান্তিকালে এ'টুকুই তো প্রার্থনা।
জন্মিলে মরিতে হইবে, ক্যাপিটালিজম সঙ্গ দেবে!