খবরের কাগজে দেখলাম প্রথম পাতাতেই বড় করে ছবি বেরিয়েছে, একটি বেকারি সংস্থা এক বৃদ্ধার হাতে পাউরুটি তুলে দিচ্ছে। আরও দেখলাম, এক তারকা ‘সফ্ট নিউজ’ বিভাগে লিখেছ্নে দিন আনা, দিন খাওয়া মানুষরা কী খাবেন সেই আশঙ্কার কথা; সদ্যোজাতকে নিয়ে আগরতলায় দিন গুজরান রাজস্থানের পরিযায়ী শ্রমিকের; মানিকতলা বাজারে রবিবার সকালে মাংস কিনতে গা ঘেঁষাঘেঁষি ক্রেতাদের; বিদেশ থেকে বায়না না আসায় পেটে টান কুমোরটুলির; সব্জি-ফল-ডিম-পাউরুটি ফেরি করছেন টোটোচালক, চপ-কচুরি বিক্রেতারা; ছিটমহলে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেন কোন এক ‘অ্যাম্বুলেন্স দাদা’; বিভিন্ন জায়গায় ক্লাব থেকে চাঁদা তুলে ত্রাণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে; ইটাহর ব্লকের ভাগনইল গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল সাত্তার নিজের এক্কাগাড়ি হাঁকিয়ে এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম ঘুরে চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ পৌঁছে দিচ্ছেন; গড়িয়া-গড়িয়াহাট রুটের এক অটোচালক সকালবেলায় সব্জি বেচছেন এখন; মেদিনীপুরে রেশন কম দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হলেন রেশন ডিলার; সাহায্য হিসেবে গোটা মুরগি দিয়ে নজর কাড়লেন তমলুক পুরসভার কাউন্সিলর... ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
যা দেখা যাচ্ছে, খাবার ‘বেচা-কেনা-খাওয়া’ই এখন মানুষের সব থেকে বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাভাবিক; ভারতবর্ষের মতো দেশে এক মাসের বেশি সময় ধরে লকডাউনের প্রভাব, এ ছাড়া আর কী বা হতে পারে! সোশাল মিডিয়ায় যাঁরা দু-বেলা রান্না-রান্না খেলছেন, আগেভাগে দশটা ডিমের ট্রে, দু-বস্তা আলু, কয়েক কুইন্ট্যাল চাল বাগিয়ে রেখেছেন তাঁরাও মানুষ। তবে, আমি অবশ্যই সেইসব মানুষদের কথা বলছি, ‘মাৎস্যন্যায়’ সংজ্ঞায় যাঁরা ছোট মাছ, যাঁদের চিরকাল পট করে গিলে ফেলে বাঘা-বাঘা মাছেরা অথবা যাঁদেরকে নির্দ্বিধায় কীটনাশকে স্নান করিয়ে ভাইরাস মারার অঙ্গীকার করা যায়।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, নিজেদের বিজ্ঞানীদের রিপোর্ট উপেক্ষা করে ভারত সরকার এক মাস হাত গুটিয়ে বসেছিল। বিজ্ঞানসম্মত কোনও স্ট্র্যাটেজি ছাড়াই চার ঘণ্টার নোটিসে দেশজোড়া লকডাউন ঘোষনা করে দেশের দরিদ্র ও পরিযায়ী শ্রমিকদের একইসঙ্গে জীবিকা ও খাদ্যসঙ্কটের মুখে ফেলে দেওয়া হল। অন্যদিকে, দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত কেন্দ্রীয় খাদ্য ও গণবণ্টন মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ান, যাঁর কন্ঠস্বরে প্রান্তিক মানুষদের সাহায্যের বার্তা থাকার কথা ছিল, তিনি বলেছেন, দেশের মজুত খাদ্যভাণ্ডার বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে ‘ন্যাশনাল ডিজাস্টার’-এর জন্য। খুব ভাল। গোটা দেশ জুড়ে এখন এটা তবে কী চলছে? ডান্ডিয়া না কি হোলি উৎসব?
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “নভেল করোনা ভাইরাস কাউকে ছাড়ে না। তা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-সীমান্ত নির্বিশেষে আক্রমণ করতে পারে। তাই একতা ও সৌভ্রাতৃত্বই হচ্ছে আমাদের মূল মন্ত্র।''
এসব বক্তৃতার পরই রাজা রাজকীয় পাত্রে ‘ফাইভ-স্টার’ বাবুর্চির বানানো খিচুড়ি ঢেলে খেতে পারেন এবং আড়মোড়া ভেঙে মোমবাতি সাজিয়ে ধ্যানে বসতেই পারেন। সেটা আলাদা বিষয়, কিন্তু এই যে ‘মূল মন্ত্র’, ‘একতা’, ‘সৌভ্রাতৃত্ব’– তা কি শুধুমাত্র আইটি সেলের ভাইটির জন্য? ওনার এইসব দুর্মূল্য বক্তব্য ভুক্তভোগী মানুষদের কোনও কাজে আসছে বলে তো মনে হচ্ছে না!
এই যে আমি, আমি নিজেই তো দিব্যি দু-বেলা ভরপেট খাচ্ছি, প্রাত:কৃত্যেও কোনও সমস্যা নেই। তাহলে এ সব ঘেঁটে কী প্রমাণ করতে চাইছি?
কিচ্ছু না। শুধু দু-বেলা যখন যখন মুখে ভাতের গ্রাস তুলছি মনে পড়ছে ছোটবেলার কথা। ক্লাস সিক্স-এ উঠেছি। হাতে পেয়েছি মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে ভাত খাই আর ‘ভাত’ পড়ি…
“…মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করে, কোনো কথা গুছিয়ে ভাবতে পারে না। খুব ভাবে সে, না না। এইবার গুচিয়ে ভাবতে হচ্ছে। কী যে হল তা এখনও দিশে হচ্ছে না তেমন। ভাবতে গেলেই তার প্রথমে মনে হয় ধানে গোছ আসার আগেই ধান গাছ থেকে সবুজ রঙ চলে যেতে থাকে। কার্তিক মাসেই ধান খড় হয়ে গেল। তা দেখে উচ্ছব মাথায় হাত দিয়েছিল। সতীশ মিস্তিরির হরকুল, পাটনাই, মোটা, তিন ধানে মড়ক। উচ্ছব তো সতীশবাবুর জমিতে কাজ করেই ক-মাস বেঁচে থাকে। অ উচ্ছব, মনিবের ধান যায় তো তুই কাঁদিস কেন? কাঁদব না, সাধানবাবু, কাঁদব না? লক্ষ্মী না আসতে সেধে ভাসান যাচ্ছে তা কাঁদব না এতটুকু? আমরা খাব কী?”
“...গুছিয়ে চিন্তা করতে বসলে আগে মনে হয় ধানক্ষেতে আগুন লাগার কথা। তারপরই মনে পড়ে যে রাতে ঝড় হয়। সেই সন্ধ্যেয় অনেকদিন বাদে সে পেট ভরে খেয়েছিল। এই এত হিঞ্চে সেদ্ধ আর এত গুগলি সেদ্ধ নুন আর লঙ্কা পোড়া দিয়ে। দিনটা এমন ছিল যে সে দিনে গ্রামের সকল উচ্ছবেরা ভরা পেট খেয়েছিল। খেতে খেতে চন্নুনির মা বলেছিল, দেবতার গতিক ভালো নয়কো। লৌকো নে ঝারা বেইরেচে বুঝি-বা বোট মারা পড়ে।”
“...তারপরেই মনে পড়ে মাঝখুঁটিটা সে মাটির দিকে ঠেলে ধরে আছে। মা বসুমতী ঝেমন সে খুঁটি রাকতে চায়নে, উগরে ফেলে দেবে। ভগমান! ভগমান! ভগমান! তারপর বিদ্যুচ্চমকে ক্ষণিক আলোয় দেখা মাতলার সফেন জল ছুটে আসছে। ব্যস, সব ঘোলামেলা একাকার তার পর থেকে। কি হল। কোথায় গেল সব। তুমি কোথায়, আমি কোথায়। উচ্ছব নাইয়া/পিং হরিচরণ নাইয়া/কাগজসহ কোটোটি কোথায়। বড় সুন্দর কৌটোখানি গো! চুন্নুনিদের যদি রেখে যেত ভগবান, তাহলে উচ্ছবের বুকে শত হাতির বল থাকত আজ। তাহলে সে কৌটো নিয়ে সবাই ভিক্ষেয় বেরোত। সতীশবাবুর নাতি ফুট খায়। উচ্ছব কৌটোটা চেয়ে এনেছিল। অমন কৌটো থাকলে দরকারে একমুঠো ফুটিয়ে নেয়া যায়। চমৎকার কৌটো।” (ভাত, মহাশ্বেতা দেবী)
সেদিন ভাতের মধ্যে মিশে গিয়েছিল চোখের কয়েক ফোঁটা নুনজল আর স্নায়বিক ধড়পড়ানি। সেই প্রথমবার বড়দের মতো হতাশা, আর অনেকটা রেগে যাওয়া। প্রান্তিকের কন্ঠস্বরে শ্বাসরোধ হয়ে উঠেছিল। মাথার ভিতর তখন বদ্ধভূমি আর ভগমান! ভগমান! ভগমান! এমন দেখিনি-শুনিনি-বুঝিনি আগে। অথচ আজ আবার মনে পড়ে গেল এ শুধু ইতিহাস বা নিছক স্মৃতি নয়, হুবহু সত্যি। বহু জন্মের স্রোত শিরায় বয়ে বেড়ানোর পরম উপলব্ধি!
ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না, তা আমরা জানি। কিন্তু এখন তো চারিদিকে শুধু কাক আর কাক... ছড়ানোর মতো ‘ভাত’ কই?
মহাশ্বেতা দেবী বলেছিলেন,
“আধিপত্য বিস্তারকারী হেজিমনি (hegemony) সম্প্রদায় নয়, আমি সর্বদাই বিশ্বাস করি যে, সত্যকারের ইতিহাস সাধারণ মানুষের দ্বারা রচিত হয়।” সময় সাধারণ নিয়মেই চলছে, কতদূর চলবে, তা সময়েই উচ্চারিত হবে। আমরা শুধু সাক্ষী থাকছি ইতিহাসের এই নতুন অধ্যায়ের।
তাঁর সাহিত্য সাধনায় তিনি খুঁজেছেন অখণ্ড মনুষ্যত্বকে এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ককে
এ বাজারে ভাগ্যের কাছে আমরাই তো ঠকে গেছি
এই পরিস্থিতি সকলের কাছেই নতুন। ভার্চুয়াল-ই এখন নিউ নর্মাল। সময়টাকে কীভাবে দেখছেন?
5 এপ্রিল, রাত ন’টা থেকে প্রায় দশটা পর্যন্ত, কিছু দৃশ্য আমাদের দেখানো হয়েছে; একটা খারাপ সিনেমা।
‘বাঙালি-ভুলানো ছড়া’ই তাহলে এবার বাংলার মসনদের চাবিকাঠি?
ও গানওয়ালা আর একটা গান গাও, আমার আর কোথাও যাবার নেই।