একটা সময় ছিল বটে! যখন একটা হর্ন, হকার, রোজগার, রাজনীতি, রেডলাইট, দরাদরি, অপরাধ, অপঘাত, প্রেম, প্রতিবাদ...সবকিছুর নির্বাক সাক্ষী হয়ে রাতদিন জেগে থাকত কলকাতার রাজপথ। এমন নিদারুণ টিকে থাকার সঙ্গে করে যাওয়া আসার মাঝে এই রাজপথেই কখনও কখনও কানের ভিতর দিয়ে একেবারে মনের মধ্যে ঢুকে পড়ত শান্ত-গভীর সুর, যা ঝুপ করে নামিয়ে দিত যাবতীয় ক্লান্তি। কয়েক মাসের মধ্যে একটা ভাইরাস পুরো বিষয়টা ওলটপালট করে দিলেও, পাল্টায়নি শুধু ক্লান্তি। তখন বাইরে বেরিয়ে ক্লান্ত লাগত, এখন বাড়িতে বসে বসে। আর ক্লান্ত হলেই মনে পড়ছে রাজপথের সেইসব সুরগুলোর কথা। কোথায় গেল তারা?
রাজপথ আর সুর ছিল ওদের জীবন জীবিকা। ‘হ্যামলিন’ নয়, ব্যস্ত রাজপথেই দেখা মিলত এক ফকির বাঁশিওয়ালা আর ভবঘুরে এক বেহালা বাজিয়ের। শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যাঁদের দৈনন্দিন যাতায়াত ছিল, তাঁরা অনেকেই চিনবেন ওদের। আমিও সেভাবেই চিনতাম। ওরা কেউকেটা নন, পথ চলতি শ্রোতারা যখন ভালবেসে 10, 20 টাকা গুঁজে দিত হাতে, মুখে হাসি ফুটত ওদের। প্রথম সাক্ষাতেই আলাপ করেছিলাম ওদের সঙ্গে। ওদেরকে আবার কবে দেখতে পাব জানা নেই, সম্প্রতি বাড়িতে বসে বসে নিজের ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখি মেমোরি কার্ডে এখনও সুরক্ষিত রয়েছে দু'টি সাক্ষাৎকার।
সাক্ষাৎকার: ‘মনে মনে’
তাঁর দেখা পাওয়া যেত কালীঘাট মেট্রো স্টেশনের প্রবেশদ্বারে (বিগত কয়েক বছর ধরে এখানেই নিয়মিত দেখা মিলত তাঁর), সেখানেই ঘন্টার পর ঘন্টা বসে এক হাতে বাঁশিতে খেপে খেপে সুর তুলতেন, আর এক হাত বাড়িয়ে দিতেন পথচলতিদের দিকে।
“নাম কী? বলছি, তোমার নামটা কী?...”
সামনে দাঁড়িয়ে তিন-চার বার নাগাড়ে এই প্রশ্নটা করার পর, ভাবলাম নিশ্চয়ই খুব মন দিয়ে বাঁশিতে সুর দিচ্ছেন, বাঁশি থামলে ফের জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু না, তাতেও সাড়া দিলেন না। এবার একেবারে পাশ ঘেঁষে বসে জিজ্ঞেস করলাম, নাম কী?
সঙ্গে সঙ্গে হাসি মুখ আমার দিকে ফিরিয়ে...
নাম, মনোরঞ্জন হালদার ওরফে ‘মনে মনে’ (ভালবেসে লোকে এ নামেই ডাকে তাঁকে, শিশুসুলভ হেসে বলেন তিনি)। বুঝলাম এতক্ষণ ‘অ্যাটেনশন’ না পাওয়ার কারণ, শ্রবণেন্দ্রিয়ে জরা! কারণ শ্রী 'মনে মনে' জীবনের 85টি বসন্ত পেরিয়ে গিয়েছেন। বাঁশির ফুঁকও বেশ মলিন হয়েছে। টানা 1 মিনিটও বাজাতে বেশ বেগ পান। তবে সেই হাঁপধরা 1 মিনিটের বাঁশির আওয়াজেই আপনি ফিরে পেতে পারেন খোলা বাতাস আর অনন্তের প্রশান্তি।
জানালেন বাড়ি দূর-গঙ্গাসাগরে, এখানে বিধাননগরের কাছে কোনও এক ঝুপড়িতে কোনওমতে রাত-গুজরান। মাঝে মধ্যে দলের সঙ্গে নদিয়া, নবদ্বীপ, রানাঘাট করে বেড়ান।
“ছেলেরা তো বারণ করে, তবু মন-টা না বাজিয়ে থাকতে পারে না, সেই 12 বছর বয়স থেকে শুরু, সংসার টেনেছি বাঁশি বাজিয়েই। এতদিনের ‘ব্রহ্মজ্ঞান’...” বলতে বলতেই চশমার ফাঁকে ঘোলাটে দৃষ্টি খানিকক্ষণ স্থির রেখে, কিছুক্ষণ থেমে ফের বাঁশিতে দিলেন ফুঁ, হাতে পড়ল 1, 2, 5 টাকা।
মেট্রোর ব্যস্ততম সিঁড়িতে আমি তাঁর পাশে বসে গল্প করছি দেখে এক গম্ভীর কন্ঠস্বর বলে ওঠে, ‘কাকা রাস্তা থেকে সরে যাও’। বুঝলাম ‘কাকা’ নন, সিঁড়িতে জায়গা বাড়িয়ে অসুবিধার সৃষ্টি করছি আমিই। তাই ‘আবার আসব বাঁশি শুনতে’ জানিয়ে তড়িঘড়ি উঠে পড়ি আমি। গম্ভীর গলার হুঁশিয়ারি আর আমার তড়িঘড়ি উঠে যাওয়া নিয়ে কিছু অপ্রস্তুত বোধ করছিলেনই মনে হল, হয়তো কথা বলতে বেশ ভালই বোধ করছিলেন তিনি। যে রাস্তায় বাঁশি শোনান রোজ, যাঁদের হাঁপধরা সুর শোনান অহরহ, তাঁদের বিরক্তি-গম্ভীর তাচ্ছিল্যের জবাব দেওয়ার সাধ-সাধ্য-অধিকার তাঁকে দেয়নি এ শহর। তাই একবার ফোকলা হেসেই, ফের বাঁশিতে হাঁপধরা ফুঁ দিয়েছিলেন ‘হ্যামিলন’ নয়, রাজপথের বুড়ো-ফকির এক বাঁশিওয়ালা।
সাক্ষাৎকার: ‘ভগবান’
ছয়, সাত, আটের দশকের হিন্দি অথবা বাংলা গানে তিনি স্বচ্ছন্দে সুর তুলতেন। সুর তুলতেন তাঁর একমাত্র সঙ্গী- রঙ চটা, পোড়খাওয়া আদ্দিকালের বেহালায়। প্রায় প্রতিদিনই এই সঙ্গীকে নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়তেন শহরের পথে পথে। চাল নেই, চুলো নেই, কোথাও পৌঁছে যাওয়ার তাড়া নেই, দিন গুজরানের চিন্তা নেই। শুধু ছিল, নিত্যদিন শহরবাসীকে নিজের বাজনা শোনাবার অদম্য তাগিদ। নিজের নাম বলার সময় একটু মেজাজ নিয়েই বলতেন- ‘ভগবান দাস’।
কোনও দিন একেবারে সক্কালসক্কাল, কোনও দিন গড়িমসি করে দুপুর কিংবা বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। যাই ঘটে যাক না কেন, সঙ্গীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়া চাইই চাই। বইপাড়া, চায়ের ঠেক অথবা যে কোনও ভিড়বহুল রাস্তায় হঠাৎ করেই বেজে উঠত তাঁর বেহালা। গমগমে সুরে কেউ কেউ থমকে দাঁড়িয়ে শুনতেন, কেউ আবার গুনগুন করতে করতে বেরিয়ে পড়তেন নিজের কাজে, কেউ কেউ খুশি হয়ে ‘ভগবান’-এর হাতে তুলে দিতেন খুচরো দক্ষিণা। ভগবানের বেহালা শুনে কারও কারও খুশির মাত্রা এত বেড়ে যেত যে, তাঁরা তাঁকে ডেকে নিতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। এমনকি মাঝেমধ্যে শহরের বাইরেও আমন্ত্রণ জুটত। এই নিয়েই কেটে যায় ভগবানের জীবন।
ভগবান থাকেন গিরিশ পার্ক এলাকায়। পরবর্তী সময়ে যদি যোগাযোগ করতে হয়, আপনার নম্বরটা...আমার কথা ফুরোতে না ফুরোতে নিজেই জানিয়েছিলেন, ‘আমার ফোন নেই। ওই অঞ্চলে গিয়ে ভগবানের নাম করলে যে কেউ দেখিয়ে দেবে।‘
জন্মসূত্রে গুজরাটি হলেও, ছোটবেলা থেকেই কলকাতাবাসী এই ভগবান।
কোথায় শিখলে এ বাদ্যি?
‘আজ্ঞে বাবার কাছেই শেখা, বাবা শিখেছিলেন কোনও এক সাহেবের কাছে। বাবাও এরকমভাবে রাস্তায় ঘুরেঘুরে বাজাতেন, আমিও তাই করি। আমার দোস্ত (পুরনো বেহালা)-এর সঙ্গেই সারাদিন এভাবে কাটিয়ে দিই আমি। যে যা দেন তাতে আমার চলে যায়, ওর (পুরনো বেহালা) পেটও নেই, খিদেও নেই, তাই আমার কোনও ভাবনাও নেই।‘
ক্লাসিক্যাল, ওয়েস্টার্ন বাজাও?
‘(খানিক হতভম্ব হয়ে) শুধু পুরানা গানই আমার ভাল লাগে, ছোটবেলা থেকে তা-ই বাজাচ্ছি।‘
সেদিন সন্ধে ঘনিয়ে এসেছিল, হঠাৎ করেই বেহালায় টান দিলেন তিনি, ততক্ষণে তাঁকে ঘিরে জটলা করেছে কৌতূহলী কিছু কান, যখন যখন তিনি সুর ধরছিলেন ভিড় থেকে ভেসে আসছিল, 'আরে পুরো বেটোফেন!', 'রাস্তায় ভায়োলিন! এসব তো বিদেশে হয়'...কিছুক্ষণ পরই সেই ভিড় সরতে শুরু করে, কানাঘুষোতে বোঝা যায় প্রচুর মশার উপদ্রবে দু'দণ্ড স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না কেউই। বুঝেছিলাম সেদিন ভগবানের ভাঁড়ার শূন্য। তবে এও দেখছিলাম, কোনও ভ্রূক্ষেপ না করে একটানা মশার উপদ্রব সহ্য করতে করতেই পুরনো বেহালায় ‘পুরানা গান’ বাজিয়ে চলেছিল ভগবান। ছয়, সাত বা আটের দশক, হিন্দি অথবা বাংলা, তাঁর সুরে কোনও ভুল ছিল না। রাজপথে ভগবান বেহালা বাজিয়ে চলেছিল।
ভগবান তাঁর দোস্ত-কে নিয়ে এখন কেমন আছেন? কেমন আছেন হাঁপধরা-বংশীধারী? আমরাই বা কেমন আছি? আবার যদি কখনও ওদের সঙ্গে দেখা হয়, ভাঙাচোরা গলায় কবীর সুমনের ওই গানটা ওদেরকে গেয়ে শোনাব-
“ছেলেবেলার সেই, ছেলেবেলার সেই
বেহালা বাজানো লোকটা, চলে গেছে বেহালা নিয়েই
চলে গেছে গান শুনিয়েই...
এই পাল্টানো সময়েই, এই পাল্টানো সময়েই
সে ফিরবে কি ফিরবে না জানা নেই
ও গানওয়ালা আর একটা গান গাও
আমার আর কোথাও যাবার নেই
কিচ্ছু করার নেই...”
এ যেন এক অনিবার্য পরিহাস। চলছে তো চলছেই। এর নাম ‘গাফিলতি-ভাইরাস’, যা করোনার থেকে আরও আরও বেশি ভয়াবহ।
লোকসভার পর ১১ ডিসেম্বর রাজ্যসভাতেও পাশ হয়ে গেল নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল(সিএবি)
'ভার্চুয়াল' আর 'একচুয়াল' যেমন 'ইকুয়াল' নয়, তেমনই সংখ্যা কখনওই সাহিত্যের মাপকাঠি হতে পারে না
‘বাঙালি-ভুলানো ছড়া’ই তাহলে এবার বাংলার মসনদের চাবিকাঠি?
ও গানওয়ালা আর একটা গান গাও, আমার আর কোথাও যাবার নেই।
এ বাজারে ভাগ্যের কাছে আমরাই তো ঠকে গেছি