‘বাঙালি-ভুলানো ছড়া’ই তাহলে এবার বাংলার মসনদের চাবিকাঠি?
‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান’, ‘নোটন নোটন পায়রাগুলি ঝোটন বেঁধেছে’, ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা মধ্যিখানে চর, তারই মধ্যে বসে আছে শিব সদাগর’... আগে বাংলার ঘরে ঘরে বাড়ির বড়রা ছোটদের মন ভোলাতে এরকম অজস্র ছড়া কাটতেন। সেসব দিন এখন অতীত। প্রজন্মের সঙ্গে ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গিয়েছে ‘ছেলে-ভুলানো ছড়া’র সংস্কৃতি। সংস্কৃতির বিবর্তনে বাঙালি এখন আপন করে নিয়েছে ‘বাঙালি-ভুলানো ছড়া’।
বাঙালিরা যেমন মাতৃভাষাপ্রেমী, জাতিপ্রেমী, তেমনই উদার। কোনও অবাঙালি যদি মিষ্টি হেসে বলেন ‘হামি কলকাতার রসগুল্লা-মিষ্টি দহি খেতে খুব ভালবাসে’/‘বাংলা আমি তুমাকে ভালবাসে’ অথবা কোনও প্রবাসী বাঙালি বা কেউকেটা বাঙালি যদি বলেন ‘ইলিশ ভাপা, চিংড়ির মালাইকারি আর আলু-পোস্তটা এখনও ছাড়তে পারিনি’... ব্যস! বাঙালির আবেগ বর্ষার ভরা নদীর মতো টলটল করে ওঠে। বলাই বাহুল্য, চিন্তা-ভাবনা-কর্মের জন্য বাঙালি জাতি যেমন সারা বিশ্বে বন্দিত, তেমন তাদের আবেগও সর্বজনবিদিত। এই তো কয়েক মাস আগেরই কথা, আমেদাবাদে এসে মহান ভারতীয়দের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘বিবেকামুন্নন’- এর নাম করলেন। তাতে কি আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়েছে স্বামী বিবেকানন্দর কথা বলা হচ্ছে! সোশাল মিডিয়ায় ট্রোল, হ্যা-হ্যা-হি-হি কত কিছুই না হল তা নিয়ে। তবে, অত বড় মানুষের মুখে একজন বাঙালির নাম উঠে আসা কি চাট্টিখানি কথা!
ট্রাম্পের কথা ছেড়ে দিলাম, অনেক দূরে থাকেন। আমাদের দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, বাংলা ও বাঙালি প্রেমে তিনি তো একাই একশো! এমনিই তিনি গেরুয়াধারী, দেশের দায়িত্ব না থাকলে দিল্লির দরবার নয়, নির্ঘাত তিনি বেছে নিতেন ত্যাগের পথ; বেলুড় মঠের সন্ন্যাস জীবন। তাই তো কোনও ‘ফাইভ স্টার হোটেল’ নয়, কলকাতায় তাঁর নির্ভরযোগ্য ঠিকানা- বেলুড় মঠ। এমনকী ইতিহাস রচনা করে বেলুড় মঠ প্রাঙ্গনে সাংবাদিক সম্মেলনও করে ফেলেছেন তিনি। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের নাম নিয়ে ভক্তিরসে তিনি মূর্ছা যেতেই শুধু বাকি রেখেছেন। তবে ‘বাংগাল’ প্রেমে এবার তাঁর সংযোজন: রবীন্দ্রনাথ। ঠাকুর সব জানেন। আর সেকারণেই তো 11 জুন বণিকসভা ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্সের 95তম প্লেনারি ভাষণে রবি ঠাকুরকে স্মরণ করেছেন তিনি। প্রতিবারের মতো বিবেকানন্দকেও সঙ্গে রেখেছিলেন। তবে, ভাষণের সবটুকু ক্ষীর তিনি ঢেলে দিয়েছিলেন ঠাকুর-রচিত দু’টি লাইনে। ‘আত্মনির্ভর’ ভারতের ঝাঁকুনি দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘চলায় চলায় বাজবে জয়ের ভেরী/পায়ের বেগে পথ কেটে যায় করিস নে আর দেরি।'
সত্যিই তো, এই দু’লাইন কবিতা বলার কসরত দেখলেই অনুমান করা যায়, বাংলার কথা তিনি কতটা ভাবেন। আশা করা যায় আপামর বাঙালি জাতিও তাতে ‘মাইন্ড’ করেননি, আগেই বলেছি তারা উদার। প্রধানমন্ত্রী তো আর ‘রোদ্দুর রায়’ নন! তিনি মান্যি-গণ্যি মানুষ, তাঁকে প্রশ্ন করার ধৃষ্টতা কারও নেই। তা-ও তিনি যখন রবীন্দ্রনাথ মুখস্থ করেই ফেলেছেন, তাই জানতে বড় সাধ হচ্ছে, তিনি কি বাংলার গুরুদেব তথা রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’, ‘স্বদেশী সমাজ’ ইত্যাদি প্রবন্ধ পড়েছেন? আসলে, প্রবন্ধগুলিতে প্রধানমন্ত্রী বর্ণিত সিলেবাসের বিভিন্ন সাবজেক্ট রয়েছে। যা বোঝা যাচ্ছে, করোনা-টরোনা উপেক্ষা করে বাংলার মসনদের পরীক্ষা তিনি নেবেনই। তা-ই বলছি, রবীন্দ্রনাথের মান-সম্মান, চুল-দাড়ি সহ যাবতীয় স্বত্বের অধিকারী অধুনা বাঙালি জাতি, আপনারাও দেরি না করে পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করে দিন।
‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ একটি অনুচ্ছেদে লিখেছেন:
“আমাদের প্রথম বয়সে ভারতমাতা, ভারতলক্ষী প্রভৃতি শব্দগুলি বৃহদায়তন লাভ করিয়া আমাদের কল্পনাকে আচ্ছন্ন করিয়াছিল। কিন্তু মাতা যে কোথায় প্রত্যক্ষ আছেন, তাহা কখনো স্পষ্ট করিয়া ভাবি নাই-লক্ষী দূরে থাকুন, তাঁহার পেচকটাকে পর্ষন্ত কখনো চক্ষে দেখি নাই। আমরা বায়রনের কাব্য পড়িয়াছিলাম, গারিবলডির জীবনী আলোচনা করিয়াছিলাম এবং প্যাট্রিয়টিজমের ভাবরস-সম্ভোগের নেশায় একেবারে তলাইয়া গিয়েছিলাম।
মাতালের পক্ষে মদ্য যেরূপ খাদ্যের অপেক্ষা প্রিয় হয়, আমাদের পক্ষেও দেশহিতৈষণার নেশা স্বয়ং দেশের চেয়েও বড় হইয়া উঠিয়াছে। যে দেশ প্রত্যক্ষ তাহার ভাষাকে বিস্মৃত হইয়া, তাহার ইতিহাসকে অপমান করিয়া, তাহার সুখ-দু:খকে নিজের জীবনযাত্রা হইতে বহু দূরে রাখিয়াও আমরা দেশহিতৈষী হইতেছিলাম।”
আবার একই বইয়ের ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন:
“আমি স্পষ্ট করিয়া বলিতেছি রাজা আমাদিগকে মাঝে মাঝে লগুঢ়াঘাতে তাহার সিংহদ্বার হইতে খেদাইতেছেন বলিয়াই যে অগত্যা আত্মনির্ভরকে শ্রেয় জ্ঞান করিতেছে, কোনওদিনই আমি এরূপ দুর্লভ-দ্রাক্ষাগুচ্ছ-লুব্ধ হতভাগ্য শৃগালের সান্তনাকে আশ্রয় করি নাই। আমি এই কথাই বলি, পরের প্রসাদভিক্ষাই যথার্থ ‘পেসিমিস্ট’ আশাহীন দিনের লক্ষণ। গলায় কাছা না লইলে আমাদের গতি নাই এ-কথা আমি কোনোমতেই বলিব না; আমি স্বদেশকে বিশ্বাস করি, আমি আত্মশক্তিকে সম্মান করি। আমি নিশ্চয়ই জানি যে, যে উপায়েই হউক, আমরা নিজের মধ্যে ঐক্য উপলব্ধি করিয়া আজ যে সার্থকতা লাভের জন্য উৎসুক হইয়াছি, তাহার ভিত্তি যদি পরের পরিবর্তনশীল প্রসন্নতার উপরেই প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তাহা পুন:পুন:ই ব্যর্থ হইতে থাকে। অতএব ভারতবর্ষের যথার্থ পথটি যে কী, আমাদিগকে চারি দিক হইতেই তাহার সন্ধান করিতে হইবে।”
যা দেখা যাচ্ছে, খাবার ‘বেচা-কেনা-খাওয়া’ই এখন মানুষের সব থেকে বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
'ভার্চুয়াল' আর 'একচুয়াল' যেমন 'ইকুয়াল' নয়, তেমনই সংখ্যা কখনওই সাহিত্যের মাপকাঠি হতে পারে না
এ বাজারে ভাগ্যের কাছে আমরাই তো ঠকে গেছি
5 এপ্রিল, রাত ন’টা থেকে প্রায় দশটা পর্যন্ত, কিছু দৃশ্য আমাদের দেখানো হয়েছে; একটা খারাপ সিনেমা।
মাতৃভাষার জন্য তরুণদের আত্মবলিদান পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের যে কোনও ভাষার মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার।
তাঁর সাহিত্য সাধনায় তিনি খুঁজেছেন অখণ্ড মনুষ্যত্বকে এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ককে