সাহিত্যসেবার পথেই দেশের সেবা : তারাশঙ্কর
হাঁসুলী বাঁকের উপকথা-র মুখবন্ধে রয়েছে, 1355 বঙ্গাব্দে আষাঢ় মাসে বীরভূমের লাভপুরে বসে কবি কালিদাস রায় (দাদা)-কে পাণ্ড়ুলিপি দিয়ে তারাশঙ্কর চিঠি লিখেছিলেন,
“দাদা,
রাঢ়ের ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ আপনার অজানা নয়। সেখানকার মাটি, মানুষ, তাদের অপভ্রংশ ভাষা— সবই আপনার সুপরিচিত। তাদের প্রাণের ভোমরা-ভোমরীর কালো রঙ ও গুঞ্জন আপনার পল্লীজীবনের ছবি ও গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এই মানুষের কথা শিক্ষিত সমাজের কাছে কেমন লাগবে জানি না। তুলে দিলাম আপনার হাতে।”
লাভপুর ও লাল-মাটির বাংলা বারবারই তাঁর লেখায় অন্য মাত্রা পেয়েছে। বিশ শতকের তিনের দশকের অন্যান্য সাহিত্যিকদের মধ্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবরই অনন্য। অকৃত্রিম পল্লীসমাজ আর শহুরে সমাজের কৃত্রিম নাগরিক জীবনকে তিনি ধারাবাহিকভাবে তাঁর লেখায় মিশিয়ে দিয়েছিলেন, যা তাঁর উপন্যাস এবং ছোটগল্পের ধারাকে প্রকৃতি থেকে বাস্তবময়তায় পৌঁছে দিয়েছিল। তাঁর লেখা চিঠিতেই সে আভাস মেলে।সাহিত্য জগতে তাঁর পদার্পণের আগেই বাস্তবধর্মী উপন্যাসের ধারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল রবীন্দ্র, বঙ্কিম এবং শরৎচন্দ্রের সৃষ্টির মাধ্যমে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণের মতোই বিংশ শতকের যে লেখকেরা সাহিত্যের কাব্যময়তাকে ভেঙে জীবনের প্রতক্ষ অভিজ্ঞতাকে লেখায় স্থান দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। 23 জুলাই সেই সংগ্রামী লেখকের 122তম জন্মবার্ষিকী।
কেন তাঁকে ‘সংগ্রামী’ সম্বোধন করলাম তা পরে বলছি। জীবনকে নানা দিক থেকে দেখেছিলেন তিনি। অস্থির, সংশয়-বিক্ষুব্ধ, অবিশ্বাসী যুগের প্রধান কথাশিল্পী তারাশঙ্কর তার জীবনে দেখেছেন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, অহিংস আন্দোলন, সাম্যবাদী আন্দোলন, 42-এর সংগ্রাম, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও দেশভাগ, বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও ভাষা আন্দোলন। সেই সঙ্গে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভীক্ষ মহামারী, মন্বন্তর, উদ্বাস্তু সমস্যা, অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামের জমিদার পরিবারে জন্ম নেন তারাশঙ্কর। তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর পিসিমা চেয়েছিলেন তারাশঙ্কর জমিদার হয়ে উঠুক কিন্তু তাঁর মা চাইতেন ছেলে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে স্বনির্ভর এবং স্বাধীন মানুষ হয়ে উঠুক। ছোটবেলা থেকেই ঘন ঘন ম্যালেরিয়ায় ভুগে ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী তারাশঙ্কর প্রথমবার প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলেও দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য বহরমপুর যান এবং সেখানে স্থান না পেয়ে প্রথমবার কলকাতায় আসেন এবং বিভিন্ন কলেজে চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই কলেজের অধ্যয়ন শেষ করতে হয় তাঁকে, কারণ তখন তিনি বিপ্লবী সংগঠনে যুক্ত হয়ে পড়েন। এর ফলে ইংরেজ শাসকদের নজরে পড়ে তাঁকে কিছুদিন গৃহবন্দিও থাকতে হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁর বন্দিদশার অবসান হলে তিনি সাউথ সাবারবান (আশুতোষ কলেজ) কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু ম্যালেরিয়ার প্রকোপে পড়াশোনা বন্ধ করে তাঁকে লাভপুরে ফিরে আসতে হয়। এই সময় উমাশশীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু তাঁর কথা অনুযায়ী, তাঁর দাম্পত্যজীবন ছিল কলহ ও বিমর্ষতায় ভরা।
যৌবনে তারাশঙ্কর প্রভাবিত হয়েছিলেন বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের আদর্শের দ্বারা। গ্রামের সমাজসেবক সমিতির উদ্যোগে মুষ্ঠিভিক্ষাসংগ্রহ, অগ্নিনির্বাপণের কাজে আত্মনিয়োগ করেন ও সাধারণ মানুষের সেবায় ব্রতী হন। এরই পাশে সমান্তরালভাবে ছিল রাজনৈতিক আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা। সশস্ত্র বিপ্লব বা হিংসাত্মক বিপ্লবীদের পথ থেকে অচিরেই সরে এসে তিনি যুক্ত হন অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে। অসহযোগ আন্দোলনের পর 1930 সালে আইন অমান্য আন্দোলনে সক্রিয় যোগদানের জন্য তিনি ছ’মাস কারারুদ্ধ থাকেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি উপলব্ধি করেন ‘সাহিত্যসেবার পথেই দেশের সেবা'। 1934 সালের কল্লোল পত্রিকার ফাল্গুন সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘রসকলি' প্রকাশিত হয়। তিনি বলেছিলেন বিদ্রোহ এবং বিপ্লবে প্রভেদ আছে। তাঁর রচনার সমাপ্তি-পদ্ধতি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তাঁর রচনার ভেতর ভেঙে নতুন করে গড়ার গভীর স্বপ্ন ছিল। হাঁসুলী বাঁকের... একেবারে শেষ দিকে তিনি বলেছিলেন,
“উপকথার ছোট নদীটি ইতিহাসের বড় নদীতে মিশে গেল।
কাহারেরা এখন নতুন মানুষ। পোষাকে-কথায়-বিশ্বাসে তারা অনেকটা পালটে গিয়েছে। মাটি ধুলো কাদার বদলে মাখে তেলকালি, লাঙল কাস্তের বদলে কারবার করে হাম্বর-শাবল-গাঁইতি নিয়ে। তবে চন্ননপুরের কারখানায় খেটেও তারা না খেয়ে মরে, রোগে মরে, সাপের কামড়ের বদলে কলে কেটে মরে, গাড়ি চাপা পড়ে মরে। কিন্তু তার জন্য বাবাঠাকুরকে ডাকে না! ইতিহাসের নদীতে নৌকা ভাসিয়ে তাদের তাকাতে হচ্ছে কম্পাসের দিকে—বাতাস-দেখার যন্ত্রটার দিকে!”
ঠিক এই কারণেই তাঁকে ‘সংগ্রামী’ সম্বোধন করা।
তাঁর রচিত গল্পগুলির মধ্যে অন্যতম- রসকলি, মালাচন্দন, হারানো সুর, জলসাঘর, রায়বাড়ী, কুলীনের মেয়ে, মধুমাষ্টার, ব্যাধী, বিষধর, রঙীন চশমা,অগ্রদানী, তারিনীমাঝি, বেদেনী, ব্যার্ঘচর্ম, মরামাটি, অহেতুক, শেষকথা, মতিলাল, কালাপাহাড়, দেবতার ব্যাধি, ইমারত প্রভৃতি। তাঁর গল্পগুলিতে অন্তজ শ্রেণীর চরিত্ররা বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। ‘প্রবাসী' পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ডাইনী' গল্পটি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
1940 খ্রীষ্টাব্দে বাগবাজারে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে সপরিবারে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। 1941 সালে উত্তর কলকাতার বরানগরের একটা বাড়িতে উঠে এসেছিলেন। তারপর 1948 সালে টালা পার্কের বাড়িতে তিনি স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে শুরু করেন । 1955 খ্রীষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে তিনি ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ পান। 1950 সালে জগত্তারিনী গোল্ড মেডেল পান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে। 1960 সালে রাষ্ট্রপতির নির্দেশ অনুসারে তিনি রাজ্যসভার সদস্যপদ গ্রহন করেন। 1966 সালে তিনি এই সদস্যপদ থেকে নির্বাসন নেন। 1962 সালে তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত করা হয় ও 1969 সালে তিনি লাভ করেন ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি। ওই একই সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ডক্টর অফ লিটেরেচার’ সম্মান প্রদান করে এবং তিনি সাহিত্য একাডেমির পক্ষ থেকে ফেলোশিপ পান।
1970-এ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি হিসাবে নিযুক্ত হন। 1971-এ তাঁর মৃত্যু হয় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরনের জন্য। উত্তর কলকাতার নিমতলা মহাশ্মশানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়েছিল। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন পরবর্তীকালের শিল্পীরা, যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সত্যজিৎ রায়। তারাশঙ্করের উপন্যাস, গল্প ও নাটক নিয়ে চল্লিশটিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সেগুলির মধ্যে বাংলা ছবির ধারক হিসেবে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘জলসাঘর’ (1958 খ্রিঃ) ও ‘অভিযান’(1962) , পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘অগ্রদানী’ (1983), অসিত সেন পরিচালিত ‘আগুন’ (1962), বিজয় বসু পরিচালিত ‘আরোগ্য নিকেতন’ (1969), অগ্রদূতের ‘উত্তরায়ণ’ ( 1963), দেবকী বসু’র ‘কবি’ ( 1949), তরুণ মজুমদার পরিচালিত ‘গণদেবতা’, (1979), তপন সিংহ পরিচালিত ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ (1962) প্রভৃতি নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য।
তারাশঙ্কর উপন্যাস লিখেছেন প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এবং তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা ষাট। প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘূর্নী' প্রকাশিত হয় 1931 সালে এবং শেষ উপন্যাস ‘নবদীগন্ত' প্রকাশ পায় 1973 খ্রিস্টাব্দে। তাঁর লেখা উপন্যাসগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য - পাষানপূরী(1933), নীলকন্ঠ(1933),রাইকমল(1934), প্রেম ও প্রয়োজন(1935), ধাত্রীদেবতা(1939),গনদেবতা(1942), কবি(1944), হাসুলি বাঁকের উপকথা(1947),আরোগ্যনিকেতন(1953), সপ্তপদী(1957), মহাশ্বেতা(1960), যোগভ্রষ্ট(1960), কালবৈশাখী(1963), ভূবনপুরের হাট(1964),ইত্যাদি।
তারাশঙ্করের জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে, বাংলার আঞ্চলিক জীবনকে ব্যাপকভাবে উপন্যাসে টেনে আনা এবং ছোট গল্পগুলোতে তুলে ধরা। তাই বাংলা আঞ্চলিক উপন্যাসের শ্রেষ্ঠ শিল্পী মনে করা হয় তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়কে। বীরভূমের রাঢ় অঞ্চলের বিচিত্র পরিবেশের মধ্যেই তাঁর শৈশব, বাল্য, এবং কৈশোর অতিক্রান্ত হয়েছিল। ফলে সেখানের ভূ-প্রকৃতি, আড়ম্বরহীন জনজীবন এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির উপাদান হিসেবে স্থান পেয়েছে।
তাঁর মতে মানুষের লক্ষ্য শুধু দেশের রাজনৈতিক মুক্তি বা অর্থনৈতিক উন্নতি নয়, ভয় থেকে, হীনতা থেকে ও দৈন্যতা থেকে মুক্তি। তাঁর সাহিত্য সাধনায় তিনি খুঁজেছেন অখণ্ড মনুষ্যত্বকে এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ককে। হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় যেমন তিনি লিখেছিলেন,
“পাগল গান ধরে-
জল ফেলিতে নাই চোখে জল ফেলিতে নাই,
বিধাতা বুড়ার খেলা দেখে যা রে ভাই।
পাগল গানের মধ্যেই কাহারপাড়ার আদিকাল থেকে একাল পর্যন্ত সুচাঁদের হাঁসুলী বাঁকের উপকথাকে গান গেয়ে বলে যায়। সর্বাগ্রে বলে—সৃষ্টিতত্ত্ব;শেষে বলে সেই শেষ কথা—দুঃখই বা কিসের, চোখের জলই বা ফেলছ কেনে? ভাঙা গড়া—হল বিধাতা বুড়োর খেলা। একটা ভাঙে একটা গড়ে—এই চলছে আদিকাল থেকে। ছেলেরা যেমন বালি দিয়ে ঘর গড়ে আবার ভাঙে, মুখে বলে—হাতের সুখে গড়লাম, পায়ের সুখে ভাঙলাম, ঠিক তেমনি, ঠিক তেমনি, ঠিক তেমনি!”
সারাজীবন তিনি নিজে যা প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং বিশ্বাস করতেন সেইগুলোই লিখেছেন শুধু। সে সময়ের তথাকথিত সংকীর্ন মানবচিন্তাকে উপলব্ধী করে তিনি চেয়েছিলেন, দ্বিধা-দ্বিচারিতা অপসারিত হয়ে এক স্পষ্টবাদী , স্বাধীন, উদারমনস্ক মানবসমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক, আর আমরাও চাই তা-ই হোক। প্রজন্মের পর প্রজন্মে, কালের প্রবাহে ইতিহাস থেকে বর্তমানে উজ্জ্বল হয়ে থাক সেইসব তারা... তারাশঙ্কর।
NRC, NPR, CAB, CASTEISM, 'RELIGIOUS' PARTY-POLITICTS— সভ্য, শিক্ষিত, শান্তিপ্রেমী দেশে এ সবের দরকার
মাতৃভাষার জন্য তরুণদের আত্মবলিদান পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের যে কোনও ভাষার মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার।
এ বাজারে ভাগ্যের কাছে আমরাই তো ঠকে গেছি
তাঁর সাহিত্য সাধনায় তিনি খুঁজেছেন অখণ্ড মনুষ্যত্বকে এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ককে
'ভার্চুয়াল' আর 'একচুয়াল' যেমন 'ইকুয়াল' নয়, তেমনই সংখ্যা কখনওই সাহিত্যের মাপকাঠি হতে পারে না
লোকসভার পর ১১ ডিসেম্বর রাজ্যসভাতেও পাশ হয়ে গেল নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল(সিএবি)