×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • বড় মাঠে খেলার প্রস্তুতি তৃণমূলে

    বিতান ঘোষ | 12-06-2021

    পুরনো সাকিনে প্রত্যাবর্তন মুকুলের।

    রাজ্যে বিজেপিকে হারিয়ে বিপুল সাফল্য পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। ভোটের আগে একের পর এক নেতার বিজেপিতে যাওয়া এবং তাঁদের অনুগামীদের সেই দলে অনুগমন চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বকে। বিজেপি সহ বিরোধীদের মুখে প্রায়ই বক্রোক্তি শোনা যেত, "তৃণমূল দলটাই ভোটের পর উঠে যাবে'। আপাতত সেইসব সম্ভাবনা নস্যাৎ করে, তৃতীয়বারের জন্য বঙ্গ-জয় করে দলীয় সংগঠনকে মজবুত করতে উদ্যোগী হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলের এই মধুমাসে একদা দলের সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড মুকুল রায় প্রায় সাড়ে তিন বছরের বিজেপি সঙ্গ ত্যাগ করে পুরনো দলেই ফিরে এসেছেন। একদা তৃণমূলের সংগঠনকে হাতের তালুর মতো চেনা মুকুল রায়ের "ঘর ওয়াপসি' নিশ্চিতভাবেই তৃণমূলের সাংগঠনিক বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা নেবে।

     

     

    তৃণমূলের সাংগঠনিক পরিবর্তনে সর্বাধিক আলোচিত হচ্ছে, "এক ব্যক্তি, এক পদ' নীতি। সচরাচর মধ্য ও দক্ষিণপন্থী দলগুলিতে প্রভাবশালী নেতার একাধিক পদ আঁকড়ে বসে থাকার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তৃণমূলও তার ব্যতিক্রম ছিল না, এই কিছুকাল আগে পর্যন্তও। মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা সংগঠনেও নীতি নির্ণায়ক ভূমিকায় থাকতেন। তবে দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ায়, প্রভাবশালী এমন অনেক নেতা বিজেপিতে চলে যাওয়ায় ভুল থেকে শিক্ষা নিতে চাইছে তৃণমূল। এ ব্যাপারে ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরেরও একটা অবদান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভোটের অনেক আগে থেকেই জেলাভিত্তিক "অবজার্ভার' পদ তুলে দিয়ে, জেলা প্রতি একজন সভাপতি ও চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে সংগঠনকে আগের তুলনায় 'সাম্যবাদী' করার চেষ্টা করে গেছেন প্রশান্ত এবং তাঁর সংস্থা আই-প্যাক। এর ফলে জেলার একমেবাদ্বিতীয়ম নেতাদের বিরাগভাজন হয়েছেন প্রশান্ত। এদের অনেকেই দলের প্রতি ক্ষোভ উগরে ভোটের আগে দল ছেড়েছেন। আর এইসব নেতাদের বিরুদ্ধ গোষ্ঠী প্রথমবারের জন্য শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে। ভোটের ফলাফল বলছে এইসব নেতাদের অধিকাংশই বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছেন। সুতরাং, জেলার দায়িত্ব কোনও একজন বিশেষ নেতার হাতে ছেড়ে আর নিশ্চিন্ত হতে নারাজ তৃণমূল। সংগঠনে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণই এখন তাদের লক্ষ্য!

     

    আরও পড়ুন: ‘দিদি’র কাছে আশ্রয় নিতে বাধ্য করলেন প্রধানমন্ত্রী

     

    দ্বিতীয় যে পরিবর্তনটা নিয়ে আলোচনা চলছে তা হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভ্রাতুষ্পুত্র অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের "জাতীয়' ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক "অভিষেক'। 2017 সালে মুকুল রায়ের তৃণমূল ছাড়া ইস্তক সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পদটি কার্যত গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিল। এমনিতে অ-বাম দলগুলির ক্ষেত্রে সভাপতিই সংগঠনের সর্বোচ্চ পদাধিকারী হয়ে থাকেন। সচরাচর এইসব দলগুলিতে সাধারণ সম্পাদক পদে একাধিক ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা হয়। তৃণমূলে অবশ্য গোড়া থেকে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পদটির একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে। বকলমে এই পদাধিকারীকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরেই দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। এতকাল এই পদে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একান্ত আস্থাভাজন সুব্রত বক্সী। রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব সামলাবার পাশাপাশি তিনি এই অতিরিক্ত দায়িত্বও সামলাতেন। এবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই পদে তুলে আনল তৃণমূল। 2011 সালে রাজ্যে পরিবর্তনের পর "তৃণমূল যুবা' নামক একটি নতুন সংগঠন তৈরি করে অভিষেককে তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তৃণমূলের যুব সংগঠন, তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সমান্তরাল সংগঠন হিসাবে এই সংগঠনটিকেও কিছুকাল রেখে দেওয়া হয়। তারপর যথাক্রমে তৃণমূলের সাংসদ এবং তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে দলের একদম প্রথম সারিতে উঠে আসেন অভিষেক। অভিষেকের এই চকিত উত্থান দলের অনেক প্রবীণ নেতাই ভালভাবে মেনে নেননি। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, এই নেতাদের অধিকাংশই এখন বিজেপির নেতা। আবার 2017 সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়ে যে মুকুল রায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ এনেছিলেন, সেই মুকুল রায়ই তৃণমূল ফিরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে জড়িয়ে ধরলেন। রাজনীতি সম্ভাব্যতার শিল্প, এখানে  সবই সম্ভব৷ তৃণমূলের মতো জনবাদী, কিঞ্চিৎ অগোছালো দলে এই অসম্ভব ব্যাপারগুলো বারবার সম্ভব হয়। এসব দেখে শুনে দলের কর্মী সমর্থকরা আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলেন, "আমাদের নেত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই, মেলাবেন তিনি মেলাবেন।'

     

     

    2019-এর লোকসভা ভোটে নির্বাচনী কলাকৌশল তৈরি এবং তার পর্যালোচনায় একটা বড় দায়িত্ব ছিল অভিষেকের ওপর। সেই নির্বাচনে তৃণমূল প্রত্যাশিত ফল করতে না পারায় এবং প্রধান বিরোধী হিসাবে বিজেপি দ্রুত উঠে আসায় সমালোচনার মুখে পড়ে অভিষেকের কৌশল। দলের অন্দরে-বাইরে মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহাস্পদ হিসাব্ব সুখি-ভুখী নেতা বলেও তাঁর সমালোচনা করা হয়। কিন্তু এবারের বিধানসভা নির্বাচনে সকল সমালোচনাকে অগ্রাহ্য করে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন অভিষেক। প্রধানমন্ত্রী মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সহ বিজেপির বড়-মেজ নেতাদের ভাইপো বিদ্রুপে রাজনৈতিক ভাবে আরও প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান অভিষেক। তৃণমূলের মতো ব্যক্তিকেন্দ্রিক, আবেগসর্বস্ব দলে কর্পোরেট অনুপান মিশিয়ে যে রাজনৈতিক সমীকরণ অভিষেক-প্রশান্ত জুটি তৈরি করেন, তাতেই মাত হয় বিজেপি।

     

    আরও পড়ুন: মেরুকরণের শাখা পল্লবিত হল না বাংলায়

     

    নিজেদের গড় রক্ষা করে তৃণমূলের লক্ষ্য এখন 2024। প্রাথমিকভাবে পশ্চিমবঙ্গ লাগোয়া অন্যান্য রাজ্যে ও পরে তুলনায় দূরের রাজ্যগুলিতেও সংগঠন বিস্তারে মন দিতে চায় তারা। অভিষেকের মতো যুব মুখকে সামনে রেখে সেই লক্ষ্যেই কাজ করা শুরু করল তৃণমূল। তবে, বিরোধীদের একাংশ এর মধ্যে পরিবারতন্ত্রের ছায়াও দেখতে পাচ্ছেন। এত প্রবীণ, অভিজ্ঞ নেতা থাকা সত্ত্বেও অভিষেকই কেন দলের শীর্ষ পদাধিকারী হবেন, প্রশ্ন তাঁদের। তৃণমূলের মুখপাত্র দেবাংশু ভট্টাচার্য অবশ্য বিরোধীদের এসব সমালোচনাকে পাত্তা দিতে নারাজ। তাঁর কথায়, "এটা তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমরাই পারি যুবদের রাজনীতিতে যথাযোগ্য স্থান করে দিতে।' তাঁর টিপ্পনি, "বিজেপির মুখে পরিবারতন্ত্রের কথা মানায় না, তাহলে জয় শাহরা লজ্জা পাবেন।' প্রসঙ্গত, ভোটের আগে অভিনয় জগত থেকে রাজনীতিতে এসে প্রার্থী হওয়া কিছু নবীন তারকা-চরিত্রকেও সাংগঠনিক পদে বসিয়েছে তৃণমূল। তারও আগে বিজেপির মোকাবিলায় কিছু "আনকোরা' তরুণকে দলীয় মুখপাত্র করে চমক দিয়েছে তৃণমূল। এদের মধ্যে অনেকেই টেলিভিশন ও সোশাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। দেবাংশু তাঁদের অন্যতম। তবে, মুকুল রায় দলে ফেরায় সংগঠনে প্রবীণ-নবীনে একটা ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা হতে পারে।

     

     

    বামেরাও এবারের নির্বাচনে যুব প্রতিনিধিদের বিভিন্ন কেন্দ্রে লড়তে পাঠিয়েছিল। তাঁদের সবাই পরাজিত হলেও, তাঁদের লড়াই, হার না মানা মনোভাব অনেকেরই নজর কেড়েছে। কিন্তু বামেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এই সকল তরুণ-যুবদের সংগঠনে বড় পদে আনা হয় না, সেখানে এখনও পলিতকেশদেরই রমরমা। বামপন্থী দলে নিয়মশৃঙ্খলার জাঁতাকলে অনেক সময়োপযোগী পরিবর্তনই সঠিক সময়ে করা যায় না। তৃণমূলের মতো ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলে সেই অসুবিধা নেই। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখে, জনআবেগকে পুঁজি করে, কর্পোরেট কায়দায় এখন সেখানে সবুজের অভিযান আর ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ চলছে। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফিরতেই দলের সদস্যপদ প্রত্যাশীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। শাসকদল হিসাবে বিবিধ স্বার্থগোষ্ঠীর বিচিত্র প্রত্যাশায় লাগাম পরিয়ে, সকলকে নিয়ে চলার স্থৈর্য ও প্রজ্ঞাও দেখাতে হবে তৃণমূলকে। সেই স্থৈর্য ও প্রজ্ঞার পরীক্ষায় দলীয় সংগঠনকে উত্তীর্ণ  করার জন্যই হয়তো হিমশীতল মস্তিষ্কের মুকুলকে সাদরে ফিরিয়ে নিল তৃণমূল।


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    বিশ্বে ট্রেন নিয়ে অনেক গল্পগাথা আছে। কত গল্প প্রাণ পেয়েছে ট্রেনের কামরায়।

    শুধুই কি উন্মাদনা, জনারণ্য আর আবেগ? মানুষের রুজিরুটিও তো এসব মেঠো সভা সমাবেশের সঙ্গে যুক্ত ছিল

    শহরের বৈচিত্র্যময় মিছিলে বিভাজন রোখার ডাক।

    কুমিল্লার দেবীমূর্তি কিংবা অযোধ্যার মসজিদ- ধর্মে নয়, ঘা পড়ছে উপমহাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনায়।

    সংবিধান দিবসের স্মরণ: নাগরিকের কাছে ধর্মগ্রন্থের মতোই পবিত্র এই নথি।

    শ্যামাপ্রসাদ ‘সাম্প্রদায়িকতা' নামক রোগে আক্রান্ত হলে, সেই রোগের উৎস খুঁজে সেটা নির্মূল করতে হবে।

    বড় মাঠে খেলার প্রস্তুতি তৃণমূলে-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested