শান্ত, নির্জন দুপুরে মাথার ঝাঁকড়া চুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাউল গেয়ে চলেছেন, "চড়িয়া মানব গাড়ি, যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি; মধ্যপথে ঠেকল গাড়ি, উপায় বুদ্ধি মেলে না, গাড়ি চলে না...।' গানটা আগে বহুবার শুনলেও, এই করোনাকালে গানটার যেন অন্য তাৎপর্য খুঁজে পেলাম। মহামারী এই পৃথিবীর চলমান জীবন-গাড়িকে সহসাই থামিয়ে দিয়েছে। তার জন্য কোনও মানুষকে "এই রোকো' বলে হাঁক পাড়তে হয়নি। দুর্দমনীয় রোগের হাত থেকে নিস্তার পেতে দুয়ার এঁটেছে জগৎ সংসার। কিন্তু এই নিভৃত পরবাসে মনে পড়ছে এক চলমান জীবন সংসারের কথা। সেই সংসারের একজন সদস্য হিসাবে বড় মনে পড়ছে সংসারের বাকি সদস্যদের কথাও।
এই সংসারের বিস্তৃতি গ্রাম থেকে মফঃস্বল হয়ে সেই মহানগর পর্যন্ত। লোহার কিছু ছুটন্ত চাকা, আর তার উপর কয়েকটা খোপের মধ্যে বিচিত্র সে সংসার। কেউ কাঁদছে, কেউ হাসছে, কেউ হাসাচ্ছে, কেউ বা সহযাত্রীর গায়ে ঘুমে ঢলে পড়ছে। আপনি যতই বিরস মনে সেই সংসারে ঢুকে পড়ুন না কেন, সেখানে বৈচিত্রের সম্ভার দেখে এমনিই আপনার মন হালকা হয়ে যাবে। কেউ সেখানে ক্রীড়া বিশ্লেষক, কেউ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক! "শুনেছ কাকা কাল মেসি গোল না পাওয়ায় অরুণদা মুখে কিছু দেয়নি', বলে শ্লেষ উড়ে এল, কামরার কোণের দিক থেকে। অন্যদিক থেকে ঝটিতি উত্তর, "তোদের দল যতদিন ক্ষমতায় থাকবে, ততদিন কি কিছু পেট পুড়ে খাওয়ার জো আছে রে? মেসির গোল না পাওয়াটা তো বাহানা। আসলে সঞ্চয় করছি বুঝলি!' ব্যাস হইহই শুরু। দেখতে দেখতে সংসারের কিছু লোক তাদের গন্তব্যে নেমে গেলেন, আবার কিছু মানুষ যুক্তও হলেন। দরজার সামনে "দাদা আমার পা-টা', "ও দাদা আর একটু কাত হোন না' ইত্যাদি উড়ে আসা কিছু শব্দ আর আকুতি। ব্যাস তারপর আবার সব শান্ত। সংসারে এ'টুকু অ্যাডজাস্টমেন্ট তো করতেই হবে।
এইসব কলরব থেকে মনোযোগ সরিয়ে একটু হয়তো সদ্য কেনা খবরের কাগজটায় মনোনিবেশ করেছি। হঠাৎ, সুরেলা গলায় "লালু-ভুলু-কালু অল টাইম চালু'। সকলের দৃষ্টিপথ অনুসরণ করে দেখি, জনৈক হকার ভদ্রলোক লাল-নীল-কালো তিনটি পেনকে দেওয়ালে ক্রমাগত আছাড় মারছেন, আর বলছেন "লিখুন, আছাড় মারুন, আবার লিখুন। গ্যারান্টি পেনের বল নষ্ট হবে না।' সামনের সহযাত্রীরা পেন কেনায় ব্যস্ত। এমন সময় দরজার কাছে এক মহিলা কণ্ঠের চিৎকার। "এ কচি লাব, লাব, চিকার উঠিছে রে।' কচি! সে আবার কে? কারও নাম? সামনে বসে থাকা যাত্রী মুড়ি চিবোতে চিবোতে হেসে বললেন, "বুঝলে না? গ্রামের দিকে ছোট ছেলেমেয়েদের "কচি' বলে ডাকা হয়। কম্পার্টমেন্টে টিটি উঠেছে। উনি হয়তো টিকিট কাটেননি। তাই ওনার ছেলেমেয়েদের নামতে বলছেন।' শুনে আমার তো বিস্ময়ের ঘোর কাটে না।
চলমান সংসার তখন শহরের বড় জংশনে ঢুকব ঢুকব করছে। নাবালক সন্তানকে নিয়ে মা গান গাইতে এগিয়ে আসছেন, "সকলই ফুরায়ে যায় মা...'। তার খোলা হাতে কয়েনের টুংটাং শব্দে হঠাৎ যেন ঘোর কেটে যায়। সংসার তখন প্রায় ফাঁকা। কান্না-হাসির দোল দোলানো ছেড়ে সবাই এবার নিজ নিজ গন্তব্যে। আমি মাঝেমধ্যে থমকে দাঁড়াই। এই নাতিদীর্ঘ যাত্রাপথে কত গল্প লেখা হল, কত অচেনা মুখের সারি দেখলাম তার হিসাব করি। শুনেছি বধির মানুষ শব্দের অভাবে একদিন নির্বাক হয়ে যান। আমি টের পাই মহামারী মনটাকেও এমন বধির করে দিচ্ছে। গল্প বলার, লেখার রসদে টান পড়ে গেছে ইতিমধ্যেই। এতদিনে ওই সংসারের সদস্যরা সব কোথায় আছে, কেমন করে আছে, তাও জানি না।
বিশ্বে ট্রেন নিয়ে অনেক গল্পগাথা আছে। কত গল্প প্রাণ পেয়েছে ট্রেনের কামরায়। রাওলিং-এর হ্যারি পটারের সৃষ্টিও তো এভাবেই হয়েছে। শাহিদ আমিনের ‘Gandhi as Mahatma'-তে পড়েছিলাম, গান্ধী যে দেশবাসীর কাছে ঋষিতুল্য গান্ধী মহারাজ হলেন আর তাঁকে নিয়ে নানা কিংবদন্তী তৈরি হতে লাগল, তার জন্য এই ট্রেনের একটা বড় ভূমিকা ছিল। গান্ধী ট্রেন পথে ভারতের অলিতে গলিতে পৌঁছে গিয়ে দেশের মুক্তির গল্প বিলোতেন। কিন্তু, আপাতত সব গল্পে একটা যতিচিহ্ন পড়ে গেছে। জানিনা আবার কবে তা আগের মতো সচল হবে। বুভুক্ষু মন কিছু গল্প চাইছে। রেলগাড়ির ধাতব শব্দের মাঝে অনেকদিন জীবনের গল্প শোনা হয়নি। কিন্তু সেই গল্প রচবে কারা? মহামারী গল্পের চরিত্রগুলোকেই যে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে।
মানবাধিকার নয়, নাগরিকত্ব প্রদানও নয়, শাসকদলের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নটাই মূলকথা।
তথাকথিত উন্নয়নের পক্ষে সুবিধাজনক হাতিদের সন্দেহজনক মৃত্যুতে তদন্ত কমিটি।
নিছক খাওয়া-পরা নয়, দুর্গতদের পড়াশোনা আর স্বাস্থ্যেও সমান নজর দিতে চাইছে ‘জোনাকি’।
সহিষ্ণু আর সময়ানুবর্তী হওয়ার পাঠ যাদের দেওয়ার কথা, সেই শিক্ষকদের একাংশই এই দুইয়ের পাঠ ভুলেছেন।
নীলকন্ঠ পাখি ওড়াতে গিয়ে যারা নীলকন্ঠ হল যারা, তাদের প্রণাম।
আসামের ফর্মুলায় বাংলা-জয় হল না বিজেপির।