তাদের কেউ বলে ‘ভোট-কাটুয়া’, কেউ বলে বিজেপির ‘বি-টিম’, কেউ বা আবার উগ্র সাম্প্রদায়িক দল হিসাবেও অভিহিত করছে তাদের। কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যে বেশ কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, বড় দলগুলির জয়-পরাজয়ে অনুঘটকের ভূমিকা গ্রহণ করছে এরা। কথা হচ্ছে আসাউদ্দিন ওয়াইসির মিম তথা ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (AIMIM) নামের দলটিকে নিয়ে। হায়দরাবাদ কেন্দ্রিক আঞ্চলিক এই দলটি এখন জাতীয় রাজনীতিতে নয়া চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ভিত্তিক রাজনীতি করা মিম সম্প্রতি মহারাষ্ট্র এবং বিহার বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী দিয়ে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে। আসন সংখ্যার নিরিখে তাদের ফল আহামরি কিছু না হলেও, বেশ কিছু আসনে তারা ভোটের রং বদলে দিচ্ছে বলেই ভোট পণ্ডিতদের একাংশের মত। সম্প্রতি তারা আসন্ন পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনেও প্রার্থী দেবে বলে ঘোষণা করেছে।
গলাবন্ধ কোট, ফেজ টুপি পরিহিত আসাউদ্দিন ওয়াইসি যখন গরমাগরম রাজনৈতিক বক্তব্য রাখেন, তখন বোঝা দায় হয়ে ওঠে যে, তিনি পেশায় একজন আইনজীবী। বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে আইনের পাঠ নিয়ে আসা, হিন্দি, ইংরেজি, উর্দুতে সমান স্বচ্ছন্দ এই নেতা তখন দেশের মুসলিমদের অধিকার বুঝে নেওয়ার আহ্বান জানান, ‘আল্লা হো আকবর’ ধ্বনিতে সভাস্থল গমগম করে। এ হেন ওয়াইসি আর মিম কি সত্যিই মুসলমানদের উন্নতির ভগীরথ হয়ে আবির্ভূত হতে চলেছেন? দেশের বিজেপি বিরোধী কমবেশি প্রত্যেকটি দলেরই বক্তব্য, ওয়াইসি এবং মিমের সাম্প্রদায়িক প্রচারে আসল সুবিধা পাচ্ছে বিজেপি। তাদের আরও দাবি, প্রায় প্রত্যেকটি রাজ্য নির্বাচনে প্রার্থী দিয়ে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ভোট কেটে বিজেপির জয়ের রাস্তা প্রশস্ত করছে মিম। বিহার নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদেরও মত, এনডিএ এবং মহাগঠবন্ধনের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে মিম পাঁচটি আসন না জিতলে এবং বেশ কিছু আসন বিরোধী জোটের ভোট না কাটলে ফলাফল অন্যরকম হতে পারত। সেক্ষেত্রে এনডিএকে বিরোধী আসনে বসতে হত।
মিমের এই চকিত উত্থানে সংবাদমাধ্যমে নিজের আশঙ্কার কথা গোপন করেননি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক যোগেন্দ্র যাদব। তাঁর মতে, বিজেপির উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির একটা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রয়োজন ছিল, যার জুজু দেখিয়ে হিন্দু ভোটকে নিজেদের অনুকূলে একত্রিত করা যেতে পারে। মিম বিজেপির সেই উদ্দেশ্য পূরণ করে দিচ্ছে। তাঁর আশঙ্কা, দেশের মুসলমান জনগোষ্ঠী যদি মিমকে ভোট দিতে থাকে, তাহলে দেশের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির কোনও গুরুত্ব থাকবে না। কয়েকটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে নির্বাচকমণ্ডলী ভোট দেবে, যাতে সংখ্যাগুরুর রাজনীতি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে তিনি মিমের অতীত ইতিহাসের কথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন। স্বাধীনতার পর স্বাধীন হায়দরাবাদ রাজ্য গঠনের দাবি তোলা নিজামের পক্ষ নেওয়া, রাজাকার বাহিনী গঠন করে ভারতীয় সেনার বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটাবার চেষ্টা করা মিম যে আদ্যোপান্ত একটি মৌলবাদী দল, যোগেন্দ্র যাদব সেই দিকেই ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন। পাল্টা যুক্তিতে বলা হচ্ছে, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি এতকাল মুসলমানদের ভোটের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। নরম হিন্দুত্বের রাজনীতি করেও, মুসলমান ভোট পেয়ে এসেছে। এই জায়গায় আঘাত আসাতেই কি মিমের প্রতি এদের এতটা গোঁসা? ছাত্রনেতা শার্জিল উসমানির বক্তব্য, গণতন্ত্রে কোনও দলকে ভোট কাটুয়া বলার অর্থ জনাদেশকে অসম্মান করা।
কিন্তু যে দেশে গত ছয় বছরে সবচেয়ে বেশি আঘাত এসেছে বাক্স্বাধীনতার উপরে, যেখানে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে দমিয়ে রাখার জন্য একের পর এক কঠোর আইন আনছে বিজেপি শাসিত রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার, সেখানে মিমের এই উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রচার কী ভাবে উপেক্ষিত হয়? বিশেষ করে, নরেন্দ্র মোদীর সরকার যখন যে কোনও ইস্যুতে মুসলিম সংখ্যালঘুদের দিকে জঙ্গি, সন্ত্রাসবাদী, মৌলবাদী তকমা দেগে দিতে এত তৎপর, তা কী ভাবে মিমের এই ভয়ঙ্কর, বিভাজক, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি দেখেও চোখ বন্ধ করে থাকে? বিজেপির সঙ্গে তলে তলে মিমের যোগসাজশের অভিযোগের পিছনে, গেরুয়া শিবিরের এই রহস্যময় নীরবতাও অন্যতম কারণ।
বিহারে অভাবিত সাফল্য পাওয়ার পরেই ওয়াইসি বাংলার নির্বাচনকে টার্গেট করেছেন। তাঁর দাবি, দেশের মধ্যে বাংলাতেই মুসলমানরা সবচেয়ে খারাপ ভাবে জীবন কাটান। 2016 সালের একটা পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, বাংলার মুসলিম জনসংখ্যার মাত্র 5.7% মানুষ সরকারি চাকুরে। তৃণমূল শাসনে অবশ্য রাজ্য বিধানসভায় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে। বর্তমানে 59 জন মুসলিম বিধায়ক রয়েছেন এ রাজ্যে। মুসলমানদের মধ্যে এই অপ্রাপ্তির ক্ষোভটাকেই কি জাগিয়ে তুলতে চাইছে ওয়াইসি এবং তাঁর দল? সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ, মহম্মদ সেলিম ফোর্থ পিলার্সকে জানালেন, ‘দীর্ঘ চার দশক ধরে বাংলার মুসলমান এবং সংখ্যালঘু সমাজের পাশে বামপন্থীরাই রয়েছেন। সাম্প্রদায়িক মিমকে নিয়ে অনাবশ্যক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে কিছু প্রচারমাধ্যম। আদতে এখানে ওদের কোনও গুরুত্বই নেই।’ মুসলমানদের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা সমাজসেবী ইমানুল হক এবং বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের সমিরুল ইসলামের বক্তব্য, "স্বাধীনতার পর থেকেই রাজ্যে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সব রকম মানদণ্ডে মুসলমানরা পিছিয়ে থেকেছে। ইদানিং শিক্ষার দিক থেকে কিছু অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেলেও, সরকারি চাকরিতে মুসলমানরা এখনও সেরকম সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন না। রাজনৈতিক দলগুলিতে নীতি নির্ধারকরা প্রত্যেকেই প্রায় উচ্চবর্ণের হিন্দু।’ তাঁদের প্রশ্ন, এ সব নিয়ে কি ওয়াইসির মিম কোনও প্রশ্ন তুলেছে? তাদের দাবি, মিমের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে মুসলমান সমাজের কোনও উন্নতি হবে না, উল্টোদিকে বিজেপির রাজনৈতিক সুবিধা হলেও হতে পারে।
বাংলার শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসও মিমকে আলাদা করে কোনও গুরুত্ব দিতে নারাজ। তবে, বাংলা সীমান্ত লাগোয়া জেলাগুলিতে মিমের পাঁচটি আসন লাভ নয়া সম্ভাবনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে বলে অনেকের মত। বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া রাজ্যের তিনটি জেলা, উত্তর দিনাজপুর, মালদা এবং মুর্শিদাবাদ— যেখানে প্রায় 50% এবং তার অধিক মুসলমান জনসংখ্যা সেখানে মিমকে নিয়ে আলাদা করে ভাবনাচিন্তা, করছে বাম-কংগ্রেস এবং তৃণমূল, দুই শিবিরই। মিম ভোট কেটে যাদের সুবিধা করে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে, সেই বিজেপির জয়প্রকাশ মজুমদার অবশ্য ওয়াইসিকে ‘ভোট কাটুয়া’ বলতে নারাজ। তাঁর কটাক্ষ, ‘বাম-তৃণমূল মুসলমানদের জন্য যদি এতই কাজ করে থাকে, তাহলে ওয়াইসিকে এত ভয় পাচ্ছে কেন?’ তাঁর দাবি, মিমের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আগাগোড়া বিরোধী বিজেপি। তাই মিমকে বিজেপির "বি-টিম' বলা "অর্থহীন'।
বোঝাই যাচ্ছে সুদূর হায়দরাবাদের একটি দল বঙ্গ রাজনীতিতেও আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। মিমের উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রচারে একদিকে যেমন হিন্দু ভোট বিজেপির ঘরে ঢুকতে পারে, তেমনই মুসলমানদের একটি অংশও তৃণমূল, বাম বা কংগ্রেসের পরিবর্তে তাদের ছাতার তলায় যেতে পারে। দু’টোতেই লাভের গুড় খেতে পারে কিন্তু বিজেপিই। সবকটি দলই মিমের ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে নিজেদের রাজনৈতিক হিসেবনিকাশে ব্যস্ত। মিমের দলীয় প্রতীক ঘুড়ি। বাংলার আকাশে সেই ঘুড়ি মাটিতে গোঁত্তা খেয়ে পড়ে, নাকি সেটা বড় দলগুলির ভোট কেটে তাদের ভোকাট্টা করে দেয়, তার উত্তর মিলতে পারে আর কয়েক মাসের মধ্যেই।
মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরেও আফগানিস্তানের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখতেই হবে ভারতকে
কাজের সন্ধানে শহরে চলে আসা অপুরা গত সাত-আট মাসে গ্রামে ফিরতে পারেনি। লোকাল ট্রেনে আমার সঙ্গী হল তারা
সেনাকে বুকে গুলি করার নিদান দেন যে দলের নেতারা, সেই দল উত্তর-পূর্ব ভারতে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা ছাঁটতে চ
নিউ নর্মাল সময়ে মহামারী অনেক কিছু বদলে দিয়ে গেলেও বাঙালির এই চিরায়ত অভ্যাসে বদল আনতে পারেনি।
শাসক গ্যাস চেম্বারে সময়কে মারতে পারেনি, আমরা তাকে সবসময় আগলে রেখেছি।
কুচক্রীরা সারাক্ষণ গুজরাত মডেলকে গাল পাড়লেই বা, উন্নয়ন বলতে দেশবাসী তো গুজরাতকেই বোঝে!