পড়া ও মনে রাখার মতো চারটি বাংলা বই নিয়েই এই লেখা:
১
যাহা ঘটিল তাহাই সত্য
জগদীশ গুপ্ত
দাগিয়ে দেওয়া প্রাতিষ্ঠানিক লেখক নন, তাই একধরনের পাঠকদের মধ্যেই হয়তো সীমাবদ্ধ থাকতে হয়েছে জগদীশ গুপ্তকে। অথচ, রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর নাম অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। অপরাধ, পাপবোধ, প্রতিহিংসা, দুর্বৃত্তের অস্বাভাবিক নিষ্ঠুরতা, যৌনতা ও প্রবৃত্তির অকপট বহি:প্রকাশ- এসবই অগ্রাধিকার পেয়েছিল তাঁর ছোটগল্পে। ২০২০-তে ভাষাবন্ধন প্রকাশনার উদ্যোগে প্রকাশিত ‘যাহা ঘটিল তাহাই সত্য’-তে সংকলিত হয়েছে জগদীশ গুপ্ত’র দশটি ভিন্নধর্মী লেখা। ভিন্নধর্মী অর্থাৎ বলা যেতে পারে লেখাগুলো ঠিক অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত নাহলেও, গল্পগুলি যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যার অতীত- কাকতালীয়। লেখনীর সেই ভিন্নধর্মীতাই গল্পগুলির ভিত্তিপ্রস্তর। গল্পগুলির কয়েকটি লেখকের গল্পগ্রন্থ থেকে এবং কয়েকটি আবার পত্রপত্রিকা থেকে সংকলন করা হয়েছে।
২
কাস্তেলাও
জীবনের সাতসতেরো
নির্বাচিত প্রসঙ্গ
আফোন্সো দানিয়েল বি কাস্তেলাও, যিনি কাস্তেলাও নামেই বেশি পরিচিত। তাঁর জন্ম ১৮৮৬ সালের ৩০ জানুয়ারি, সমুদ্রতীরবর্তী রিয়ানষো-য়। মারা যান ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি, আর্জেন্তিনায়, নির্বাসনে। ১৯৩৬-এর ১৮ জুলাই ফ্রাঙ্কোর মিলিটারি ও ফাসিস্ত অভ্যুত্থানের সময়ে তিনি মাদ্রিদে ছিলেন, তাই প্রাণে বেঁচে যান। ফাসিস্ত শক্তি জয়ী হওয়ার পর তাঁকে আর্জেন্তিনায় স্বেচ্ছা-নির্বাসনে যেতে হয়। তাঁর খুব প্রিয় একটি জায়গা ছিল পর্তুগালের উত্তরে অবস্থিত স্পেনের একটি স্বয়ংশাসিত অঞ্চল গালিজা, যার দু’দিক ঘিরে রয়েছে আটলান্তিক মহাসাগর। গালিজার নিজস্ব ভাষা গালিসীয়-পর্তুগিজ (বা গালিজার পর্তুগিজ) এবং কাস্তেলীয় (বা স্প্যানিশ)। বলা হয়ে থাকে, গালিসীয়দের কাছে কাস্তেলাওয়ের গুরুত্ব ততখানিই, বাঙালিদের (পূর্ব ও পশ্চিম, দুই বাংলারই) কাছে রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব যতটা। সেকারনে কাস্তেলাও-কে গালিজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বলে মনে করা হয়। এই অঞ্চলের জন্য তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এই অঞ্চলেরই সামগ্রিক ছবি ফুটে ওঠে তাঁর গল্প, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রেখাচিত্রে। প্লেটোর সংজ্ঞা অনুযায়ী কাস্তেলাও একজন ভালো রাজনীতিবিদ। তাঁর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চিত্র-সম্বলিত বইয়ে উঠে এসেছে, গালিজার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সত্তা। ১৯৩৬-৩৯ ব্যাপী ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধ নিয়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ ‘কোজাশ্ দা ভিদা’, যা মহিলা, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ, রাজনৈতিক নেতা আর পশুপাখিদের ওপর একটা ছবির সিরিজ (১৯২৫)। সেই সিরিজেরই নির্বাচিত সংকলন কাস্তেলাও: জীবনের সাতসতেরো।
৩
দুই শিল্পীর চিঠি (পল গগ্যাঁ এবং ভিনসেন্ট ভান গখ)
পারস্পরিক-পারম্পরিক
বাংলায় ভিনসেন্টের চিঠির কিছু কিছু প্রকাশিত হয়েছে আগেই। ছবি বসু অনূদিত ছয়টি চিঠি প্রকাশিত হয় বারোমাস শারদীয় ১৯৭৯-তে। ‘প্রিয়তম থিও, তোমার ভিনসেন্ট’ শিরোনামে দুটি খন্ডে দেবীপ্রসাদ বসু অনুবাদ করেন সব মিলিয়ে বত্রিশটি চিঠি। ভিনসেন্টের জীবনের শেষ সাত মাসের সাতটি চিঠি অনুবাদ করেন সন্দীপন ভট্টাচার্য। গ্রন্থাকারে সেই অনুবাদ প্রকাশিত ‘এ ভাবেই চলে যেতে চাই’ শিরোনামে। ‘দাহপত্র’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ভিনসেন্টের কয়েকটি চিঠি। ২০১৯-এ বাংলাদেশের প্রকাশনা নোকতা-র উদ্যোগে বাংলায় প্রথমবার অনুদিত হয় পল গগ্যাঁ এবং ভিনসেন্ট ভান গখের পত্রালি; ‘দুই শিল্পীর চিঠি’।মূল চিঠি থেকে ভাষান্তর করেছেন সন্দীপন ভট্টাচার্য। পশ্চিমবঙ্গ পরিবেশক মনফকিরা।
পল গগ্যাঁ এবং ভিনসেন্ট ভান গখ, এই দুই শিল্পীর প্রথম সাক্ষাৎ হয় প্যারিসে, ১৮৮৭ সালের শেষদিকে। গগ্যাঁ তখন সদ্য ফিরেছেন ফরাসি উপনিবেশ মার্তিনিক দ্বীপপুঞ্জ থেকে ছবি এঁকে, আর ভান গখ অ্যান্টওয়ের্প থেকে। রেস্তোরাঁ দ্যু শালে-র প্রদর্শনীতেই সম্ভবত পরস্পরের পরিচয় হয়। পাশ্চাত্যে ছবির ক্ষেত্রে মোড়-ফেরানো আন্দোলন ইম্প্রেশনিশম-এর তখন শেষ পর্যায়, নব্য শিল্পীদের আর তাতে মন ভরছে না। ইম্প্রেশনিশমের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে তাঁরা চেষ্টা করছেন নতুন ছবি আঁকার। এর ফলাফল সে সময় বোঝা না-গেলেও বিশ শতকের প্রথমার্ধ জুড়ে তার প্রভাব স্পষ্ট অনুভব করা যাবে। রেস্তোরাঁ দ্যু শালে-র ঐ প্রদর্শনী ছিল এই নব্য শিল্পীদের ছবি দিয়েই সাজানো। ভিনসেন্টের ছোট ভাই থিও ভান গখ-এর এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা ছিল। গগ্যাঁর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তার ছবি ও শিল্পতত্ত্বের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন ভিনসেন্ট। অপরদিকে গগ্যাঁ- ও ক্রমে ভিনসেন্ট-এর ছবির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রাথমিক পরিচয়ের পরের পর্যায় শুরু হয় পরস্পরের মধ্যে ছবি বিনিময়, আর সেই সূত্রে শুরু হয় চিঠির আদান-প্রদান। এই চিঠিগুলিকে পাশ্চাত্যের শিল্প-ইতিহাসের এক বিশেষ পর্বের প্রাথমিক দলিল বলা চলে। এখানে শিল্পীদের নিজেদের বয়ানেই তাঁদের দৈনন্দিন জীবন, কাজ ও ভাবনার কথা জানা সব সময়েই ভালো। বিস্ময়কর যে শরীর-স্বাস্থ্যের সাংঘাতিক অবস্থা এবং চিরদারিদ্র্যের মধ্যেও এই দু-জন শুধু ছবিই আঁকেননি, সেই সঙ্গে তাঁদের প্রতিদিনের জীবন ও ভাবনাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশদে বর্ণনা করে গেছেন। একদিক থেকে এই সব চিঠি যেমন তাঁদের শিল্পভাবনার তাত্ত্বিক দলিল, তেমনই শিল্প-ইস্তাহারও।
দুই শিল্পীর চিঠি-তে চিঠি ছাড়াও রয়েছে দুই শিল্পীর আঁকা বেশ কিছু ছবি। উপস্থাপনার দিক থেকে এ বই একেবারেই পরীক্ষামূলক, গোটা বইটি মুখবন্ধ খামের মতো, খাম খুলে চিঠি পড়ার মতোই এ বই পড়তে হবে; নিঃসন্দেহে, বইটির বিশেষ আকর্ষণ এটি।
৪
এক এক রকম পৃথিবী ও অন্য ১৫টি গল্প
জীবনানন্দ দাশ
২০২০ বইমেলায় প্রতিক্ষণ প্রকাশনা প্রকাশ্যে এনেছে জীবনানন্দ দাশের মোট ৯৬টি গল্পের মধ্যে থেকে বাছাই ১৬টি গল্প। বইটির নাম রাখা হয়েছে ‘জীবনানন্দ দাশ-এক এক রকম পৃথিবী ও অন্য ১৫টি গল্প’। পান্ডুলিপিতে গল্পগুলির কোনও কোনও অংশ জীবনানন্দ লিখে কেটে দিয়েছিলেন; দেবেশ রায়ের সম্পাদনায় তাঁর সেই কেটে দেওয়া অংশগুলি এই বইয়ের সম্পাদকীয়তে লিপিবদ্ধ হয়েছে। যেমন- ১৯৩৬ সালে লেখা ‘কবিতা নিয়ে’ গল্পে একজায়গায় লেখা হয়েছিল -“জীবনে কোনওদিন সেক্রেটারিগিরি করিনি। আমি নোবেল চিনি না, লিখি কবিতা, টু দি পয়েন্ট বলবার অভ্যাস আমার নেই।” –“লেখো কবিতা, স্কাউন্ড্রেল, তুমি কবিতা লেখো। আর বলো নলিনাক্ষ তোমাকে ওসব ছেড়ে দিতে হবে। কী ছেড়ে দিতে হবে আহাম্মক? কীসের চাষ করতে হবে?” অথবা, ‘পৃথিবীটা শিশুদের নয়’ গল্পে তিনি লিখেছিলেন, “পৃথিবীর আর সমস্ত সুন্দর জিনিশ সমস্তই যেন বইয়ের পাতারই জিনিস বলে মনে হচ্ছিল।” প্রায় প্রত্যেকটি গল্পেই এরকমভাবে লাইন লেখা-কাটা হয়েছে। গল্পগুলি পড়লেই বোঝা যায়, সেগুলি জীবনানন্দের এক একটি দীর্ঘ বিমূর্ত কবিতা। তাঁর উপন্যাসের ভাষাও তাই।
সুন্দর নয়, ‘খ্যাঁচামার্কা’ ছবি আঁকতেই ভালবাসতেন
রেখায় ফুটে উঠেছিল তাঁর অবয়ব, যেমনটা আমি তাঁকে দেখেছি
টক ফুচকা, মিষ্টি ফুচকা, দই ফুচকা, বিবেকানন্দ পার্কের ফুচকা, হেদুয়ার ফুচকা
শুধুই ‘জনপ্রিয়’ রবীন্দ্রনাথ নয়, এ সময়ে উঠে আসুক প্রাসঙ্গিক অথচ উপেক্ষিত যে রবীন্দ্রনাথ।
আমি তাকিয়ে আছি ভারতের অভিমুখে– শুধু ভারতের দিকে