×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • খুরশিদের প্রজ্জ্বলিত বাড়ি হিন্দুত্বের জহর ব্রত

    বিতান ঘোষ | 19-11-2021

    প্রতীকী ছবি।

    বিভেদ ও বিদ্বেষের অন্ধকার মুছে নতুন দিনের সূর্যকে পুব আকাশের বুকে প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন দেশের প্রাক্তন আইনমন্ত্রী সলমন খুরশিদ। কিন্তু তার জন্য যে তাঁর নিজের বাড়িটিকেই জ্বালিয়ে দেওয়া হবে, তা বোধহয় ভাবতেও পারেননি তিনি। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে সলমন খুরশিদের Sunrise Over Ayodhya' বইটি। বইটির প্রচ্ছদের ডানদিকের কোণেও এক উদীয়মান সূর্যের ছবি। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছে। কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপির দাবি, খুরশিদের এই বই দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করতে পারে। বইয়ের প্রকাশ ও বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা চাপানোর দাবি জানিয়ে দিল্লি হাইকোর্টে মামলাও করেছেন জনৈক আইনজীবী।

     

     

    বইতে প্রবীণ কংগ্রেস রাজনীতিক খুরশিদ খানিক অতীতচারণের পথে হেঁটেছেন। দেখিয়েছেন তাঁর ছেলেবেলায় আর বড় হওয়ার সময়ে কী ভাবে হিন্দু-মুসলমান এই দেশের বুকে একই ভাবে বেঁচেছে। সেই যৌথ ভাবে বাঁচার রেওয়াজ যে ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আসছে, তা-ও তিনি গোপন করেননি। তবে, খুরশিদ তাঁর অনেক দলীয় সতীর্থের মতো বাবরি প্রসঙ্গে শীর্ষ আদালতের রায় নিয়ে কোনও ক্ষোভ প্রকাশ করেননি বা খেদোক্তি করেননি। তাঁর মতে, যা হওয়ার তা তো হয়ে গিয়েছেই। কিন্তু নতুন দিনের এক রক্তিমাভ সূর্য এই সকল গ্লানিকে মুছে দেবে বলে তাঁর বিশ্বাস।

     

     

    খুরশিদ তাঁর বইতে হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দুত্বের মধ্যে এক মূলগত প্রভেদ করেছেন। জানিয়েছেন, প্রথমটির প্রতি তিনি ভীষণ রকম শ্রদ্ধাশীল হলেও, দ্বিতীয়টি তাঁকে পীড়িত করে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য খুরশিদ অভিনব কিছুই বলেননি। হিন্দু ধর্মের সঙ্গে রাজনৈতিক মদতপ্রাপ্ত হিন্দুত্বের যে কোনও সাদৃশ্য নেই, তা নিয়ে অনেকেই ইতিমধ্যে কথা বলেছেন। বহু সংস্কার আন্দোলনের পথ ধরে এগিয়ে চলা হিন্দু ধর্ম তো আগাগোড়াই মিশ্র সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছে। বৈচিত্রময়তায় কখনও বৈপরীত্যও এসেছে বৈকি, কিন্তু হিন্দু ধর্ম তার সমন্বয়ী সত্তা নিয়ে বিবিধের মাঝে মহামিলনের দুরূহ কাজটা এত কাল অক্লেশে সম্পন্ন করে এসেছে। বিসমিল্লার সানাই, কাজী নজরুলের শ্যামাসঙ্গীতকে অনায়াসে নিজেদের আভরণ করেছে এই ধর্ম। কোনও ব্যক্তিবিশেষ এই ধর্মের ধর্মগুরু না হওয়ায় কিংবা কোনও গ্রন্থবিশেষ এই ধর্মের ধর্মগ্রন্থ না হওয়ার জন্যই হয়তো এতটা মুক্তাঞ্চল এই ধর্মে রয়েছে। যদিও ইতিহাসগত ভাবে দেখলে হিন্দু’-র নিছক একটি অপভ্রংশ শব্দ থেকে আস্ত একটি ধর্ম হওয়ার মধ্যেও একটা সুদীর্ঘ পরিক্রমা আছে। গ্রিস আর পারস্যের লোকজন যদি সিন্ধুকে হিন্দু উচ্চারণ না করতেন, তবে সিন্ধুর দক্ষিণ তীরের মানুষের নাম কি হিন্দু হত? এই সবের অনেক পরে ‘হিন্দু’-র ধর্ম হয়ে ওঠা।

     

     

    হিন্দুত্বও বয়সে খুব নবীন নয়। তবে তার মূলে রাজনৈতিক প্রণোদনাটা হাল আমলের। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান গোলওয়ারকর তো তাঁর Bunch of Thoughts-এ ভারতকে এক হিন্দুভূমি হিসাবেই গড়ে তুলতে চেয়েছেন। অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপনার বৃহৎ লক্ষ্যে এখনও ধাবমান সংঘের প্রকাশ্য রাজনৈতিক মুখ ভারতীয় জনতা পার্টি। এই দলের স্বঘোষিত হিন্দুবীররা শৌর্য ও পৌরুষের উপাসক, পুরুষাকারের পূজারি। এঁরা নিশ্চয়ই কখনও মীরাবাঈ-এর ভজন শোনেননি বা বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পড়েননি। প্রেম কিংবা শোকের রসে নিমজ্জিত হননি। এঁদের আরাধ্য দেবতা শৌর্যশালী রামচন্দ্র কিংবা পেশীবহুল শিব, যাঁরা মূলত উত্তর ভারতে পূজিত হন। দেবীপুজোর কোনও স্থান এখানে নেই। হিন্দুধর্মের মধ্যেকার সহিষ্ণুতা কিংবা ঔদার্যের পাঠও এঁদের নেই। রাজনৈতিক ভাবে এঁরা এতটাই হোয়াটঅ্যাবাউটারি (ঘটনার কাল পরম্পার্য)-তে বিশ্বাসী যে, প্রাচীন কালের কোনও একটি কল্পিত জহর ব্রতের (স্বেচ্ছায় অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ) পাল্টা পদক্ষেপ হিসাবে খুরশিদের বাড়ি জ্বালানোটাকে যুক্তির ভিত্তিমূলে প্রতিষ্ঠা করতে চাইবেন। এই যেমন চিতোরের রানি পদ্মাবতী আলাউদ্দিন খিলজির হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে জহর ব্রত পালন করলেন। কে বলল এ কথা? স্বঘোষিত হিন্দুবীর বললেন, ইতিহাসে লেখা আছে। আসলে এই সব কিছুই মালিক মুহাম্মদ জায়সি, পরবর্তী কালে সৈয়দ আলাওলের ভাবনা সমৃদ্ধ একটি কাব্যের দান। মুঘল চিত্রকলায় বিভিন্ন অ-হিন্দু মানুষের আঁকা তৈলচিত্রে, মুসলমান শিল্পীদের সৃষ্টিশীলতায় বার বার উঠে এসেছে হিন্দু পুরাণ ও সাহিত্য। রাজনৈতিক হিন্দুত্ব তখন এতটাও বলশালী হয়নি যে এই ঐক্যকে বিনষ্ট করে।

     

     

    খুরশিদের মতে বিজেপি আরএসএস-এর হিন্দুত্ব আইসিস কিংবা বোকো হারামের জেহাদি ইসলামের সঙ্গে তুলনীয়। দেশে দেশে মৌলবাদের স্বরূপগুলি যে প্রায় একই এবং তাদের মোডাস অপারেন্ডি যে কাল ও স্থান ভেদে অবিকল এক, তা তো প্রশ্নাতীত ভাবে সত্যি। বিরুদ্ধ মতকে যেনতেন প্রকারেণ দমন করা, আপন ধর্মের দর্শন না জেনেই বিকৃত ভাবে তার ব্যাখ্যা করা এবং অন্যান্য মানুষকে ধর্মের খাতিরে হন্তারক হওয়ার পাঠ দেওয়া— এই মূলগত বৈশিষ্টগুলো তো কমবেশি সব ধর্মের মৌলবাদীদের মধ্যেই বর্তমান। আপন ধর্মের শক্তিতে যাঁদের এত বিশ্বাস তাঁরা সেই ধর্মকেই এত স্পর্শকাতর ভাবেন কেন, যাতে কেউ সেই ধর্মের মধ্যেকার কোনও লোকাচার নিয়ে প্রশ্ন তুললেই, তাঁরা জাত গেল, জাত গেল বলে সরব হন?

     

     আরও পড়ুন: বন্দি কোথায়, পাঁচ বছর পরেও নোটই তো উড়ছে

     

    সময় ধর্মের আচার উপাচারে বদল আনে। প্রাক বৈদিক যুগের মানুষের খাদ্যাভাস, ধর্মাচরণের সঙ্গে পরবর্তী বৈদিক যুগের মানুষের খাদ্যাভাস, ধর্মাচরণে আসমান জমিন ভেদ আছে। তাই নির্দিষ্ট কোনও বিশ্বাসকে পুঁজি করে, মানবতা, মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে লড়া কোনও আদর্শ ধার্মিকের কাজ হতে পারে না। খুরশিদের সমনামী রুশদিও এক সময় তাঁর ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ গ্রন্থের জন্য এককালে এই গেরুয়া বাহিনীর রোষানলে পড়েছিলেন। সেই দায়ে এই কিছুকাল আগে পর্যন্ত তিনি জয়পুর সাহিত্য উৎসবে আসতে পারেননি।

     

     

    এ ছাড়াও কখনও সোচ্চারে ‘জয় শ্রীরাম’ না বললে, বিধর্মী পীড়নে নিজেকে নিযুক্ত না করলেও হিন্দুধর্মের অবমাননা হয়েছে বলে মনে করেছেন স্বঘোষিত ধর্মের পান্ডারা। বিধর্মীকে দিয়ে এই জোরপূর্বক ‘জয় শ্রীরাম’ বলানো গেলেই যেন আপন ধর্মের গরিমা বৃদ্ধি পাবে। খুরশিদ যথার্থই বলেছেন, এটি হিন্দুধর্ম হতে পারে না, এটি রাজনৈতিক হিন্দুত্ব। খুরশিদের দল খুরশিদের পাশে দাঁড়ায়নি, তাঁর বক্তব্যকে একান্তই ব্যক্তিগত বলে পাশ কাটানোর চেষ্টা করেছে। দেশে এখন আদর্শ হিন্দু হওয়ার যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে, কয়েক কদম পিছিয়ে থেকেও সেই প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছে খুরশিদের দল কংগ্রেস। কিন্তু এই রাজনৈতিক-সামাজিক বাধ্যবাধকতা পেরিয়ে এই কথাগুলো তবে বলবে কারা? কারা শোনাবে ‘গাঁয়ের এই নওজওয়ান, হিন্দু মুসলমান, মিলিয়া বাওলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম মোরা...’? খুরশিদও তো সেই অজানা গ্রাম্য বাউলাঙ্গের সুরেই সেই কথাগুলো বলছেন, যে কথাগুলো ভারত নামক ধারণার অন্তরে বাজে। খুরশিদের প্রজ্জ্বলিত বাড়িটি আসলে হিন্দুত্বের পৈশাচিকতা এবং চিরায়ত হিন্দু ধর্মের জহর ব্রত পালনের প্রতীক। তাঁর মতো যাঁরা এখনও ধর্মের মরমিয়া পথ ধরে এগোতে চান, তাঁদের আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়েই একলা চলতে হবে।

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    লকডাউনে ছাত্রছাত্রীদের কাছে পাঠ্যবস্তু পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারেও তাঁর সমান চিন্তা ছিল

    বোরখা পরা নাজমার বর 2002-এর গুজরাতে খুন হয়, এখন মুশকানরা আল্লা হো আকবর বললেই দোষ হয়ে যাবে?

    পরিকাঠামো নেই, নেই মেধার যাচাইও, চাকরিপ্রার্থীদের চাকরি দেবে কে?

    আচ্ছা মৃত্যুর পর কী? মৃত্যুতেই কি সবকিছুর পরিসমাপ্তি নাকি, তার মধ্যে থেকেই সৃষ্টির বীজ উপ্ত হয়?

    দেশপ্রেমের রেসিপিতে একটু মুক্তিযুদ্ধের মশলা মেশালে ঝাঁঝ বাড়ে।

    রাষ্ট্রের বীররসাত্মক আখ্যান নির্মাণে সহায়ক নীরজের সোনা, প্রান্তিক এলাকার মীরাবাইরা বাড়ায় অস্বস্তি।

    খুরশিদের প্রজ্জ্বলিত বাড়ি হিন্দুত্বের জহর ব্রত-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested