×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • বৈদগ্ধ্য আর বিনয়ের এক অপূর্ব সহাবস্থান; হরিশঙ্কর বাসুদেবন (১৯৫২-২০২০)

    বিতান ঘোষ | 12-05-2020

    হরিশঙ্কর বাসুদেবন

    তাঁর নামে ‘হরি’ এবং ‘হর’ দুয়েরই অবস্থান। অবশ্য তিনি চাইতেন, সমবয়সী এবং পরিচিতরা তাঁকে শুধু ‘হরি’ বলেই ডাকুক। আর সত্যিই তো, কোনওদিন কেউ তাঁকে ক্লাসে রেগে যেতে দেখেননি। কোনও ছাত্রকে কোনওদিন গলা উঁচু করে কিছু বলেছেন বলেও মনে পড়ে না। আক্ষরিক অর্থে, তিনি জগৎ পালক ‘হরি’-র মতোই সদাহাস্যময়। মৃদুভাষী অথচ কোনও জটিল বিষয়ের সহজ উপস্থাপনায় যথেষ্ট প্রগলভ, ছাত্রবৎসল। তিনি, হরিশঙ্কর বাসুদেবন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সর্বজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক। তাঁকে জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া বললেও কম বলা হয়। শনিবার শেষ রাত্রে, সহসাই অনন্তলোকে পাড়ি দিয়েছেন। তাঁর বহু কৃতি ছাত্র তাঁদের মতো করে তাঁদের প্রিয় স্যারের স্মৃতিচারণা করেছেন। তাঁর বহুব্যাপৃত কর্ম ও সুগভীর মনীষার নাগাল পাওয়া দুঃসাধ্য কাজ। সেই ধৃষ্টতাও আমি দেখাব না। শুধু অতীতের পথে খানিকটা হেঁটে আসব।

    গ্রীষ্মকালের পড়ন্ত বিকেল, আর শীতকালে সন্ধ্যা প্রায় হয় হয় — এমন সময় আমাদের শেষ ক্লাসটি নিতে আসতেন হরিশঙ্কর বাসুদেবন, আমাদের সকলের ‘HSV’হাতে একটি মার্কার, ডাস্টার আর রেজিস্টার নিয়ে, চারতলায় তাঁর নির্দিষ্ট ঘরটি থেকে তিনতলার লেকচাররুমে আসতেন HSVঘরে ঢুকেই আয়তাকার সাদা বোর্ডটিকে মার্কারের দাগ টেনে তিনটি ভাগে ভাগ করে নিতেন। ক্ষিপ্র হাতে লিখে যেতেন একটানা। আমরাও অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তাঁর লেখাগুলি আমাদের নোটবুকে তুলে নিতাম। উনিও একটা স্লাইডে লিখে, আগের স্লাইডগুলি মুছে দিয়ে এগোতে থাকতেন। আমরা বন্ধুরা মজা করে বলতাম, কেমব্রিজে পড়াকালীন ভদ্রলোক নিশ্চয়ই দেওয়ালে গ্রাফিতি আঁকতেন। হয়ত এখনও আমাদের লেকচাররুমের হোয়াইট বোর্ডের কোনও এক কোণে HSV-র সেই চিরপরিচিত হস্তাক্ষর রয়ে গেছে।

    হরি বাসুদেবন প্রতিটি জটিল বিষয়ের একটা সরল রূপরেখা তৈরি করে নিতেন। তাঁর বোর্ডের লেখাটা ছিল সেই ব্লু-প্রিন্টেরই অঙ্গ। যেখান থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারতাম, স্যার কোনও বিষয়ে কীভাবে এগোতে চাইছেন। তারপর ক্লাসের শেষভাগে বিষয়টাকে অত্যন্ত সহজ করে বুঝিয়ে দিয়ে রোল কল করতেন। একেবারেই অননুকরণীয় ভঙ্গিতে পুরো বিষয়টা সমাধা করতেন তিনি।

    এমনও হয়েছে, বিশেষ কোনও পরিস্থিতিতে ক্লাসে আমরা গোটা কুড়ি বন্ধু রয়েছি। আর আমাদের কারও
    4টের শেষ ক্লাসটি করার ইচ্ছা নেই। কিন্তু স্যারকে ‘ক্লাস করব না’ বলতেও তো পারা যায় না। আমরা বিনয়ের সঙ্গে তাঁর দরজা ঠেলে জিজ্ঞাসা করতাম, ‘স্যার আজ কি ক্লাস নেবেন?’ স্মিত হাসি নিয়ে বলতেন, ‘Why not?’ তারপর একটা ভাঙা ভাঙা অথচ মিষ্টি বাংলায় বলতেন, ‘তোমরা চলো, আমি এখনই যাচ্ছি।' ক্লাসের পড়া মার্জিত ইংরেজিতেই বোঝাতেন বটে। তবে, বাংলা মাধ্যম থেকে আসা ছাত্রদের জন্য সেগুলোর বাংলা তর্জমাও করতেন কখনও কখনও। মজা করে বলতেন, "আমার পরিবারে আমি ছাড়া সবাই বাঙালি। আমিও হাফ বাঙালি, বাংলা বলতে পারি, কিন্তু পড়তে পারি না। পাঠ্যক্রমের গন্ডির বাইরে যখন কোনও সেমিনারে তাঁর বক্তব্য শুনতে যেতাম, তখন তাঁর বৈদগ্ধ্যের পরিচয় পাওয়া যেত। অথচ কি শান্ত আর মার্জিত উপস্থাপনা, কোথাও কোনও কিছু জাহির করার লেশটুকু নেই।

    আর একটি বিষয়ে আমরা তাঁর প্রতি মুগ্ধ হতাম, তা হল তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা। কোনওদিন আগাম না জানিয়ে ক্লাসে এসেছেন, এমনটা কখনও হয়নি। এমনকি গত বছরও একটি বাংলা বনধের আগের দিন ক্লাস নিতে এসে বলেছিলেন, ‘আমি কাল আসব, তোমরা সকলে এলে আমায় ডেকো, ক্লাস নেব।' কী অপূর্ব মুন্সিয়ানায় শিল্প বিপ্লব, রুশ বিপ্লবের নানা অজানা অলিগলিতে আমাদের নিয়ে যেতেন। অন্যান্য অধ্যাপকদের মুখেই শুনছিলাম, লকডাউনে ছাত্রছাত্রীদের কাছে পাঠ্যবস্তু পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারেও তাঁর সমান চিন্তা ছিল। ঘনিষ্ঠমহলে জানিয়েছিলেন, বাংলায় ইতিহাসের কিছু ডিজিটাইজড উপাদান রাখা গেলে, বাংলা মাধ্যমের পড়ুয়ারা উপকৃত হতে পারে।

    স্যারের অসুস্থতার খবর পেয়েছিলাম। শনিবার ভোররাতের হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ জানাল, স্যার আর নেই। খুবই দুঃখ হচ্ছিল, তাদের জন্য যারা স্যারের ক্লাস করতে পারল না। আর নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল এই ভেবে যে, দু'বছর ধরে এই বিদগ্ধ, বিনয়ী মানুষটার ক্লাস করতে পেরেছিলাম বলে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের কৌলীন্যকে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সুদূর কেরালা থেকে এসে। অকাতরে কয়েক প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তাঁর জ্ঞান বিলিয়ে গেছেন বাসুদেবন। এই কঠিন সময়ে যখন দেশের ইতিহাসচর্চাকে ভিন্ন খাতে বওয়ানোর চেষ্টা হচ্ছে, তখন হরি বাসুদেবনের মতো মানুষকে আরও বেশি করে দরকার ছিল। তবু, তিনি থাকবেন। তাঁর বিবিধ রচনা, বিস্তৃত জ্ঞান, সদাহাস্যজ্বল মুখ, এই সবকিছু নিয়ে আজীবন তাকে মনে রাখব আমরা। পোশাকে-ব্যবহারে একজন আদ্যোপান্ত ‘জেন্টলম্যান’ প্রফেসরকে মনে রাখবেন দেশের অগণন ইতিহাসপ্রেমী।

     

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    বিশ্বে ট্রেন নিয়ে অনেক গল্পগাথা আছে। কত গল্প প্রাণ পেয়েছে ট্রেনের কামরায়।

    আপাতত রণে ভঙ্গ দিলেও সুনার বঙ্গালের কারিগরদের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

    বাংলায় রাজনীতি করে বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিকে নিয়ে এমন সংশয় তৈরি করতে পেরেছেন আর কোন রাজনীতিক?

    সোশাল মি়ডিয়া আর রাজনীতিতে রামের একচ্ছত্র আধিপত্য় হরণ করে এবার আবির্ভূত হলেন কৃষ্ণ!

    দেশের ইতিহাসে এক প্রহেলিকাময় চরিত্র হয়েই রয়ে যাবেন পিভি।

    শাক্ত সুভাষ আর বৈষ্ণব গান্ধীর দ্বন্দ্বে কি দম নিতে পারেন ব্রিটিশ-বন্ধু সাভারকর?

    বৈদগ্ধ্য আর বিনয়ের এক অপূর্ব সহাবস্থান; হরিশঙ্কর বাসুদেবন (১৯৫২-২০২০)-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested