×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • করোনার উত্তরে ট্রাম্পরা সেই দক্ষিণেই

    বিতান ঘোষ | 22-04-2020

    ট্রাম্প ও মোদী, প্রতীকী ছবি

    সংক্রামক মহামারীর প্রকোপে স্তব্ধতার বাতাবরণ গোটা বিশ্বে। সংক্রমণের ভয়ের পাশাপাশি এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আতঙ্কিত ঘরবন্দি মানুষ। প্রভাব এবং আশঙ্কা মূলত আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেই। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সমাজবিদরা ইতিমধ্যেই এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাবের কথা জানাচ্ছেন। বিশ্বব্যাঙ্ক প্রায় প্রতিটি দেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে কেটে-ছেঁটে দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার রিপোর্টে জানাচ্ছে, বিশ্বে অন্তত 14 কোটি মানুষ নতুন করে অনাহারের কবলে পড়বেন। কিন্তু, অর্থনীতি-সমাজনীতি অনেকাংশেই রাজনীতির উপর নির্ভরশীল। রাজনীতি তাকে নিয়ন্ত্রণ করে, নিজের মতো করে চালনা করে। তাই, এই সঙ্কটে দেশের তাবড় রাষ্ট্রপ্রধানরা কে, কেমন ভূমিকা নিচ্ছেন, তা নিয়ে আলোচনা হওয়া বাঞ্ছনীয়।

     

    সারা বিশ্বে দক্ষিণপন্থী নেতাদের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। পূর্বতন শাসকদের বঞ্চনাএবং এক অদ্ভুত একমুখী দেশপ্রেমের তুফান তুলে তারা গণতন্ত্রের পরীক্ষায় সফলও হয়েছেন। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তাঁর উত্তরসূরী ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী স্লোগানকে যদি আমরা পাশাপাশি রাখি, তাহলে হয়ত বিষয়টা সুস্পষ্ট হবে।

     

    প্রথমজন 2008-এর নির্বাচনী জনসভায় বলছেন, ‘Yes, We can’. দ্বিতীয়জন তার 8 বছর পর বলছেন, ‘Make America, great again’. প্রথমটিতে যখন দৃঢ় প্রত্যয় আর মূল্যবোধ উঁচু সুরে বাঁধা, অপরটিতে তখন কোনও অলীক সোনা ঝরা দিনকে নতুন করে ফিরিয়ে আনার দাবি।

     

    টেমপ্লেটটা কি খুব চেনা চেনা লাগছে? বহমান ইতিহাসের দিকে ঘুরে তাকালেই দেখা যাবে, হিটলারও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের হৃতসম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলে নিজের দেশে স্বপ্নের সওদাগর বনে যাচ্ছেন। স্বপ্ন দেখা এবং জনগণকে তা দেখানো খারাপ কিছু নয়, বরং রাষ্ট্রপ্রধানদের তো তেমনটাই করা উচিত। কিন্তু সেদিনের হিটলার বা আজকের ট্রাম্প-রা যে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, সেটা আপাদমস্তক অলীক, বিদ্বেষে পরিপূর্ণ।

     

    করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ট্রাম্পকে আগাগোড়া নড়বড়ে দেখিয়েছে। আমেরিকার হারানো গৌরবফেরানো দূরস্থান, করোনা যুদ্ধে লিঙ্কন-জেফারসনের দেশের লেজে-গোবরে অবস্থা দিনদিন প্রকট হচ্ছে। সবকিছু দেখে শুনে মনে হচ্ছে, ট্রাম্প যেভাবে মেক্সিকো সীমান্তে পাঁচিল তুলতে পারেন কিংবা ডেমোক্রেট প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে চাল দিতে পারেন, সেই ক্ষিপ্রতায় বৃহত্তর সঙ্কট মেটাতে পারেন না। ট্রাম্পদের সুবিধা হল, সঙ্কট থেকে তাঁরা দেশকে উদ্ধার করতে পারবেন কি না, এই প্রশ্ন নিয়ে কেউ তাঁদের নির্বাচিত করেন না। বরং একটা অলীক কাউকে শত্রুপক্ষ ঠাহর করে, তাদের বিরুদ্ধে কতটা বীরত্বের পরিচয় দিতে পারেন, সেইটাই জনগণের সামনে বড় করে তুলে ধরা হয়।

     

    ট্রাম্প এগুলো জানেন। খুব ভালভাবেই জানেন। তাই অক্লেশে তিনি তাঁর যাবতীয় দায়ভার প্রাক্তনে(ওবামা)র ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারেন। ঠিক যেমন এই দেশের যাবতীয় রাজনৈতিক সমস্যায় চাঁদমারি করা হয় নেহরুকে। ব্রাজিলের বোলসেনারো তো ক্ষমতায় এসেই তাঁর বামপন্থী পূর্বসূরীকে জেলের পথ দেখিয়েছেন। রাশিয়ার পুতিন আবার এখনও লেনিন ও রুশবিপ্লবের ওপর গোঁসা কমাতে পারেননি। মনে করে দেখুন, হিটলারও জার্মনির যাবতীয় দুর্যোগ দুর্ঘটনার পিছনে ভাইমার প্রজাতন্ত্রকে দায়ী করেছিলেন, মুসোলিনিও ইতালির পূর্বতন প্রজাতন্ত্রী সরকারকে।

     

    এ যেন বিশ্বসংসারের নালিশ জানানোর নার্সারি স্কুল- ধরা পড়লেই অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রাখা আর নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে দেশপ্রেমে নিত্য নতুন প্রলেপ দেওয়া। করোনার প্রভাবে যে অর্থনৈতিক-সামাজিক সংকট দেখা দিতে চলেছে, বলাই বাহুল্য তাতে সবচেয়ে সঙ্কটে পড়বেন নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষরা। আর ইতিহাসের মিরর রিফ্লেকশন’-এ এটাই দেখা যায়, বিশ্ব যতবার এমন সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে, দক্ষিণপন্থী শাসকরা পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। দিশাহারা মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত মনে স্বপ্নের জাল বুনেছেন, একটা সুপারফিশিয়ালদেশের ধারণা গেঁথে নিয়েছেন নিজেদের মনে। এই ধারণা ইনক্লুসিভনয়, সংকীর্ণতায় ঢাকা। রাষ্ট্রের স্বার্থের কাছে এখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নগণ্য।

     

    শরনার্থী-সঙ্কট, আমাজনের অগ্নিকাণ্ড কিংবা হালের করোনা-সঙ্কট, আমরা দেখতে পাচ্ছি এই শৌর্যবান দেশনেতারা এগুলোর মোকাবিলায় পদে পদে হোঁচট খাচ্ছেন। মরিয়া হয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তাতে সমস্যা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। কিন্তু তাদের সাফল্য(?) এখানেই যে, তারা নিজেদের যে কোনও সিদ্ধান্তকে দেশের জন্য হিতকর' বলে চালিয়ে দিতে পারছেন। তাই জনসমর্থনও তাদের প্রতি অটুট থাকছে।

     

    ট্রাম্প হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের জন্য মিত্রঁদেশ ভারতকে হুমকি দিচ্ছেন, WHO-কে অর্থনৈতিক অনুদান দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি, মার্কিন মুলুকে অভিবাসন বন্ধ করে দেবেন। ওয়াকিবহাল মহল জানে আমেরিকা ফর আমেরিকানসতাঁর স্বপ্নের এক ভেঞ্চার। মহামারী প্রসূত অসহায়তা আর সঙ্কটকে শিখন্ডী করে তিনি তাঁর রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার সাফল্য চাইবেনই। তাঁর ভোটাররা জানবেন, যা হচ্ছে সব আমাদের জন্য। প্রশ্ন উঠবে না, ভাবা হবে না যে, সমস্যার সঙ্গে এই দাওয়াইয়ের কোনও কার্য কারণ সম্পর্ক আছে কি না। যেমন আমাদের দেশের ভোটারকূলও জানতে চাননি, কোটি টাকার এনআরসি করে বাংলাদেশীবা পাকিস্তানিদের বাদ দিলে দেশের কোন মঙ্গল হবে।

     

    অনেকেই বলছেন, করোনা পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার ভাষা, ভরকেন্দ্র সবকিছু বদলে যাবে। সত্যিই কতটা কী পাল্টাবে সেটা জানতে, মহামারীর ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে আমাদের এখনও অনেক গুলো বসন্ত দেখতে হবে। কিন্তু দেশে দেশে দক্ষিণপন্থা আর দেশপ্রেমের যে মকটেলজনগণ-কে পান করানো হচ্ছে, তা সহজে থামবে বলে মনে হয় না। অসহায়, দ্বিধাগ্রস্ত মনকে নেশাতুর করা খুব সহজ; ট্রাম্পরা বিবেকানন্দউচ্চারণ করতে না পারলেও, ইতিহাস থেকে এই শিক্ষাটা লুফে নিয়েছেন। তাই তাঁরা সহজে থামবেন না। উল্টে, সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ নয়, তাদের সংকীর্ণ অ্যাজেন্ডা নতুন ভাবে পল্লবিত হবে বলেই ধারণা। হয়তো নতুন কোনও সঙ্কটের পথ খুলে দেবে এনাদের হীন স্বার্থবুদ্ধি। এ বড় সুখের সময় নয়।

     

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    ধর্ম যাদের সঞ্জীবনী, সেনাশাসন যাদের গণতান্ত্রিক আভরণ, তাদের পথ আমরা কেন অনুসরণ করব?

    সোশাল মি়ডিয়া আর রাজনীতিতে রামের একচ্ছত্র আধিপত্য় হরণ করে এবার আবির্ভূত হলেন কৃষ্ণ!

    সংবিধান দিবসের স্মরণ: নাগরিকের কাছে ধর্মগ্রন্থের মতোই পবিত্র এই নথি।

    বিশ্বে দেশ নামক ধারণাকে যত কঠিন করা হচ্ছে, দেশহীন শরণার্থীদের সংখ্যা ততই বাড়ছে।

    ঈশান কোণে মেঘ থাকলেও বিসমিল্লার সুরে, ফৈয়জের কবিতায় এই দেশ বেঁচে থাকবে।

    দেশপ্রেমের রেসিপিতে একটু মুক্তিযুদ্ধের মশলা মেশালে ঝাঁঝ বাড়ে।

    করোনার উত্তরে ট্রাম্পরা সেই দক্ষিণেই-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested