ভারতীয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বৈবাহিক ধর্ষণ (marital rape) নেহাতই তুচ্ছ ঘটনা! এ যেন অনেকটা ‘জোর যার শরীর তার!’ আবহমান কাল ধরে পুরুষের কাছে নারী তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং অন্য কোনও পুরুষের দ্বারা ধর্ষণ হল সেই সম্পত্তির হানি! প্রাচীন ব্যাবিলনে কোনও পুরুষ যদি কারও কন্যা বা স্ত্রীকে ধর্ষণ করত তবে তাঁর সরাসরি মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবিধান ছিল। কিন্তু তা সেই নারীর উপর হওয়া অত্যাচারের শাস্তিস্বরূপ নয়, বরং কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি, অর্থাৎ সেই নারীকে বিনা অনুমতিতে ব্যবহারের দোষে অভিযুক্তের সাজা নির্ধারিত হত। এ তো গেল 1900 খ্রিস্টপূর্বাব্দের কথা। কিন্তু "আধুনিক ভারতে' এই দৃশ্যপট কতটা বদলেছে?
নারীদের উপর হিংসার ঘটনা ক্রমশ উর্ধ্বগামী! ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র (NCRB) রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের প্রায় 70 শতাংশ মহিলাই গার্হস্থ্য হিংসার শিকার। যখন কোনও বৈবাহিক সম্পর্কে স্বামী জোর করে বা ভয় দেখিয়ে স্ত্রীর অসম্মতিতে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করেন তা কিন্তু আদপে এই গার্হস্থ্য হিংসারই অঙ্গ।
এ কথা ঠিক যে, ভারতীয় আইনব্যবস্থায় গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হলে তার জন্য রয়েছে IPC 498A, আবার ধর্ষণের বিধানস্বরূপ IPC 375 রয়েছে। তবে ওই যে কথায় আছে, আইন থাকলে আইনের ফাঁকও থাকে! কোনও মহিলা বাইরের জগতে যদি ধর্ষিতা হন, সেই অপরাধের শাস্তি স্থির রয়েছে। কিন্তু কোনও মহিলা যদি ঘরের মধ্যেই নিজের জীবনসঙ্গীর বিকৃত যৌনকামনার শিকার হন? যদি তাঁর স্বামী আদিমকাল থেকে প্রচলিত ধ্যানধারণা অনুযায়ী স্ত্রীকে নিজের ব্যক্তিগত পণ্য মনে করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপূর্বক যৌনতায় লিপ্ত হন, তবে কি তা ধর্ষণ বলে পরিগণিত হবে? কী বলছে ভারতীয় দণ্ডবিধি?
ভারতীয় আইনব্যবস্থায় এর কোনও বিচার নেই! ভারতীয় দণ্ডবিধির 375 নম্বর ধারায় ব্যতিক্রম 2এ-তে কেবল বলা রয়েছে যে স্ত্রী যদি বয়সে 15 অনুর্ধ হন এবং স্বামীর দ্বারা বলপূর্বক যৌনতার শিকার হন তবেই তা 'বৈবাহিক ধর্ষণ' হিসাবে ধরা হবে। আর এখানেই প্রশ্ন ওঠে, বর্তমান ভারতে যেখানে বিবাহের বৈধ বয়স 18 এবং পকসো আইনে (2013) যৌনতায় সম্মতির সর্বনিম্ন বয়স 18 বেঁধে দেওয়া হয়েছে সেখানে কিন্তু আইনের এই ব্যতিক্রমী ধারা অনুযায়ী, যৌনতার বৈধ বয়স 15! যেখানে 15 বছর বা তার চেয়ে কমবয়সি মেয়ের বিয়েই বৈধ নয় সেখানে তাঁর স্ত্রী হওয়ার ও তাঁর উপর হওয়া স্বামীর জোরজবরদস্তি বৈবাহিক ধর্ষণ বলে পরিগণিত হওয়ার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে! আধুনিক ভারত ঠিক এই ভাবেই স্ববিরোধী আইনের জাঁতাকলে পিষ্ট। আইনসভায় বহু বার ধর্ষণের আইন সংশোধিত হয়েছে, কিন্তু বৈবাহিক ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর বিষয় চিরকালই ব্রাত্য থেকে গিয়েছে।
আইনজীবী অরুণাংশু চক্রবর্তীর বক্তব্য, বৈবাহিক ধর্ষণের মতো বিষয়কে দণ্ডনীয় অপরাধের আওতায় আনা ভিত্তিহীন। কারণ, বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার এমন মহিলার সংখ্যা নেহাতই আনুবিক্ষণিক। তা ছাড়া, 498A-র অপব্যবহারের প্রবণতা যে ভাবে বাড়ছে তাতে এই বিষয়টিকে আইনের আওতায় আনা হলে তার অপব্যবহার নিশ্চিত। অন্য দিকে, মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিযুক্তি, ‘‘প্রমাণের বা অপব্যবহারের প্রশ্ন যে কোনও আইনের ক্ষেত্রেই থাকতে পারে, তাই বলে কি খুনের হুমকিকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না? আসলে আমাদের অবচেতনে আমরাও এটা বিশ্বাস করি যে বিবাহকে যে ভাবে হোক প্রোটেক্ট করতে হবে। বিবাহ বাদ দিয়ে ধর্ষণের আইন বা খুনের আইনের ক্ষেত্রে তো এত অপপ্রয়োগের যুক্তি উঠছে না? আমরা বিবাহের ক্ষেত্রে এটাকে আনছি কারণ আমরা বিবাহকে সব কিছুর উর্ধ্বে 'ফুলচন্দন' দিয়ে রাখতে চাইছি। আর সেই কারণেই বিবাহের চার দেওয়ালের মধ্যে এত কিছু ঘটে চলেছে কিন্তু কোনও সুবিচার মিলছে না।’’
বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছেই, যখন বিশ্বের শতাধিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বৈবাহিক ধর্ষণকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেছে সেখানে যে 32টি দেশ এখনও এই অন্যায়ের বিচার দিতে অক্ষম তাদের মধ্যে অন্যতম ভারত! প্রশ্ন, তবে কি ভারতীয় আইনব্যবস্থা আজও ভিক্টোরিয়ান পিতৃতান্ত্রিকতা প্রসূত ‘Doctrine of coverture’-কে অনুসরণ করে চলে?
সাম্প্রতিক কালে কেরল হাইকোর্ট ও ছত্তিসগড় হাইকোর্টের পরস্পরবিরোধী রায় গোটা বিষয়টিকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়! এক দিকে, একটি বিবাহবিচ্ছেদ মামলার সাপেক্ষে কেরল হাইকোর্ট জানায়, যদিও ভারতে বৈবাহিক ধর্ষণ দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত নয়, কিন্তু স্ত্রীর ব্যক্তিস্বাধীনতার পরোয়া না করে, সমস্ত আপত্তি অগ্রাহ্য করে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া বৈবাহিক ধর্ষণই বটে এবং তা বিবাহবিচ্ছেদে যুক্তিসঙ্গত কারণ হতে পারে।’’ অন্য দিকে, ছত্তিসগড় হাইকোর্ট অন্য একটি মামলার সাপেক্ষে রায় দেয় যে, স্ত্রীর বয়স যদি 18 বছরের কম না হয়, তবে বিয়ের পর স্বামী যদি স্ত্রীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও সঙ্গমে বাধ্য করেন, তা ধর্ষণ বলা চলে না।’’
মাস তিনেক আগে সামনে আসা এ সংক্রান্ত এক ঘটনায় রীতিমতো শিউরে উঠতে হয়! মাস তিনেক আগেই মহারাষ্ট্রের এক মহিলার অভিযোগ ছিল, তাঁর অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বামীর অবিরাম যৌনখিদে মেটানোর জেরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েছেন তিনি। এ সবের পরেও রাষ্ট্র কী ভাবে উদাসীন থাকতে পারে? অবশ্য অধ্যাপক তথা নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ এক কদম এগিয়ে মনে করেন, ‘‘রাজনীতি নির্বিশেষে প্রতিটি সরকার, এমনকি বামপন্থীরাও উদাসীন নয়, বরং পিতৃতান্ত্রিক পরিবারতন্ত্রকে ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। আদতে তাঁরা পরিবারের স্থিতিশীলতায় বিশ্বাসী আর তাই এই জায়গায় হস্তক্ষেপ করতে ভয় পান।’’
2012 সালে দিল্লির ভয়াবহ নির্ভয়া-কাণ্ডের জেরে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জে সি ভার্মার নেতৃত্বে গঠিত ভার্মা কমিটির ধর্ষণ সম্পৰ্কিত আলোচনায় স্বাভাবিক ভাবেই এসে পড়ে বৈবাহিক ধর্ষণের প্রসঙ্গ এবং এই কমিটির রিপোর্টে বৈবাহিক ধর্ষণকে শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল যা তৎকালীন ইউপিএ সরকার নাকচ করে দেয়। পরবর্তী বিজেপি সরকারের চিন্তাধারাও একই খাতে বহমান। ২০১৫ সাল নাগাদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হরিভাই পার্থিভাই চৌধুরী রাজ্যসভায় বলেছিলেন, ‘‘বৈবাহিক ধর্ষণের আন্তর্জাতিক যে ধারণা তা ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োগ সম্ভব নয়।’’ পরে তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিশু ও নারীকল্যাণ মন্ত্রী মানেকা গাঁধীও একই সুরে বৈবাহিক ধর্ষণকে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে অলীক কল্পনা বলে দাবি করেন। তাঁর যুক্তিতে, এ দেশে নিরক্ষরতা, দারিদ্রতা, নানাবিধ সামাজিক সমস্যা, যুগ যুগ ধরে প্রচলিত ধর্মীয় রীতিনীতি ও মূল্যবোধ বিবাহকে একটি পবিত্র প্রতিষ্ঠা্ন হিসাবে গড়ে তুলেছে। তাই বৈবাহিক ধর্ষণকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসাবে ঘোষণা এই বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান ও পরিবারের ধারণাকে খর্ব করবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, মেয়েরা নিজেদের উপর হওয়া অন্যায়-অত্যাচার নিয়ে কতটা সোচ্চার?
শাশ্বতী ঘোষের বক্তব্য, ‘‘ক’টা মেয়ের বিয়ের পর আলাদা স্যালারি অ্যাকাউন্ট থাকে? আর এখান থেকেই একটি মেয়ের নিজেকে বৈবাহিক সম্পর্কে ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’ ভাবার পরিসর তৈরি হয় আর সেই পরিসর থেকেই স্বামীর শরীরী আগ্রাসনের বিরদ্ধে লড়াটা খুব মুশকিল হয়ে যায়।’’ বৈবাহিক জীবনে সম্মতিহীন যৌনতা যে নির্যাতন, সে সম্পর্কে কত জন মহিলা সচেতন? শাশ্বতীর কথায়: ‘‘তাঁরা সকলেই সবটা বোঝেন, কিন্তু বিয়েটা তাঁদের কাছে বাধ্যতা! আক্ষেপ, আদপে অধিকাংশ মেয়েরই দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। আমাদের সমাজে একটি উচ্চশিক্ষিত স্বনির্ভর মেয়ের কাছেও বিয়েটা হল একটা আশ্রয় বা মুখরক্ষার জায়গা, সেই কারণেই মেয়েদের ভিতর থেকে প্রতিবাদের জায়গাটা খুব কম তৈরি হয়৷ আবার অনেক ক্ষেত্রেই অবশিষ্ট প্রেম কিংবা আমি চোখের সামনে থাকলে হয়তো মানুষটা শুধরে যেতে পারে এই আশা তাঁদের চুপ করিয়ে রাখে। আসলে মেয়েরা অনেকগুলি স্তরে বিয়েটাকে আঁকড়ে থাকে।’’
কিন্তু, নারী শরীরের উপর পুরুষের এই অনৈতিক আধিপত্য আর কত দিন? পুরুষেদের বুঝতে হবে, বিয়ে কোনও যৌনচুক্তি নয় এবং স্ত্রী তাঁর যৌনদাসী নন, বিয়ে করেছেন বলেই স্ত্রী যন্ত্রচালিতের মতো অবিরাম যৌনসুখ দিতেও বাধ্য নন। যৌনতা কেবল শারীরিক নয়, মানসিক বিষয়ও বটে। সম্মতিহীন যৌনতা সর্বদাই ধর্ষণ তা স্বামীই করুক বা অন্য কেউ। মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘ভারতীয় সমাজে বৈবাহিক ধর্ষণ কেমন যেন এক 'সোনার পাথরবাটি', যে কারণে মহিলারা ভাবেন, আমার স্বামী আবার আমাকে কী রেপ করবে! সম্মতি-অসম্মতির তোয়াক্কা না করেই বিবাহের মাধ্যমে তো আমার উপর তাঁর অধিকার কায়েম হয়েই গিয়েছে। আমরা ধরেই নিই যে বিবাহের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে দু'জন রয়েছেন, বিশেষ করে এক জন নারীর যৌনতা, চাহিদা আলাদা করে কিছু থাকবে না, তাঁর কাজটা প্রায় এক জন ‘সার্ভিস প্রোভাইডার’-এর মতো হবে যাঁকে তাঁর স্বামীকে খুশি করতে হবে এবং এক জন পুরুষ এটা জেনেই বড় হচ্ছেন।’’
2016 সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি ছবি ‘পিঙ্ক’-এ অমিতাভ বচ্চন অভিনীত চরিত্র দীপক সেহগলকে কোর্টরুমে বারংবার ধর্ষকের উদ্দেশে বলতে দেখা গিয়েছিল, ‘‘NO MEANS NO!!’’ তেমনই এই সমাজের পুরুষদেরও এই ‘না’ শব্দটির গুরুত্ব বুঝতে হবে! এ সমাজে এই এক জায়গায় এসে উঁচু-নিচু নির্বিশেষে সমাজের প্রতিটি মহিলা একই ধাপে দাঁড়িয়ে! এ ব্যাপারে সহমত পোষণ করে অধ্যাপক ঘোষ তাঁর এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন। তিনি বলেন, "আমাকে এক মহিলা ব্যাঙ্ক অফিসার এক বার বলেছিলেন যে, দিনে বাড়িতে ও অফিসে ঝিয়ের মতো খাটি আর রাতে প্রসের মতো শুই!"
বৈবাহিক জীবনের যৌনতায় স্ত্রীর সম্মতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের মুখ ফিরিয়ে থাকার এই প্রবণতার শেষ কোথায়? অবশ্য শাশ্বতী ঘোষ এবং অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, Domestic violence act (2005)-এর মধ্যে বৈবাহিক ধর্ষণের একটা দিক রয়েছে, তবে তা কেবল সুরক্ষাপ্রদায়ী। এইটুকুই কি যথেষ্ট? প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে!
শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ অবলম্বনে নির্মিত সিরিজ ‘মন্দার’ এক ক্ষমতার লড়াই ও করুণ পরিণতির গল্প বলে।
দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে আবর্তিত পারিবারিক আবেগের গল্প একান্নবর্তী, মৈনাক ভৌমিকের নতুন সৃষ্টি।
ভারতীয় রাজনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে পরিবারতন্ত্র, তবে এর সমালোচনা বিজেপির মুখে মানায় না
হিজাব পরা ছবির জন্য বাতিল হল চাকরির আবেদনপত্র, মামলা হাইকোর্টে
আইন যা-ই বলুক, স্ত্রীর অসম্মতিতে বলপূর্বক যৌনসঙ্গম আদপে কিন্তু ধর্ষণই!
শবরপাড়ার মেয়েরা লড়াই করতে জানে। ওদের কোনও ইনাম লাগবে না, লাগবে শুধু অধিকারটুকু