×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ওয়েব সিরিজ: ‘মন্দার’

    সুদীপ্ত চ্যাটার্জি | 23-11-2021

    মন্দারের পোস্টার

    খিদে খিদে সব ওই খিদের দোষ,/ভুখা মানুষ রাক্ষস!’

     

    মন্দার’ এক খিদের গল্প, ক্ষমতার খিদে, কামনার খিদে, মাংসের খিদে। যে খিদে মানুষকে বানায় রাক্ষস, যে রাক্ষস শুধু রক্ত চেনে, ক্ষমতা চেনে, তার কোনও জাত নেই, ধর্ম নেই।

     

    সাড়ে 400 বছর আগে স্কটল্যান্ডের প্রেক্ষিতে রচিত শেক্সপিয়রের ক্ল্যাসিক নাটক ‘ম্যাকবেথ’ এবং বাংলার এক প্রান্তিক সমুদ্রনগরীর  ‘মন্দার’-কে সময়কাল ভেদে অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করেছেন পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য। পরিচালক হিসাবে হাতেখড়ি হলেও মন্দার দেখতে বসে এক বারও মনে হয় না ক্যামেরার পিছনে প্রথম বারের নিয়ন্ত্রক তিনি।

     

    গেইলপুর সমুদ্রতীরের এক গ্রাম্য জনপদ, যার সর্বত্র নোনা লোভের ও রক্তের আঁশটে গন্ধ। এখানকার রাজা ডানকান থুরি ডাবলু ভাই। যিনি গেইলপুরের ভাগ্যনির্ধারক, মাছের ভেড়ির একচেটিয়া মালিক। তাঁর দুই বিশ্বস্ত আজ্ঞাবহ হল মন্দার ও বঙ্কা। এখানে কেউ চায় রাজা হতে, কেউ চায় রাজার ‘বাপ’ হতে, আবার কেউ চায় সন্তানসুখ। কিন্তু এই সমস্ত চরিত্রের ‘পাপের ঘড়া পূর্ণ’ হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকে এক বুড়ি, তার পাগল ছেলে আর পোষ্য কালো বিড়াল। এই বুড়িই মন্দারের মস্তিষ্কে বপন করে দেয় উচ্চাকাঙ্খার বীজ। ডাবলু ভাইকে হত্যা করে গেইলপুরের রাজপাট হস্তগত করার খেলায় মেতে ওঠে মন্দার, সঙ্গে হত্যাসঙ্গিনী গেইলপুরের ‘ল্যাডি ম্যাকবেথ’ লায়লি। এর পর গেইলপুর এগোতে থাকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে। লোভ, যৌনতা, বেইমানি, হত্যা, প্রতিশোধ— সব মিলিয়ে চরিত্ররা তলিয়ে যায় এক অতল অন্ধকার গহ্বরে। সব গ্রাস করতে থাকে ক্ষমতার খিদেয় মত্ত রাক্ষস।

     

    কী ভাবে রাজ সিংহাসন কণ্টকাকীর্ণ হয়ে উঠল, ভাগ্যর পরিহাসে ম্যাকবেথ দম্পতির শেষ পরিণতি কী হল, তা কম-বেশি সব পাঠকেরই জানা। তবে পরিচালক কিন্তু নাটকটিকে হুবহু অনুসরণ করেননি, বরং মাঝেমধ্যেই নানাবিধ সৃষ্টিশীল পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। ফলে, নাটকটি যাঁদের জানা বা অজানা, সকলের জন্যই চমক রাখার চেষ্টা করেছেন অনির্বাণ তাঁর প্রথম পরিচালনায়।

     

    অনির্বাণের সুদক্ষ নির্দেশনায় লেডি ম্যাকবেথ হয়ে উঠেছেন লায়লি, ব্যাঙ্কো হয়েছেন বঙ্কা, ব্যাঙ্কোর ছেলে ফ্লুয়ান্স হয়েছে ফান্টুস, ম্যাকডাফ এখানে মদন। এই ভাবেই পরিচালক নিজের সৃজনশীলতায় সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করেছেন ‘মন্দার’কে। সবচেয়ে চমকপ্রদ বদল হল তিন ডাইনি এখানে রূপান্তরিত হয়েছে বুড়ি, তার ছেলে ও পোষ্য কালো বিড়ালে, পর্দায় তাদের উপস্থিতি শিরদাঁড়া দিয়ে রীতিমতো হিমেলস্রোত বইয়ে দেয়। তাঁদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সর্বত্র। প্রথম পরিচালনায় অত্যন্ত যত্ন‌সহকারে নিজের জন্যও একটি চরিত্র বুনতে কার্পণ্য করেননি অনির্বাণ। যেখানে প্রায় প্রতিটি চরিত্রই কথা বলছে পূর্ব মেদিনীপুরের আঞ্চলিক ভাষায়, সেখানে নতুন আসা অসৎ পুলিশ অফিসার ‘মুকাদ্দার মুখার্জি’ প্রথম থেকে বলে চলেছেন ঝরঝরে ইংরেজি কিংবা বেশ মাজা বাংলা, এখানেই এই চরিত্র ব্যতিক্রমী। তাই বলাই বাহুল্য, পরিচালক হিসাবে অভিনেতা অনির্বাণ প্রথমেই ছক্কা হাঁকিয়েছেন। যেমন অভুতপূর্ব গল্পের বুনন, তেমনই অসম্ভব সুন্দর দৃশ্যায়ন। পরিচালক হিসাবে অভিনেতা বাছার ক্ষেত্রে তিনি খাঁটি জহুরির পরিচয় দিয়েছেন।

     

    কেবল অনির্বাণ, সোহিনী বা দেবেশ রায়চৌধুরীর মতো দুঁদে অভিনেতাই নন, প্রত্যেকেই আলাদা ভাবে নজর কেড়েছেন। মন্দার চরিত্রাভিনেতা দেবাশিস তাঁর অভিনয়ের মাধ্যমে জীবন্ত করে তুলেছেন প্রট্যাগনিস্ট চরিত্রটিকে। অভিনেত্রী সোহিনী সরকার নিজগুণে অন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন ‘লেডি ম্যাকবেথ’ লায়লিকে। শঙ্কর দেবনাথ (বঙ্কা) বা লোকনাথ দে (মদন) অসম্ভব সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন নিজ নিজ চরিত্রকে। মোকাদ্দার মুখার্জির চরিত্রে পরিচালকের সুনিপুণ হাস্যরসাত্মক অভিনয়ে এক অন্য অনির্বাণ ধরা দিলেন। বুড়ি ও তাঁর ছেলের চরিত্রে সজল মণ্ডল ও সুদীপ ধাড়া এই সিরিজের অন্যতম আকর্ষণ। তাঁদের মেকআপের জন্য বিশেষ প্রশংসার দাবিদার সোমনাথ কুণ্ডু। ডাবলু ভাইয়ের ভূমিকায় বহু দিন পর দেবেশ রায়চৌধুরী আবার যেন তাঁর জাত চেনালেন।

     

    অভিনয়ের সঙ্গে উঠে আসে সিনেম্যাটোগ্রাফির কথা। আর এ ক্ষেত্রে এক পরিচিত নাম সৌমিক হালদার, তিনি ক্যামেরা পরিচালনায় পর্দা জুড়ে ম্যাজিক করেছেন। গেইলপুরের দুনিয়াকে যে ভাবে দেখানো হয়েছে এবং কিছু ট্রানজিশন শট ওয়ান টেক শট আছে যেগুলো অসাধারণ। সারাক্ষণ টান টান উত্তেজনা বজায় ছিল। সিরিজ জুড়ে রয়েছে নানা প্রতীকের ব্যবহার। কোথাও খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক বোঝাতে বিড়াল আর বড়শিতে গাঁথা মাছ, আবার কখনও লায়লির হ্যালুসিনেশনের দরুণ একটানা বিছানার চাদর কেচে যাওয়া।

     

    অনির্বাণ যে প্রচুর সিনেমা দেখেন এবং world cinema-র একনিষ্ঠ ভক্ত তা এই সিরিজ দেখলে বোঝা যায়। পরিচালক হিসাবে তাঁর প্রথম কাজে তিনি ট্যারেন্টিনোর স্টাইল অনুসরণ করে পাঁচটি এপিসোডকে গল্পের গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী আলাদা আলাদা নাম দিয়েছেন। কখনও ‘মাছের গলায় মাছের কাঁটা’ আবার কখনও ‘গভীর জলের মাছ’ ইত্যাদি। বাংলা ওয়েব সিরিজের সব থেকে যে বিষয়টি এত দিন ধরে মিসিং ছিল সেটা এখানে ভাল মাত্রায় উপস্থিত। স্লো বার্ন ট্রিটমেন্ট, ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট। ‘মন্দার’-এ চরিত্রগুলোকে এত সময় নিয়ে এবং নিখুঁত করে ডেভেলপ করা হয়েছে যে সিরিজটা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও চরিত্রগুলো দর্শকের মনে দাগ কেটে যেতে বাধ্য।

     

    আরও পড়ুন:সিনেমা:জয় ভীম

     

    আদপে 16 শতকে একটি মহাকাব্যের অনুসরণে নির্মিত ‘মন্দার’-এর পরতে পরতে লুকিয়ে সমসাময়িক সমাজ, রাজনীতি, মানুষের ক্ষমতার লোভ, নৈতিকতাবোধ বিসর্জনের ছবি। তবে এত মুগ্ধতা সত্ত্বেও কিছু কিছু দৃশ্যের অতিনাটকীয়তা বহু দর্শককে নিরাশ করতে পারে। তা ছাড়া ম্যাকডাফ, অর্থাৎ মদন এই সিরিজে পঞ্চায়েতস্তরের এক নেতা। সামনেই ভোট। যে ভোটের আগে নিজের ইমেজ নিয়ে চিন্তিত বটে তবে কয়েকটি জোড়হাত নেতাসুলভ ব্যানার ছাড়া রাজনৈতিক কার্যকলাপ সেই ভাবে কিছুই দেখা গেল না যা শিয়রে ভোট থাকা রাজনীতিকের জন্য কিছুটা অস্বাভাবিক।

     

    এ সব বাদ দিলে বলা যায় যে বাংলা ওয়েব সিরিজের জগতে যে ঝাঁকুনির প্রয়োজন ছিল তা ‘মন্দার’ সফল ভাবে দিতে পেরেছে। ‘ম্যাকবেথ’ ও ‘মন্দার’-এর প্রতিটি চরিত্রকে এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে ক্ষমতালিপ্সা, লোভ, কামনা, বাসনা, অপরাধবোধ। সব মিলিয়ে ‘হইচই’ প্ল্যাটফর্মে ‘মন্দার’ বাংলা সিরিজের দুনিয়ায় যে উঁচু পাচিল তৈরি করে দিল তা সফল ভাবে টপকাতে এর পর পরিচালকদের কালঘাম ছুটতে চলেছে, এ কথা বলাই যায়।

     

    রেটিং- 4.8/5


    সুদীপ্ত চ্যাটার্জি - এর অন্যান্য লেখা


    শীত দরজায় কড়া নাড়লেও খাদ্যরসিক বাঙালির পাতে শীতের সব্জির দেখা নেই।

    দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে আবর্তিত পারিবারিক আবেগের গল্প একান্নবর্তী, মৈনাক ভৌমিকের নতুন সৃষ্টি।

    হিজাব পরা ছবির জন্য বাতিল হল চাকরির আবেদনপত্র, মামলা হাইকোর্টে

    ক্রিপ্টোকারেন্সি ও ভারতে তার ভবিষ্যৎ

    শবরপাড়ার মেয়েরা লড়াই করতে জানে। ওদের কোনও ইনাম লাগবে না, লাগবে শুধু অধিকারটুকু

    ভারতীয় রাজনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে পরিবারতন্ত্র, তবে এর সমালোচনা বিজেপির মুখে মানায় না

    ওয়েব সিরিজ: ‘মন্দার’-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested