×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • হিজাব পরলে চাকরি নেই?

    সুদীপ্ত চ্যাটার্জি | 01-12-2021

    প্রতীকী ছবি

    পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের (West Bengal Police Recruitment Board) দফতরিরা বোধহয় গত বছর দুমকা সফরে যাওয়া প্রধানমন্ত্রীর(Narendra Modi) 'পোশাক দেখে চিনে ফেলার' নিদানকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছেন আর তার প্রভাবে হিজাব(Hijab)পরা ছবি দিয়ে আবেদন করায় চাকরির সুযোগ হারালেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাঁচ তরুণী।

     

    ঘটনার সূত্রপাত এ বছর সেপ্টেম্বর নাগাদ। গত বছর পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড (West Bengal Police Recruitment Board) 7740 জন পুরুষ কনস্টেবল ও 1192 জন মহিলা কনস্টেবল(Lady Constable) নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এবং সেই অনুযায়ী অনলাইনে ফর্ম জমা দেওয়ার কথা বলা হয়। মহিলা কনস্টেবল নিয়োগের ফর্ম পূরণের ক্ষেত্রে মুসলিম সম্প্রদায়ের কয়েক জন চাকরিপ্রার্থী মাথায় ঘোমটার মতো করে হিজাব পরা ছবি আপলোড করায় তাঁদের ফর্ম বাতিল করে দেওয়া হয়। যদিও ফর্মের ছবিতে তাঁদের মুখ স্পষ্ট ভাবেই দৃশ্যমান ছিল তাই আইডেন্টিফিকেশন জনিত সমস্যা না হওয়ারই কথা।

     

    তা হলে কেন তাঁদের আবেদনপত্র খারিজ করে দেওয়া হল? গত ২৬ সেপ্টেম্বর এই পদের প্রাথমিক লিখিত পরীক্ষার দিন স্থির হয় ও ৬ সেপ্টেম্বর থেকে admit card দেওয়া শুরু হয়। সোনামণি, তুহিনা-সহ বাকিরা আবেদনপত্র সংশোধনের আর্জি জানালেও তা খারিজ করে দেয় পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড। এমনকি, আবেদনকারীরা সল্টলেকে পুলিশ বোর্ডের দফতরে অধিকারিকদের সঙ্গে দেখা করতে গেলেও তাঁদের গ্রেফতারের হুমকি দেওয়া হয়। তাঁদের আবেদনপত্র বাতিলের কারণ হিসাবে জানানো হয় যে, খোলা চুলে তাঁদের ছবি দিতে হবে। যা তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত দেয়।

     

     করিপ্রার্থীদের বক্তব্য ছিল, বারংবার ফর্ম ফিল আপের পরেও তা করে দেওয়া হয়েছে, তবে কি হিজাবধারী মহিলারা পুলিশের পেশায় আসতে পারবেন না? এর আগেও তাঁরা পরীক্ষা দিয়েছেন, এমনকি, হিজাব পরেই মাঠে দৌড়েছেন, সে ক্ষেত্রে তা গ্রহণ করা হলে, এখানে বাতিল হল কেন? তাঁদের দাবি ছিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁদের admit card দেওয়া হোক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বোর্ড নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় গত ২৬ সেপ্টেম্বর তাঁরা পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাননি। তাই তাঁরা বোর্ডের এই সিদ্ধান্তের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং তাঁদের উপর হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন। সেই মামলার প্রথম শুনানি হয় সম্প্রতি।

     

    মামলাকারীদের সাফ বক্তব্য, ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করা রাষ্ট্রের কাজ হতে পারে না। ধর্ম-বর্ণ-জাতপাত কিংবা কোনও ব্যক্তির পোশাক (বিশেষত তা যখন ধর্মীয় আবেগপ্রসূত) তা তাঁর যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে না। কোরানে মুসলিম সম্প্রদায়ের মহিলাদের মাথার একাংশ ঢেকে রাখার কথা বলা হয়েছে, আর তা কেউ যদি পালন করে সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাস।

     

    বিচারপতি অরিন্দম মুখোপাধ্যায় স্পষ্টত প্রশ্ন তোলেন, যদি শিখ ধর্মাবলম্বীরা তাঁদের ধর্মীয় রীতি মেনে পাগড়ি পরা ছবি অফিসিয়াল ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারেন তবে হিজাবে আপত্তি কোথায়? গত সেপ্টেম্বরেই এই পদের পরীক্ষা হয়ে গেলেও মামলাটি গ্রহণের সঙ্গেই জানিয়ে দেওয়া হয়, এই মামলার ভবিষ্যতের উপর নির্ভর করছে এই পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ।

     

    একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে স্বাধীন ভারতের সংবিধানে যখন প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত, তা হলে সোনামণি, সারিকা, ফিরদৌসিদের মৌলিক অধিকার খর্ব হয় কী ভাবে? সারা বছরের কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে চাকরিপ্রার্থীরা তিলে তিলে নিজেদের প্রস্তুত করেন পরীক্ষাগুলির জন্য। এমনিতেও এ রাজ্য সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তি বর্তমানে ‘ডুমুর ফুল’ বলে বহু ক্ষেত্রেই অভিযোগ ওঠে। বহু অপেক্ষার পর যখন বিজ্ঞপ্তি বেরোল তখন কেবলমাত্র ‘হিজাব’ দিয়ে মাথার একাংশ ঢাকা থাকার ‘অপরাধে’ অযৌক্তিক ভাবে তাঁদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়া হল। বহু প্রতীক্ষিত সুযোগ তাঁদের হাতছাড়া হল কেবল বোর্ডের এই মানসিকতার জন্য।

     

    ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ 25 প্রতিটি নাগরিকের ধর্মের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। যে কোনও ব্যক্তি নিজের ইচ্ছামাফিক যে কোনও ধর্মপালন করতে পারেন। মুক্তকণ্ঠে নিজের ধর্মবিশ্বাস প্রকাশ করতে পারেন। স্বাধীন ভাবে নিজের ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতে পারেন। হিজাব পরা ইসলাম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় রীতির বিষয়। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের এ হেন তুঘলকি সিদ্ধান্ত ওই পাঁচ তরুণীর সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়!

     

    আরও পড়ুন: পরিবারতন্ত্র নিয়ে কথা বলছে বিজেপি-ও!

     

    স্বাধীন ভারতে কোনও চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন কারও ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয় বিশেষ প্রাধান্য পাওয়ার কথা নয়, তেমনই কারও জাতিগত বা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বঞ্চিত হওয়াও কাম্য নয়। কে হিজাব পরবে বা কে ঘোমটা দেবে, কে ফেজ টুপি মাথায় দেবে নাকি পাগড়ি বাঁধবে, এ সব যার যার ব্যক্তিগত বিষয়। তার সঙ্গে সেই ব্যক্তির যোগ্যতা, মেধার কী সম্পর্ক থাকতে পারে? তা-ও যদি আইডেন্টিফিকেশন জনিত সমস্যা হত পরীক্ষার্থীর কোনও ভাবে মুখ ঢাকার জন্য সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাঁদের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। তবে কেন দীর্ঘ পরিশ্রমের পরেও তাঁরা সুযোগই পেলেন না নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করার? যুগ এগোলেও আমাদের মানসিকতা যেন সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের ছাপই বহন করে চলেছে।

     

     ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠছে, যদি রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা ভোটের সময় বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়কে খুশি করতে তাঁদের মতো পোশাক-পরিচ্ছদ পরে ভোট প্রার্থনা করতে পারেন, এমনকি, তেমন পোশাক পরিহিত প্ল্যাকার্ড লাগানো হতে পারে বিভিন্ন এলাকায়, তবে এক জন চাকরিপ্রার্থী নিজের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী পোশাক পরলে তাতে ক্ষতি কী? আবার এমন প্রশ্নও উঠছে, সরকার কি তবে চাইছিল যে এমন কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটুক, আর ভুক্তভোগী কোনও চাকরি প্রার্থী এমনই মামলা দায়ের করুন যাতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে!

     

    এ সমস্ত প্রশ্ন আর প্রতিপ্রশ্ন উঠতেই থাকবে, মাঝখান থেকে একটা একটা করে বছর বয়ে চলেছে তীব্র গতিতে, এই এক একটা বছরের গুরুত্ব যে কতটা অপরিসীম তা একমাত্র চাকরিপ্রার্থীরাই বোঝেন!


    সুদীপ্ত চ্যাটার্জি - এর অন্যান্য লেখা


    শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ অবলম্বনে নির্মিত সিরিজ ‘মন্দার’ এক ক্ষমতার লড়াই ও করুণ পরিণতির গল্প বলে।

    ক্রিপ্টোকারেন্সি ও ভারতে তার ভবিষ্যৎ

    হিজাব পরা ছবির জন্য বাতিল হল চাকরির আবেদনপত্র, মামলা হাইকোর্টে

    শবরপাড়ার মেয়েরা লড়াই করতে জানে। ওদের কোনও ইনাম লাগবে না, লাগবে শুধু অধিকারটুকু

    দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে আবর্তিত পারিবারিক আবেগের গল্প একান্নবর্তী, মৈনাক ভৌমিকের নতুন সৃষ্টি।

    আইন যা-ই বলুক, স্ত্রীর অসম্মতিতে বলপূর্বক যৌনসঙ্গম আদপে কিন্তু ধর্ষণই!

    হিজাব পরলে চাকরি নেই?-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested