×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • শবরপাড়ার সরস্বতীরা লড়তে জানে

    সুদীপ্ত চ্যাটার্জি | 07-12-2021

    নিজস্ব ছবি

    আমি জামবনির শিবু কুইড়ির বেটি সাঁঝলি বটে...', শবর (Shabar) সমাজের এমন শত শত সাঁঝলি প্রতিনিয়ত সর্বশিক্ষা অভিযান'-এর (Sarva Shiksha Abhiyan) দেশে লড়াই করে চলেছে নিজেদের অশিক্ষার করালগ্রাস থেকে বেরিয়ে আসতে। ইংরেজ আমল থেকে চোর বদনামে বিদ্ধ শবর জাতির কন্যাদের কেউ কেউ আজ ‘সম্মানীয় স্নাতক’ (Graduate) ব্রিটিশ আমল থেকেই শবর মানে ছিল, চোরেদের জাতি’। কোথাও কোনও কিছু চুরি হলেই, দু'চারটে শবরকে ধরে এনে, গারদে পুরে দেওয়া হত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে, গোটা দেশ বদলে গেলেও পরিস্থিতি এখনও সেই তিমিরেই রয়েছে বাঁকুড়া (Bankura), মেদিনীপুর (Midnapore) ও পুরুলিয়ার (Purulia) শবরদের ক্ষেত্রে। এখনও এলাকায় চুরি হলেই সন্দেহ গিয়ে পড়ে শবরদের উপরেই।

     

    গত বছর পুরুলিয়ার বরাবাজার থানার ফুলঝোর গ্রামের  সেই শবর জনজাতির মেয়ে রমনিতা প্রথম স্নাতকস্তরে উত্তীর্ণ হয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। সম্প্রতি রমনিতার ধারাকে অক্ষুণ্ণ রেখে খেড়িয়া জনজাতির শবরকন্যা রত্নাবলী দীর্ঘ প্রতিকূলতা পেরিয়ে পুরুলিয়ার সিধু-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের (Sidhu Kanhu Birsa University) অধীনস্ত বিক্রম টুডু মেমোরিয়াল কলেজ থেকে বাংলা, ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পাসকোর্সে স্নাতক হন। আর তারপরেই জেলা পুলিশ থেকে স্থানীয় প্রশাসনের নজর পড়ে তাঁর দিকে, শুরু হয় দেদার ইনামের বহর! জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয় তাঁর কী পুরস্কার চাই? তিনি জানান, তাঁর পাড়ার মানুষদের জলকষ্ট মেটাতে তিনি একটি নলকূপ চান। কারণ শবর পাড়ায় কোনও নলকূপ নেই, রত্নাবলীর পাড়ার মেয়ে-বউদের সেই হাইস্কুলের ধারের নলকূপ থেকে হেঁটে গিয়ে জল আনতে হয়।

     

    আরও পড়ুন:জাতিবৈষম্যের এ দেশে রোহিত ভেমুলারা মরতেই থাকবেন?

     

    কবি দেবব্রত সিংহের ‘তেজ' কবিতার ‘কামিন খেটে মাইধ্যমিকে পেত্থম হওয়া সাঁঝলি আর বাস্তবের রত্নাবলীদের জীবনের গতিপ্রবাহ কোথাও একই খাঁড়িতে এসে আটকে যায়! অল্পবয়সে বাবা নামক বটবৃক্ষের ছায়া সরে যায় রত্নাবলীর মাথা থেকে, মা মঞ্জুরা শবর দিনমজুরি করে দুই মেয়ে ও ছেলেকে বড় করেন। তাঁর ছোটবোন সপ্তম শ্রেণিতে পড়তে পড়তেই বিয়ের পিঁড়িতে উঠে যায় সমাজের চাপে। ভাই মাধ্যমিকের আগে থেকেই কাজ জুটিয়ে নেয়, শত সামাজিক নিন্দা-মন্দ, অকথা-কুকথাকে কার্যত তোয়াক্কা না করে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছেন লটপদা গ্রামের ‘জেদি মেয়েটা'

     

    কিন্তু এই লড়াইয়ে সময়ে কি আজকের সংবর্ধনাদাতাদের পেয়েছিলেন পাশে? "ছোটবোন সেই কবে বিয়ে করে ভরা সংসারী, আর বুড়ো আদ্দামড়ি মেয়ে কিনা এখনও বইয়ের পাতা উল্টে যাচ্চে...’, পাড়া-প্রতিবেশীদের এ সমস্ত বাক্যবাণে যখন প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন রত্নাবলী, তখন কি কাউকে পাশে পেয়েছিলেন? চূড়ান্ত অর্থকষ্টে সংসার চালাতে কালঘাম ছুটে যায়, কিন্তু নতুন বছরে কয়েকটা বই না কিনলেই নয়! শুধু কলেজের ক্লাসের ওই নোটস দিয়ে ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না ব্যাপারগুলো, কিন্তু বইয়ের যে অনেক দাম! তখন কি আজকের প্রশংসা কর্তারা জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁর কী কী বই লাগবে? না! কেউ কোনও দিন ঘুরেও তাকায়নি, বরং রত্নাবলীর বাড়বাড়ন্ত দেখে পাড়ার বাকি মেয়েদের উপর বিধিনিষেধ বেড়ে গিয়েছিল, আর সেই ছোট ছোট মেয়েরাও রত্নাবলীকে দেখে লেখাপড়া শেখার স্বপ্নকে কংসাবতীতে ভাসিয়ে, ক্রমশ নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছে সাংসারিক কাজের চৌহদ্দিতে।

     

    তবে আজ রত্নাবলী দেখিয়ে দিয়েছেন, সব অপমান প্রতিকূলতার জবাব তিনি দিয়েছেন। খবরের কাগজে তাঁর ছবি বেরিয়েছে, তাঁর জন্য তাঁদের গ্রামের নামডাক হয়েছে, তাই আজ তিনি শবরপাড়ার গর্ব, ব্লকের গর্ব, জেলার গর্ব...কিন্তু এই হঠাৎ গর্ব হয়ে ওঠার আগের সংগ্রামের দিনগুলো ,লড়াইয়ের রাতগুলোয় আজকের ইনামদাতারা যদি একটু সজাগ থাকতেন, পাশে দাঁড়াতেন, তা হলে রত্নাবলীর এ সাফল্য আরও অনেক রেকর্ড ভেঙে ফেলতে পারত হয়তো!

     

    আচ্ছা, এ সমাজের চ্যাটুজ্জে-মুখুজ্জে-দত্ত-চৌধুরীরা বা পাল-সেন-দাসেরা স্নাতক হলে তো এত উত্তেজনা বা উদযাপন হয় না। জেলাপ্রশাসনের কর্তব্যাক্তিরা ইনাম দিতেও ছুটে আসেন না। কেন? কারণ, এই সমাজে স্নাতক হওয়া কোনও বিশেষ সাফল্যের বিষয় নয়, কারণ, অমন হুদোহুদো স্নাতক প্রতি বছর পাশ করে। অর্থাৎ, গ্র্যাজুয়েট হওয়া এ সমাজে অতি সাধারণ ও স্বাভাবিক, কিন্তু রত্নাবলীদের সমাজে আজও তা অস্বাভাবিক। কারণ,তাঁদের সমাজে স্নাতকধারীর সংখ্যা হাতেগোনা। চাটুজ্জে-মুখুজ্জেরাও এ দেশের নাগরিক, আবার কুইড়িরাও। তবু জীবনযাত্ৰা থেকে শিক্ষার অধিকারে আজও লক্ষযোজন ফাঁক! স্বাধীনতার এত বছর পরেও প্রতিটি সরকারের রাশি রাশি প্রকল্প, কর্মসূচি, আশ্বাসবাণীর পরেও কেন বদলালো না তাঁদের জীবন?

    অবশ্য তাঁদের পাড়ায় এখনও একটা নলকূপ বসানোর ফুরসত হয়নি প্রশাসনের, সে কারণে রত্নাবলী পুরস্কার হিসাবে কোনও দামী আসবাব নয়, বরং চেয়ে বসেছে একটা নলকূপ! স্থানীয় বিডিও মাসুদ রাইহান বললেন, ""ওঁদের পাড়ায় তো জলকষ্ট থাকার কথাই নয়, তবু কোথায় নলকূপ বসানো যায় দেখব!

     

    শবর সমাজের হাজার হাজার "শিবু কুইড়ির বেটিরা' হয়তো আজও গুমরে গুমরে লড়াই করে চলেছে। আজ তাঁদের পাশে প্রশাসনিক বাবুরা নেই, কোনও নেতা-মন্ত্রী নেই, কিন্তু যে দিন "লোধা মেয়ে' চুনি কোটালের যোগ্য উত্তরসূরি রমনিতা-রত্নাবলীর মতো আরও শবরকন্যা সাফল্যের মুখ দেখবেন, সে দিন তাঁদের কুঁড়ের বাইরে ফুল আর মেকি সাহায্যের আশ্বাসবাণী নিয়ে হাজির হবেন ডজনখানেক বাবু! ক্যামেরার শাটারের আওয়াজে ভরে উঠবে ওদের ছোট্ট কুঁড়ে, আবার রত্নাবলীর মতো তাঁদেরকেও জিজ্ঞেস করা হবে, কী ইনাম চাই!

     

    "আমার পাড়ায় শয়ে শয়ে আরো অনেক, সাঁঝলি ছে

    আরো শিবু কুঁইরির বিটি আছে গাঁ গেরামে

    তারা যদ্দিন অন্ধকারে পড়ে থাকবেক

    তারা যদ্দিন লেখাপড়ার লাগে কাঁদে বুলবেক

    তদ্দিন কোনো বাবুর দয়া নাই লাগবেক

    তদ্দিন কোনো বাবুর দয়া আমার নাই লাগবেক।

     

    "তেজ' কবিতার সেই বাপমরা সাঁঝলির মতোই নিজের জন্য কোনও দয়া চাননি রত্নাবলী, চেয়েছেন তাঁর পাড়ার শত শত মানুষের কষ্টলাঘব করা একটা নলকূপ, আর চেয়েছেন তাঁর মতো আরও জেদি রত্নাবলীরা যেন এই ভাবেই লড়াই করে ছিনিয়ে নেন তাঁদের অধিকার। শবরপাড়ার এই লড়াকু মেয়েরা সমাজকে দেখিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের হাত কামিন খাটতে যেমন জানে, তেমনই জানে কলম ধরতেও!

     

     


    সুদীপ্ত চ্যাটার্জি - এর অন্যান্য লেখা


    হিজাব পরা ছবির জন্য বাতিল হল চাকরির আবেদনপত্র, মামলা হাইকোর্টে

    দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে আবর্তিত পারিবারিক আবেগের গল্প একান্নবর্তী, মৈনাক ভৌমিকের নতুন সৃষ্টি।

    শীত দরজায় কড়া নাড়লেও খাদ্যরসিক বাঙালির পাতে শীতের সব্জির দেখা নেই।

    আইন যা-ই বলুক, স্ত্রীর অসম্মতিতে বলপূর্বক যৌনসঙ্গম আদপে কিন্তু ধর্ষণই!

    ক্রিপ্টোকারেন্সি ও ভারতে তার ভবিষ্যৎ

    শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ অবলম্বনে নির্মিত সিরিজ ‘মন্দার’ এক ক্ষমতার লড়াই ও করুণ পরিণতির গল্প বলে।

    শবরপাড়ার সরস্বতীরা লড়তে জানে-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested