×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • শিল্পপতিদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক 3: শিক্ষা এবং কৃষিতেও কর্পোরেটের থাবা

    রঞ্জন রায় | 12-12-2020

    প্রতীকী ছবি

    মুকেশ আম্বানী 2017 সালেই জানিয়েছিলেন, কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য তিনটেই তাঁদের রোডম্যাপে আছে। এ বার মজাটা দেখা যাক।

     

    ইউজিসি 2017 সালের শেষের দিকে ঘোষণা করেছিল 10টি পাবলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে গুণমানের হিসেবে নির্বাচিত করে ‘ইনস্টিটিউট অফ এমিনেন্স’ তকমা দেওয়া হবে এবং তারা 1000 কোটি টাকা করে সরকারি সাহায্য পাবে। কিন্তু 10টি শ্রেষ্ঠ প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানকেও একই মাপকাঠিতে ওই টাইটেল দেওয়া হবে, তবে ওদের কোনও টাকা দেওয়া হবে না। কিন্তু 2018 জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করল যে একটি প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ওই সম্মান দেওয়া হবে। সেটি মুকেশ আম্বানীর জিও ইনস্টিটিউট। কী আশ্চর্য! তখনও তো জিও ইনস্টিটিউট শুরুই হয়নি, কেবল ‘ইচ্ছা’ হয়ে মুকেশজির মনের মাঝারে রয়েছে। এ যে রাম না জন্মাতেই রামায়ণ লেখা! লোকজন ওই ‘জিও ইনস্টিটিউট অফ রিলায়েন্স ফাউন্ডেশনে’র ওয়েবসাইট খুঁজে হয়রান হয়ে গেল। অথচ আইআইটি দিল্লি, বম্বে এবং বিটস পিলানির মত এত বছরের পুরনো খ্যাতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জিও ইনস্টিটিউটের নাম একই তালিকায় ঢুকে পড়ল।

     

    আরও পড়ুন: শিল্পপতিদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক 2: প্রস্তাবের আগেই কেচ্ছার শেষ নেই

                                                                               

    অর্থনীতিবিদ অরবিন্দ পানাগড়িয়া, যিনি গোড়ার তিন বছর নীতি আয়োগের কর্ণধার ছিলেন, আমেরিকা থেকে মন্তব্য করলেন, ‘এ ভাবে (না- জন্মানো) কাউকে বর দিতে বুকের পাটা লাগে।’

     

    এ বার কৃষির কথা।

     

    আদানি গ্রুপের কৃষি ব্যবসার সিইও অতুল চতুর্বেদী সম্প্রতি জানিয়েছেন, ‘আদানি অ্যাগ্রো-লজিস্টিক্স’ ফসল গুদামজাত করা, বাজারে পৌঁছনো এবং তার পরিবহণে বড় রকম বিনিয়োগ করেছে এবং ‘আদানি উইলমার জয়েন্ট ভেঞ্চার’ শিগগিরই দেশের বৃহৎ ফুড কোম্পানি হতে চলেছে।

     

    এবারে দেখা যাক তিনটি কৃষি বিল।

     

    আজকে রাজপথে নামা 400টি কৃষক ইউনিয়নের নেতারা সরকারকে প্রশ্ন করছেন—কোনও কৃষক প্রতিনিধি তো এই সংস্কার চায়নি। তবে কার স্বার্থ রক্ষায় এই সংস্কার? 

     

    তিনটে বিলের সার কথা কী?

     

    এক, আগে কৃষকদের থেকে প্রথম দফায় ফসল কেনার অধিকার ছিল শুধু কৃষক মান্ডির ভেতরে লাইসেন্সপ্রাপ্ত আড়তদারদের। দরদামে না পোষালে সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে সেই ফসল কিনে নিয়ে ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার গুদামে রাখত। এখন প্যানকার্ড নিয়ে যে কেউ মান্ডির বাইরে দরাদরি করে ফসল কিনতে পারবে তারা দেশের যে কোন রাজ্যের লোক হলেও, এক দেশ এক বাজার।

     

    দুই, আগে ফসল, খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি 21টি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তালিকায় রাখা হতো এদের একটা নির্দিষ্ট মাপের বাইরে মজুত করা যেত না। বে-আইনি মজুতদারের জেলে যাওয়ার বিধান ছিল। এখন মজুতের কোনও সীমা নেই। ব্যবসায়ী যে কোনও পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত করতে পারে আইন মেনেই।

     

    তিন, চুক্তি চাষ। বড় বড় কর্পোরেট হাউসগুলো চাষিদের আগাম পয়সা দিয়ে চুক্তি করবে (দাদন) যা তারা নির্দিষ্ট ফসল চাষ করে নির্দিষ্ট গুণমানের ভিত্তিতে সেই হাউসগুলোকে বেচতে বাধ্য থাকবে। গুণমান পছন্দ না হলে তা না কিনে খারিজ করাও যাবে। এ নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে কোনও বিবাদ হলে কোর্টে যাওয়া যাবে না। বড় জোর স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট এবং তারপর কালেক্টরের কাছে ‘সমঝোতা’র জন্য যাওয়া যেতে পারে। বাঘে আর ছাগলে! অনেকটা নীলকরদের নীলচাষের মতো লাগছে না?

     

    আরও পড়ুন: শিল্পপতিদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক 1: আপনা হাত জগন্নাথ?

     

    কৃষকদের বক্তব্য, এই তিনটে আইন চাষিদের শোষণমুক্ত না করে কর্পোরেট হাউসদের অবাধ মৃগয়ার স্বাধীনতা দিয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেওয়া অকালি নেত্রী হরসিমরত কৌর বাদল বলেছেন—‘জিও এল, বিনেপয়সায় মোবাইল বিলিয়ে দিল। সবাই ওই ফোন কিনল, অভ্যস্ত হয়ে গেল। কম্পিটিশন ধুয়েমুছে সাফ। ব্যস, জিও ওদের রেট বাড়িয়ে দিল। কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট হাউসগুলো ঠিক এই কাণ্ড করবে।’

     

    প্রতিরক্ষাও এই কর্পোরেট থাবার বাইরে নেই

                                              

    2015 সালের মার্চের শেষ সপ্তাহে নরেন্দ্র মোদী প্যারিস গিয়ে 36টি রাফাল যুদ্ধবিমানের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রজেক্টের জন্য ফ্রান্সের দাসাউ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি ঘোষণা করেন। তার দু’সপ্তাহ আগে অনিল আম্বানী প্যারিসে গিয়ে সে দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করেন। তারপরই প্রায় 30,000 কোটি টাকার দাসাউ-রিলায়েন্স জয়েন্ট ভেঞ্চারের ঘোষণা হয় যে রাফালের যন্ত্রাংশ নাগপুরে আম্বানীর কারখানায় তৈরি হবে। যদিও আম্বানীর যুদ্ধবিমান তো দূরের কথা, কোনও সাধারণ বিমান বানানোরও অভিজ্ঞতা নেই। সে কাজটা বহুদিন ধরে করছে বেঙ্গালুরুতে ভারত সরকারের হ্যাল। তাদের কারখানায় বহুদিন ধরে হেলিকপ্টার এবং মিগ ফাইটারের যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। ছোটভাই অনিল আম্বানীর ওই কারখানাটি এই চুক্তি ঘোষণার মাত্র একমাস আগে তৈরি হয়েছিল। অনেকটা দাদার জিও ইনস্টিটিউটের গল্পের মতো শোনাচ্ছে না?

     

     

    গত বছরের গোড়ায় প্যারিসের নামী সংবাদপত্র ‘লা মঁদ’ একটি রিপোর্ট ছেপে হইচই ফেলে দেয়। তাদের রিপোর্ট ছিল, ফ্রান্স সরকার নাকি ওদেশে অনিল আম্বানীর রিলায়েন্স গ্রুপের মালিকানাধীন একটি কোম্পানিকে প্রায় 143.7 মিলিয়ন ইউরো কর ছাড় দিয়েছে! ফ্রান্স সরকারের ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট হিসেব কষেছিল 151 মিলিয়ন ইউরো। অনিল বললেন 7.6 মিলিয়ন ইউরো। শেষে দিল্লিতে ফরাসি রাষ্ট্রদূত জানান, সাত বছরের পুরনো একটি বকেয়া ট্যাক্স মামলায় নিয়ম মেনেই সমঝোতা হয়েছে।

     

    আরও পড়ুন: নতুন কৃষি আইন: ফড়েরা যা হারাবে তা কি চাষি পাবে?

     

    সব তো বুঝলাম। অতঃকিম?

     

    এই মন্দার সময় ক্রমাগত বেড়ে চলা অনাদায়ী লোনের ভারে ঝুঁকে পড়া সরকারি বা বেসরকারি ব্যাঙ্কও নতুন লোন বেশি দিতে চাইছে না। মাঝারি-ছোট- ক্ষুদ্র শিল্প বা ব্যবসায়ী ইউনিটের লোনের জন্যে ভারত সরকার নিজে 100% গ্যারান্টি দেবে বলে ঘোষণা করেছে। তবু লোনের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত ধীরে বাড়ছে। কিন্তু বর্তমান সংকট থেকে অর্থনীতিকে টেনে তুলতে আর্থিক কাজকর্ম বাড়াতে টাকার যোগান চাই। ব্যাঙ্ক লোনে গতি ও বৃদ্ধি প্রয়োজন।  

     

    তাই নতুন কিছু ব্যাঙ্ক খোলা একটি সম্ভাব্য সমাধান। কিন্তু তাই বলে শিল্পপতিদের ব্যাঙ্ক খুলতে লাইসেন্স? ফের ‘কানেক্টেড লোন’?

     

    কৌশিক বসুর কথায়, ‘এই কানেক্টেড লোন ব্যাপারটাই যে 1997 সালে এশিয়ায় ‘ব্যাড লোন’ বেড়ে ওঠার সবচেয়ে বড় কারণ। এর ফলেই থাইল্যান্ড থেকে ‘পূর্ব এশীয় সঙ্কট’ শুরু হয় এবং সেটা ক্রমশ বিশ্বজুড়ে বিশাল আর্থিক ধসের রূপ নেয়।’ রঘুরাম রাজন ও বিরল আচার্য দু’জনেই বলছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রস্তাবটি— বিভিন্ন শিল্প গোষ্ঠীকে নিজস্ব ব্যাঙ্ক খুলতে লাইসেন্স দেয়া হোক—একটি ‘বম্বশেল’ এবং এই কঠিন সময়ে এ সব পরীক্ষানিরীক্ষা না করে উচিত হবে পুরনো পরীক্ষিত পদ্ধতিতে চলা।

     

    ওই রিপোর্টেই আরেকটি সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। তা হল 10 বছর ধরে ঠিকমত ফাইন্যান্স করে চলা এনবিএফসি বা ‘নন ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল কোম্পানিগুলিকে ব্যাঙ্কিং লাইসেন্স দেওয়া। রঘুরাম রাজনের সময় বন্ধন ব্যাঙ্ক এভাবেই একটি এনবিএফসি থেকে ব্যাঙ্কের মর্যাদা পায়।

     

    এনবিএফসি-রা ব্যাঙ্কের মতোই লোন দিতে পারে, শেয়ার ও সিকিউরিটিজে কেনাবেচা করতে পারে। ফিক্সড ডিপোজিট নিতে পারে, কিন্তু কারেন্ট অ্যাকাউন্ট এবং সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে না, চেকবুক জারি করতে পারে না এবং গ্রাহকের হয়ে থার্ড পার্টি লেনদেন করতে পারে না। এরাই ভারতের অর্থনীতিতে বিভিন্ন স্টার্ট আপ ইউনিটকে ও ছোটখাট ইনফর্মাল ইউনিটকে লোন দেওয়ার মাধ্যমে প্রচুর লোকের রোজগারের ধারক। ইদানীং এদের অবস্থাও খারাপ। তাই অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের ‘প্যাকেজে’ এদের বারবার উল্লেখ।

     

    কৌশিক বসু একমত। কিন্তু উনি সাবধান করছেন, যে ওই এনবিএফসির মধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্থার মালিক বড় শিল্পগোষ্ঠী। তাদের যেন লাইসেন্স না দেওয়া হয়। নয়তো সেই ঘুরিয়ে নাক দেখানো হবে। 

     

    ফের সেই কানেক্টেড লেন্ডিং। তেল কা পয়সা ঘিউ মেঁ, অউর ঘিউ কা পয়সা তেল মেঁ? নৈব নৈব চ!

     

     


    রঞ্জন রায় - এর অন্যান্য লেখা


    শিক্ষা স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক ক্ষেত্রেও নিছক লাভের জন্য কর্পোরেট ব্যবসা

    ঘরে একুশদিনের স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে রোজ রোজ ওই এক বা দু’টি চেহারা দেখে খিটখিটে হয়ে পড়েছেন?

    সাভারকর কি “কুইট ইন্ডিয়া” আন্দোলনের বিরোধিতা করে ব্রিটিশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন?

    এই বিপুল সংখ্যক মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে বলে দাবি করা হচ্ছে সরকারের পক্ষে থেকে।

    হাসবেন না; এটা সত্যি ভাববার কথা। এই সব গান-টানের পেছনে ঘাপটি মেরে থাকা গভীর চক্রান্তের হদিশ পাওয়া যা

    ভালবাসার কাঙাল সেই মানুষটি যিনি জাতপাত-ভাষা-ধর্মের বা দেশকালের বিভেদ মানতেন না

    শিল্পপতিদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক 3: শিক্ষা এবং কৃষিতেও কর্পোরেটের থাবা-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested