হাথরসের পর সোশাল মিডিয়ায় যে বৃহৎ বিচারসভা বসেছে, সেখান থেকে নানা মতামত উঠে আসছে। কেউ অপরাধীদের লিঙ্গচ্ছেদের পক্ষে জোরদার সওয়াল করছেন, কেউ বা অপরাধীদের বিকাশ দুবের মতো এনকাউন্টার করাকেই একমাত্র বিধেয় বলে মনে করছেন। তবে দিনের শেষে সবপক্ষই পুরুষের কামোন্মত্ততার উল্টোদিকে অবলা নারীর সুলভ শরীর— এই বাইনারির বাইরে বেরোতে পারছেন না। মেয়েটি যে দলিত, আর ঘটনাচক্রে চারজন অভিযুক্তই যে উচ্চবর্ণের হিন্দু— এই বিষয়টাকে অনেকেই গৌণ করে দেখছেন। এক্ষেত্রে এঁদের যুক্তি ধর্ষক আর ধর্ষিতার কোনও জাতধর্ম হয় না। তাঁদের যুক্তিটিও অবশ্য ফেলনা নয়, বিশেষত আজকের এই জাতধর্মে বিভক্ত ভারতবর্ষে তো বটেই,বিশেষত,যখন এই বিভাজনকে আরও চওড়া করতে সদা তৎপর দেশের শাসকপক্ষ। কিন্তু এই সংক্রান্ত আলোচনায় আমরা যদি ভুলে যাই বা ভুলে থাকার চেষ্টা করি যে নির্যাতিতার পদবী বাল্মিকী আর তার উপর নির্যাতনকারী 4 জনই উচ্চবর্ণের ঠাকুর সম্প্রদায়ের লোক, তবে এই আলোচনায় একটা বড় ফাঁক থেকে যাবে।
জেলার নাম হাথরস। গ্রামের নাম বুলহগড়ী। প্রায় 100 ঘর উচ্চবর্ণের বাস সে গ্রামে। অন্যদিকে দলিত, অন্ত্যজ শ্রেণির বাস মাত্র দুটো ঘরে। নির্যাতিতার পরিবার এই দু'ঘর দলিত পরিবারেরই একটা। বাল্মিকী সম্প্রদায়ের মানুষেরা মূলত পয়ঃপ্রণালী পরিষ্কার করার পেশার সঙ্গে যুক্ত, যাদের আমরা মেথর বলে থাকি। গ্রামের দলিত পরিবারগুলির বহুদিনের অভিযোগ উচ্চবর্ণের ঠাকুর এবং ব্রাহ্মণ পরিবারগুলির ধারাবাহিক অত্যাচারের শিকার তাঁরা। কখনও তাঁদের চলাচলের রাস্তায় পাঁচিল তুলে, কখনও বা নিজেদের পয়ঃপ্রণালীর জল তাঁদের জমির ওপর দিয়ে নিয়ে গিয়ে তাঁদের ‘শাস্তি’ দেয়এই উচ্চবর্ণ অধ্যুষিত গ্রাম। কিন্তু এবার ‘শাস্তি’র বহরটা যে এমন হবে তা তাঁরা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি।
হাথরসের ঘটনা মনে করিয়ে দিতে পারে 1992 সালের একটা ঘটনাকে। রাজস্থানের সমাজকর্মী, কুমহার সম্প্রদায়ের ভাঁওয়ারি দেবীর গ্রাম ছিল উচ্চবর্ণের গুর্জর সম্প্রদায় অধ্যুষিত। এই গুর্জর সম্প্রদায় রাজস্থানের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক প্রভাবশালী শক্তি।সেই গ্রামে নিজের পরিবারেই একটি বাল্যবিবাহের ঘটনা রুখে ভাঁওয়ারি দেবী উচ্চবর্ণের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। ‘শাস্তিস্বরূপ’ উচ্চবর্ণের চারজন তাঁকে গণধর্ষণ করে। নিম্ন আদালত অভিযুক্তদের প্রত্যেককেই বেকসুর খালাস করে এই যুক্তিতে যে, উচ্চবর্ণের পুরুষেরা কোনওভাবেই নীচুজাতের নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হবে না!
ঋগ্বেদের পুরুষসূক্তের দশম মণ্ডলে বলা হচ্ছে আদি পুরুষের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, দুই বাহু থেকে রাজন্য (যা পরবর্তীকালে ক্ষত্রিয় নাম নেবে), উরুযুগল থেকে বৈশ্য আর দুই পা থেকে শূদ্ররা জন্ম নিয়েছে। পুরুষানুক্রমিক পেশা অনুযায়ী ব্রাহ্মণ পৌরহিত্য করবেন, ক্ষত্রিয় রাজ্য চালনা ও যুদ্ধবিগ্রহ করবেন, বৈশ্য চাষবাস ও ব্যবসাবাণিজ্য করবেন আর শূদ্র বাকি তিনজনের সেবা করবেন। বৈদিক যুগ থেকে উত্তর-আধুনিক যুগে পদার্পণ করলেও শূদ্র কিংবা অন্ত্যজদের অবস্থাটা যে বিশেষ বদলায়নি, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহই তার জানান দিচ্ছে। শুধু কি তাই? ঐতরেয় ব্রাহ্মণে নিদান দেওয়া হচ্ছে, শূদ্ররা যথাকামপ্রেষ্য (যাকে যথেচ্ছ অত্যাচার করা যায়), যথাকামোত্থাপ্য (যাকে যথেচ্ছ উৎখাত করা যায়), এমনকি যথাকামবধ্যও (যাকে যথেচ্ছ হত্যা করা যায়) বটে। আজকের ভারতীয় সমাজও যে বৈদিক সমাজ কাঠোমোর বাইরে বেরোতে পারেনি তার জ্বলন্ত উদাহরণ হাথরসের ঘটনা। সেখানে অভিযুক্তদের সমর্থনে উচ্চবর্ণের জনপ্রতিনিধি সভা করছেন। সবর্ণ সমাজ নামের সংগঠন দাবি করছে এই ঘটনার পিছনে ষড়যন্ত্র আছে, তাই ষড়যন্ত্রের জায়গাটাকে আগে আবিষ্কার করতে হবে! ঘটনাচক্রে প্রাক্তন আরএসএস প্রচারক পঙ্কজ ধবরৈয়া পরিচালিত সবর্ণ সমাজ এখনও পর্যন্ত যা যা দাবি করেছে, উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন অনুগত অধঃস্তনের মতো তাই তাই মেনে নিয়েছে। ফিরে এসেছে বৈদিক সময়ের আবহ, ‘বাল্মীকি’ অগ্নি তপস্যায় সিদ্ধ হচ্ছেন, মাঝরাতের গহন অন্ধকারে— কে বলে এদেশে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি?
যুগে যুগে বিশ্বের নানা প্রান্তে ভূ-রাজনৈতিক লড়াইয়ের সহজ, সুলভ লক্ষ্যবস্তু হয়েছে নারী শরীর। আমাদের দেশভাগে নারীর শরীরের ওপর বলশালী রচনা করেছে তার আধিপত্যের ইতিহাস। সাদাত হাসান মান্টোর ‘ঠান্ডা গোস্ত’ ছোটগল্পটির কথা অনেকের মনে থাকবে, যেখানে দেশভাগের সময়ে জনৈক ভদ্রলোক এক বিধর্মী নারীর মৃত শরীরের সঙ্গে সঙ্গম করে ঘরে ফেরেন। সংখ্যালঘুর ওপর আধিপত্য স্থাপনে ধর্ষণ পুরুষতন্ত্রের এক বহুল প্রচলিত হাতিয়ার। সংখ্যাগুরুর ভারতবর্ষে সংখ্যালঘু মুসলমান, দলিতদের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হবে, এ আশা করাই বৃথা। দেশে বর্ণবাদ বিরোধী লড়াইয়ের অন্যতম মুখ মীনা কান্ডাসমি দেখাচ্ছেন, 2014 থেকে 2018 সাল পর্যন্ত, 4 বছরে দলিতদের ওপরে অত্যাচারের ঘটনা 47 শতাংশবৃদ্ধি পেয়েছে। সিপিআই(এমএল)-এর পলিটব্যুরো সদস্য কবিতা কৃষ্ণানের মত, বিজেপি এবং সংঘ পরিবারের মনুবাদী চরিত্র প্রকাশ পাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ দলিতদের বৃহত্তর হিন্দুত্বে উত্তরণেত খোয়াব দেখাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন আদিবাসী অঞ্চলে কাজ করছে সংঘ প্রভাবিত বিভিন্ন নামী-বেনামী সংগঠন। তার ফলও পাচ্ছে দেশের শাসক দল। 2019-এর লোকসভায় 34 শতাংশ দলিত ভোট বিজেপির ঝুলিতে গেছে।
কিন্তু সংগঠন তৈরির প্রথম দিন থেকে মূলত ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের স্বার্থ সুরক্ষায় নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ যে আদতে দলিত বিরোধী এবং দলিতদের স্বতন্ত্র সত্তা যে তাঁরা বৃহৎ হিন্দুত্ব দিয়ে ঢাকা দিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে অবিচল, এ বিষয়ে অনেকেই একমত। উচ্চবর্ণের পুরুষকে দলিত নারী সম্ভোগের নিদান দেওয়া সংঘগুরু গোলওয়ারকরের নানা মন্তব্য সমাজমাধ্যমে উঠে আসছে। জনমানসে চর্চা শুরু হয়েছে সংঘের ‘দলিত-প্রেম’ নিয়ে। হাথরসের পর বলরামপুর, আজমপুরের অনুরূপ ঘটনায় এই চর্চা আরও গতি পেয়েছে। এ দেশে দলিতদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক সময় গান্ধী আর আম্বেদকর বৌদ্ধিক বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। আজকের ভারতবর্ষে দলিতদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার মতো কোনও নেতাকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পৈতে, ‘পুরো-হিট’ ফর্মুলায় এগোতে চাইছেন রাজনীতিকদের মধ্যে কমবেশি সবাই। কাঁসিরামের শিষ্যা, একদা ‘দলিত মসীহা’ মায়াবতীএখন নিশ্চুপ। তবে কি উচ্চবর্ণের ক্ষমতার আস্ফালন আর বিকৃত লালসা মেটানোর মাধ্যম হিসাবেই কি সংখ্যাগুরুর দেশে টিকে থাকতে হবে আম্বেদকরের প্রিয়জনদের?
তাঁদের খামখেয়ালিপনায় আরও অনেক মানুষকে আমাদের হারাতে হবে না তো?
এইসব মানুষগুলোর সুরাহা করে দিতে দেশের ‘অর্থমন্ত্রী' নামক এক চরিত্র তাদের সহজ শর্তে ঋণ দেবেন বলছেন।
‘আসিতেছে বিপদের দিন, চাষিরা করিতেছে হম্বিতম্বি, চোখ রাঙাইছে চিন!’
বোম্বে বন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে স্প্যানিশ ফ্লু যা পরে বোম্বে ফ্লু নামে পরিচিত হয়।
কাজ দেয় না সরকার, চাকরি হবে কীসে?
শুধু আনমনেই বলে উঠেছি, ‘স্বপনদুয়ার খুলে এসো, অরুণ-আলোকে এসো স্তব্ধ এ চোখে...।'