বন্ধুদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এখন অন্যতম চর্চার বিষয়, এই লকডাউনে কে কী ওয়েব সিরিজ দেখল বা দেখছে। সেখানে সেগুলো সম্পর্কে পারস্পরিক মত আদানপ্রদান চলছে। কোথায় চিত্রনাট্য দুর্বল, কোনটা বেশি রিয়্যালিস্টিক, কিংবা কোনটায় রোমাঞ্চ বেশি, তার সূক্ষাতিসূক্ষ পর্যালোচনায় সরগরম তাদের আড্ডা। বেশ কিছু সময় পর আমার বলবার পালা এল। কিন্তু আমি যে রিয়্যালিস্টিক ওয়েব সিরিজের কথা বললাম, ওরা বোধহয় সেটা দেখেনি। কিংবা কমবেশি সবাই দেখে ফেললেও সেটার রিয়্যালিটিকে চোখের পর্দার বাইরে রাখতে চায়।
এ এক ওয়েব সিরিজিই বটে। নড়বড়ে চিত্রনাট্যে কী তুখোড় অভিনয় কিছু শীর্ণ, জীর্ণ, অপরিচিত অভিনেতার। জীবনমঞ্চের যবনিকা পতনের আগে অবধি তারা নিজেদের অভিব্যক্তি, আবেগকে নিংড়ে বার করে আনছে। ক্লোজ শটে, লং শটে, শুধু হাঁটা আর হাঁটা। ধারাবাহিকভাবে তাদের নানা রকম ‘স্টান্ট'ও মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে। কখনও পদাতিক মায়ের ট্রলির ওপর আধশোয়া হয়ে রাস্তা পাড়ি দিচ্ছে একরত্তি শিশু, কখনও মৃত মায়ের (এটাও তুখোড় অভিনয়) গায়ের চাদর টেনে তোলার চেষ্টা করছে তার অবোধ শিশুসন্তান। এমন রোমাঞ্চকর দৃশ্যের কোলাজ আছে বলেই তো সারা দেশ, সারা বিশ্বের মানুষ চক্ষু বিস্ফারিত করে দেখছেন এইসব দৃশ্য। যত দিন এগোচ্ছে, দৃশ্যগুলো, স্টান্টগুলো তত বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। বোঝা যাচ্ছে, অভিনেতারা কতটা মরিয়া তাদের অবস্থাটা আমাদের সামনে ফুটিয়ে তুলতে।
এসব দেখে কিছু মানুষ উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন, যেমন সিনেমার ভিলেনকে দেখে পর্দার এ'পার থেকে কিছু মানুষ দাঁত চেপে উঠে দাঁড়ান। এঁরা বুঝছেন না, এই সবই অভিনয়। এঁদের কল্পনাশক্তি এতই দুর্বল যে, এঁরা মাটিকে মাটিই বলবেন। যে দুর্দশা, যে গ্লানি একদিন ড্রয়িংরুমের ওপারে ছিল, পরিচালক তা সর্বসমক্ষে তুলে আনলেই দোষ? মানিকবাবুর বিরুদ্ধেও তো নার্গিস দত্ত এমন একটা অভিযোগ এনেছিলেন যে, সত্যজিৎ রায় তাঁর সিনেমায় নাকি ভারতের দারিদ্রকে দেখিয়ে বিশ্বের নজর কাড়তে চাইছেন। তা, মানিকবাবুর সিনেমা কি তারপর লোকজন দেখা ছেড়ে দিয়েছিল? তা আপনিই বা ছাড়বেন কেন মশাই? দেখে যান। এই দু'মাস ধরে যেভাবে এই দৃশ্যগুলো ধারাবাহিকভাবে দেখে গেছেন, যেভাবে বিরক্তিসূচক শব্দে আর কত দেখব বলেছেন, অথবা ফেসবুকে লম্বা পোস্ট হাঁকিয়েছেন, সেভাবেই চালিয়ে যান। এছাড়া আপনার কাছে আর উপায়ও বিশেষ নেই। বিনা টিকিট, বিনা সাবস্ক্রিপশন। তাও এমন হার্ড রিয়্যালিটি নিয়ে বানানো ধারাবাহিক। চিত্রনাট্যকার, পরিচালকদের কাছে আমাদের তো কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কী বলেন?
ধারাবাহিকটি আগাগোড়া প্রাপ্তবয়স্ক এবং কঠিন হৃদয়ের মানুষদের জন্য ঠিকই, কিন্তু তেমন কোনও ডিসক্লেমার কোথাও দেওয়া হয়নি। সিরিজটিতে শিশু শিল্পী এমনকি সদ্যোজাত শিশুসন্তানকেও অপূর্ব মুন্সিয়ানায় তুলে ধরেছেন পরিচালক। ধারাবাহিকটিতে দেখা যাচ্ছে, কোথাও একমুঠো ভাতের জন্য, কোথায় একটু খাওয়ার জলের জন্য হাতাহাতি করছেন সহশিল্পীরা। রাস্তাতেই শুয়ে পড়ে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ছেন কেউ কেউ। কিন্তু পরিচালক বোধহয় এমন বিয়োগান্তক পরিণতি দিয়েই এই ধারাবাহিকে দাঁড়ি টানতে চান না। তাই তিনি সেখানে দেখাচ্ছেন, এইসব মানুষগুলোর সুরাহা করে দিতে দেশের ‘অর্থমন্ত্রী' নামক এক চরিত্র তাদের সহজ শর্তে ঋণ দেবেন বলছেন। সমালোচকরা বলছেন, যেভাবে এখানে দৃশ্যপট তৈরি করা হয়েছে, তাতে এই বিপন্ন চরিত্রগুলো ব্যাঙ্কে লাইন দিয়ে ঋণ নেবেন, এটা বিশ্বাসযোগ্যই হচ্ছে না। অনেকেই এখানে চিত্রনাট্যে বড় ফাঁক দেখছেন। কেউ কেউ আবার বলছেন, এটা চিত্রনাট্যকার তথা পরিচালকের এক অপূর্ব রসবোধের পরিচায়ক। গুরুগম্ভীর, দুঃখী দর্শকের মনেও তিনি হিউমার জাগানোর চেষ্টা করেছেন। সবার সামনে হাতজোড় করে পরিচালক জানিয়েছেন, তিনি কতটা ব্যথাতুর হয়ে এমন দুঃখজনক পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন। কাহিনীর সবটাতেই সময় আর নিয়তিকে ভিলেন ঠাওরেছেন তিনি। এই কাহিনিতে কোনও প্রোটাগনিস্ট চরিত্র নেই। কেউ ওই নিরন্ন, ক্লান্ত, সুদীর্ঘ পথ হাঁটা মানুষগুলোর জন্য চিৎকার করছেন না, গলা তুলছেন না। পরিচিতরা বলেন ব্যক্তি জীবনে বা পর্দায়, কোথাও পরিচালক এসব ‘প্রোটাগনিজম' সহ্য করেন না। উলটে তিনি বেশ কয়েকবার ‘ক্যামিও' হয়ে চিত্রনাট্যে এসেছেন। মুখে কাপড় বেঁধে ওইসব মানুষগুলোর জন্য দুঃখী হয়ে কিছু কথা বলেই পর্দা থেকে অন্তর্হিত হয়েছেন। তাই তাঁর চিত্রনাট্যে রোমাঞ্চ, অ্যাডভেঞ্চার, দাঙ্গার দৃশ্য সবকিছু থাকলেও প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনও চরিত্র নেই৷ প্রথমে এক-দু'জনের চরিত্রকে সেভাবে তুলে ধরা হলেও, সিরিজ এগোলে দেখা গেল তারা প্রত্যেকেই UAPA আইনে জেলে আছেন।
এই সিরিজের আগাগোড়া এতগুলো মানুষ জীবনের গাড়ি বেয়ে হেঁটে চলেছেন। কুশলী পরিচালক দেখাতে চাননি কেন মরিয়া হয়ে তারা পথে নেমেছে। এদিকে দেশজুড়ে মহামারীর থাবা। তবু, মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করেই কেন এতগুলো মানুষ পথে? তার উত্তর ওয়েব সিরিজটিতে এখনও পাওয়া যায়নি। বন্ধুদের এই সিরিজটার কথাই বললাম। ওরা বলল খুব পরিচিত দৃশ্য এগুলো। ওরাও ধারাবাহিক ভাবে দেখছে এই সিরিজটা। বন্ধুদের মধ্যে একজন শুধু বলল, এত বড় সিরিজটার পরিচালক কে বলত? বললাম, এখনই বলব না কে এর পরিচালক। তবে ওই পর্দার লোকগুলো যেদিন তোর বাড়ির পাশের রাস্তাতেও নেমে আসবে, সেদিন ওদের মুখেই শুনে নিস এটার পরিচালকের নাম। তখন সেই পরিচালককে তোরা অস্কার দিবি বা র্যাস্পবেরি (বিশ্বে কুখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয়), সেটা তোদের হাতেই ছাড়লাম। কিন্তু থ্রিলারের শেষে বিবেকের চরিত্রে অভিনয় করা পরিচালক শেষে ভিলেন বনে গেলে, তোরা রেগে যাবি না তো? এর কোনও উত্তর পাইনি ওদের থেকে। প্রশ্নের মধ্যেই হয়তো উত্তর ছিল।
শিল্পীর শিল্প কালোত্তীর্ণ হয় মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সরকারের দেওয়া রাষ্ট্রীয় খেতাবে নয়।
বাঙালির সুকুমারি মন, ননসেন্স রাইমস লিখেও এখানে প্রফেট হওয়া যায়, গবেট নয়।
সিন্ধু পাকিস্তানে, জাতীয় সঙ্গীতে শব্দ বদলের আর্জি নেতার
তালিবানি মৌলবাদের রোগ পালটা মৌলবাদী দাওয়াইতে সারবে না, এটা দেশের রাজনৈতিক তালেবরদের বুঝতে হবে।
‘সব খেলার সেরা’ আছে কিনা জানা নেই, তবে ফুটবলটাই আর বাঙালির নেই!
সহিষ্ণু আর সময়ানুবর্তী হওয়ার পাঠ যাদের দেওয়ার কথা, সেই শিক্ষকদের একাংশই এই দুইয়ের পাঠ ভুলেছেন।