×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • দিল্লির ইতিহাস মুছে নিজের নাম লিখতে চান মোদী

    বিতান ঘোষ | 08-06-2021

    শুধু নিজের কর্মের উপর ভরসা রাখতে পারছেন না স্বঘোষিত ফকির শাসক। ইঁট কাঠ পাথরের এমন একটা কিছু বানাতে চান তিনি, যা মধ্যযুগের রাজারাজরাদের মতো তাঁর নাম ও নিশান বহন করবে। অতএব সেন্ট্রাল ভিস্তা, এবং তাকে কেন্দ্র করে এমন এক নতুন দিল্লি যেখানে অতীতের কারও কোনও কীর্তিআর থাকবে না, নাম থাকবে না ল্যুটিয়েন্সের। নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্নের রাজধানী বানানোর প্রকল্পে দিল্লির ঐতিহাসিক ভবন, সৌধগুলি যথেচ্ছ ভাঙা পড়ছে। এগুলোর মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য ন্যাশনাল আর্কাইভ বা জাতীয় লেখ্যাগার, জাতীয় সংগ্রহশালা, ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল সেন্টার ফর আর্টস। 

     

     

    রাইসিনা পাহাড়ে অবস্থিত রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে প্রশস্ত রাজপথ ইন্ডিয়া গেট অবধি চলে গেছে, যার দু'পাশ জুড়ে প্রশাসনিক ভবন নর্থ ব্লক, সাউথ ব্লক, সংসদ। দেশের এই ক্ষমতাকেন্দ্রকেই সারা ভারত ল্যুটিয়েন্স দিল্লি বলে জানত, অন্তত এতকাল পর্যন্ত। কারণ ব্রিটিশ স্থপতি এডউইন ল্যুটিয়েন্সের হাতযশেই দিল্লির এই পাওয়ার হাউস তৈরি হয়েছিল। এই কাজে ল্যুটিয়েন্সকে যোগ্য সঙ্গত করেছিলেন আর এক স্থপতি হার্বার্ট বেকার। মধ্যযুগের শাহজানাবাদ, গালিবের প্রিয় শহর দিল্লি, ল্যুটিয়েন্স দিল্লি হয়ে আজ আর এক ইতিহাসের সামনে। শাসকের খামখেয়ালে আবারও তার ভোল বদলাতে চলেছে। তবে ভোল পাল্টাতে গিয়ে প্রতাপশালী শাসক এমন অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তাতে শিউরে উঠছেন দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজন।

     

     

    শাসকের অমর হওয়ার শখ পূরণ করতে গিয়ে কোপ পড়তে চলেছে ন্যাশনাল আর্কাইভের অ্যানেক্স ভবনের ওপর। সেখানে সংরক্ষিত বহুমূল্য নথিগুলির যর্থার্থ সংরক্ষণ কীভাবে হবে, তাই নিয়ে চিন্তিত দেশের শিক্ষাবিদ, পড়ুয়াদের একটা বড় অংশ। উদ্বেগ কমাতে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী প্রহ্লাদ সিংহ প্যাটেল বরাভয়ের সুরে বলেছেন, "ন্যাশনাল আর্কাইভের ল্যুটিয়েন্স নির্মিত মূল ভবন অক্ষত থাকছে। তাই নথিপত্রের খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা নেই!'

     

     

    1891 সালে ইংরেজরা কলকাতায় 'ইম্পেরিয়াল রেকর্ড ডিপার্টমেন্ট'প্রতিষ্ঠা করেছিল। 1911 সালে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হলে, ইম্পেরিয়াল রেকর্ড ডিপার্টমেন্টও দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়। 1947-এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ন্যাশনাল আর্কাইভ অফ ইন্ডিয়া, সংক্ষেপে NAIবহু ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর প্রামাণ্য নথি, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসার যাবতীয় হিসাবনিকাশ, ভারতের প্রতিবেশী প্রায় 30টি দেশের 200 বছরের মানচিত্র, স্বাধীনতা উত্তর ভারতের প্রশাসনিক নথিপত্র সংরক্ষিত আছে এই প্রতিষ্ঠানে। আর্কাইভের অ্যানেক্স বিল্ডিং, যা ভাঙা পড়তে চলেছে, তাতে সংরক্ষিত আছে মূলত 1748 থেকে 1857-র মহাবিদ্রোহ পর্যন্ত যাবতীয় ঐতিহাসিক নথি। এছাড়া ওরিয়েন্টাল সেকশন (প্রাচ্যবিদ্যা সংক্রান্ত বহু নথিপত্রে সমৃদ্ধ), প্রাইভেট আর্কাইভ সেকশন (যেখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগৃহীত বিভিন্ন নথিপত্র সংরক্ষিত থাকে) এই অ্যানেক্স ভবনের মধ্যে রয়েছে। 

     

    শিল্পীর কল্পনায় প্রস্তাবিত সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্প

     

    এছাড়াও এমন অনেকে বহুমূল্য নথি আছে, যেগুলো এখনও নিয়ম মোতাবেক ক্যাটালগিং (নির্দিষ্ট ক্রম অনুযায়ী সাজানো) হয়নি। সেগুলো অ্যানেক্স ভবনের বেসমেন্টে প্রায় অনাদরে পড়ে রয়েছে। সেখানে এই ভবনে থাকা যাবতীয় নথিপত্র অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলে, তা কতটা সুরক্ষিত থাকবে, তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই। যে কোনও আর্কাইভে প্রাচীন নথিপত্র সংরক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রা, এমনকি আলোর নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। সেখানে সরকার যদি নিতান্ত দায়সারা ভাবে এই স্থানান্তকরণের কাজ করে, তাহলে অনেক মূল্যবান নথি চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে বা নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন৷ দেশের বহু ঐতিহাসিক, শিক্ষাবিদ এই বিষয়ে তাঁদের আশঙ্কার কথা জানিয়ে একযোগে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন। কিন্তু সরকার তার সিদ্ধান্ত বদলেছে, এমন কোনও খবর এখনও পাওয়া যায়নি। বহুদিন ল্যুটিয়েন্স দিল্লিতে প্রশাসনের উচ্চপদে নিযুক্ত থাকা জহর সরকার বলছিলেন, সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, ‘কেন্দ্রীয় প্রশাসনে নিযুক্ত সকল কর্মচারীকে এক ছাদের তলায় আনতেই নাকি সেন্ট্রাল ভিস্তার এই উদ্যোগ। কর্মজীবনে এমন কোনও পরিকাঠামোগত প্রতিকূলতার সম্মুখীন আমি অন্তত হইনি। তাহলে কীসের জন্য এই ঐতিহাসিক ভবন, সৌধগুলোকে ভেঙে ফেলা হচ্ছে?’ বাসন্তী দেবী কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপিকা চিলিকা ঘোষের কথায় বিদ্রুপের সুর। ‘যে দলটা দেশের শাসন ক্ষমতায় আছে, তারা তো এই দেশের ইতিহাসটাকেই বদলে দিতে চায়। ইতিহাস বদলে নিজেদের পুরনো কৃতকর্ম জনগণের চোখের আড়ালে নিয়ে যেতে চায়। তাই ঐতিহাসিক নথিপত্রের দফারফা হলে এই সরকারের কীই বা যায় আসে!’, মন্তব্য তাঁর। 

     

    আরও পড়ুন: ছাঁচে ঢালা দেশপ্রেম, ভাষা তার হিন্দি

     

    নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর সরকার দিল্লিকে হেরিটেজ শহরের তকমা দেওয়ার জন্য জাতিপুঞ্জে বেশ কয়েকবার তদ্বির করেছিল। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে পরে সেই আবেদন ফিরিয়ে নেওয়া হয়। নিন্দুকেরা বলেন, যমুনা তীরের এই রাজধানী-শহরের গা থেকে ইসলামিক ও ব্রিটিশ শাসনের যাবতীয় নিদর্শন সরিয়ে ফেলতে চান প্রধানমন্ত্রী মোদী। কিন্তু ল্যুটিয়েন্স দিল্লি থেকে মোদীর দিল্লির এই ভোলবদল ঘটাতে গিয়ে সযত্নে লালিত ইতিহাসকে যেভাবে জলাঞ্জলি দেওয়া হচ্ছে, তাতে ইতিহাস কি কখনও অনুকম্পা করবে এই উচ্চাকাঙ্খী শাসককে? ইতিহাসের চাকাকে উল্টোদিকে ঘোরাতে মেটারনিখ পারেননি, ষোড়শ লুই পারেননি, মোদী কি পারবেন?


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    বীরপুজোয় মত্ত শাসক এবং ভক্তরা ইতিহাস-বিস্মৃত হলে তাদেরই চরম মূল্য চোকাতে হবে।

    তাঁদের খামখেয়ালিপনায় আরও অনেক মানুষকে আমাদের হারাতে হবে না তো?

    কালো চামড়ার মানুষদের ওপর অত্যাচারের যে সুদীর্ঘ দলিল, তাতে জর্জ ফ্লয়েডের নামটা নতুন সংযোজন মাত্র।

    দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সঙ্ঘ এবং মহাসভা আগাগোড়া অনুপস্থিত থেকেছে

    ক্ষমতা প্রয়োগ করে মহামারীর মোকাবিলার সঙ্গে আইনগত এবং নৈতিক দায়িত্বও পালন করাও উচিত কেন্দ্রের।

    বেঙ্গল প্যাক্টে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শাসনক্ষমতা দেওয়ার কথা বললেন চিত্তরঞ্জন।

    দিল্লির ইতিহাস মুছে নিজের নাম লিখতে চান মোদী-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested