জেন্ডার ইকুয়ালিটি। উত্তর-আধুনিক বিশ্বে চর্চিত স্বর। যে স্বর কোনও লিঙ্গের অগ্রাধিকারের কথা বলে না, সাম্যের কথা বলে। শিরোনামটি রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যের বিখ্যাত একটি গান ‘আমি চিত্রাঙ্গদা’।
শিরোনামে নয়, এবার নেমে আসা যাক পঙক্তির ভিতরে। ‘পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে/ সে নহিনহি, হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে/ সে নহিনহি, যদি পার্শ্বে রাখো মোরে সঙ্কটে সম্পদে/ সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে/ পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে...’
আরও পড়ুন: মেয়েদের ফেস নয়, বুকেই নজর ফেসবুকে
কে বলছেন এই জেন্ডার ইকুয়ালিটির কথা? এক মহাকাব্যের নারী। কোন নারী? যিনি মহাভারতের মূল পরিসরে একটি অধ্যায়মাত্র। রবীন্দ্রনাথ সেই নারীকে বেছে নিলেন। এই চিত্রাঙ্গদা পুরুষের বিদ্যা জানেন, কিন্তু মনোহরণের দীক্ষা তাঁর অজানা। তাই অর্জুন তাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। অগত্যা সুন্দরী নারীর রূপে অর্জুনকে মোহপাশে বাঁধলেন চিত্রাঙ্গদা। কিন্তু ক্ল্যাইম্যাক্স সম্পূর্ণ আলাদা।রূপের মোহিনীমায়ায় ক্লান্ত অর্জুন, নারীতে যখন খুঁজছেন পৌরুষের সন্ধান, তখনই নিজরূপে ধরা দিলেন চিত্রাঙ্গদা। নারীর রূপের লাবণ্যকে ছুঁড়ে ফেলে ব্যক্তিত্বের প্রতিষ্ঠা। এখানেই স্বতন্ত্র রবীন্দ্রনাথ। মহাকাব্য ভেঙে তৈরি করলেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত মহাকাব্যের নারী, একালিনী।
আর তার ঠিক প্রায় শতবর্ষ পরে ভারতসন্ততিকে শেখানো হচ্ছে কমপ্লিট ইউটার্নের পাঠ? ধর্ষণ, লিঙ্গবৈষম্য, কম্প্রোমাইজ...আর কত বলি!
এ দেশে ধর্ষণ জলভাত। উত্তরাধুনিক ভারত শেখায় ধর্ষকের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে তাকেই বিয়ে করে ফেলার মহতী পাঠ! আমরা তবু শান্ত হয়ে শ্রান্ত হয়ে বসে বসে ধর্মের বকের মতো দেখি। কত অনায়াসে একজন স্বামী নির্লজ্জের মতো স্ত্রী ‘সম্পত্তি’-টিকে সেই স্ত্রীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েও ধরে রাখার জন্য মোকদ্দমা ঠোকেন!হায় পণ্য! আবার দেখি সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষক মেয়াদ ফুরোতেই পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে ধর্ষিতার বাবাকে। ঘটনার স্থান উত্তরপ্রদেশ, হাথরস।নির্যাতিতার কান্নার ভিডিওয় তোলপাড় সোশাল মিডিয়ায়। ঘুম ভেঙে উঠে দেখি, এ কোন সকাল!
একটা হট প্যান্ট ঠিক করে দেবে আপনি আদৌ শালীন কি না! অশালীন হলেই আপনি ধর্ষণযোগ্য! আহা, এত খোলামেলা পোশাক কেন! আমাদের ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতিতে...বলে শুরু করলেই থামিয়ে দিন। একটু স্মিত হেসে প্রশ্ন করুন তো, আচ্ছা, প্রাচীন ভারতের পোশাকের ওপর গবেষণা করব, আপনি গাইড হবেন? একটা পোশাকের নাম আপনাকে বলে রাখি, কাঁচুলি। ওমা! জানেন না? গুগল করে নিন। পতিব্রতা শকুন্তলাও এই পোশাক পরত। তিনি উত্তম হইলে, আমি অধম কেন! সনাতন সংস্কৃতিরই তো আপডেটেড ভার্সনে বিশ্বাস রাখছি মশাই। এর পরেও বলবেন, পোশাকই ধর্ষণের কারণ! বোঝো ঠ্যালা!
বিয়েতে কন্যাদান নামে একটা জঘন্য প্রথা আছে। পুরনো হ্যাংওভার, আমরাও কাটাতে চাই না। এই প্রথা এতটাই জমে বসেছে যে, সেদিন যখন দেখলাম একজন নেতা খোদ লিখছেন, মেয়েরা পরের সম্পত্তি। কী চূড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিক ভাবনা! হবে না কেন, যে দেশে কৃষক আন্দোলনে মেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলা হয়, এই আন্দোলনে মেয়েদের ‘রাখা হল’কেন? মেয়েরা কি প্যাসিভ ভয়েস? নাকি সমাজ এইটাই চায়?
হায় বীরাঙ্গনা! তোমার কি কণ্ঠ নাই? আছে। কিন্তু একুশে আইন তোমার গলা নামিয়ে দেবে আইনের গিলোটিনে। আইনের শক্তিশেলে অকারণ জব্দ হতে হতে নারীর স্বর একদিন ক্লান্ত হয়ে যাবে।
এই হিরণ্ময় নীরবতাই কি ভারত ভূমির জয়? সনাতন সংস্কৃতির জয়? ইতিহাস কিন্তু সেই সাক্ষ্য দেয় না। আমরা ভুল ইতিহাস পড়ছি না তো!সময় বয়ে যাওয়ার আগে, ভাবুন, ভাবান।
হুতোম ফিরে এল, এখন সে এ বঙ্গের ভোট নিয়ে নানা তরজা নকশা লিখছে।
নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার পথে বাধা রাষ্ট্রেরই নানা প্রতিষ্ঠান
অনেকদিন পর আশমান থেকে নেমে নকশা কষতে বেরিয়ে হুতোম দেখে বাইরে ভোট তামাশা বোজায় জমেছে!