মহাশ্বেতার দ্রৌপদী। দোপদী মেঝেন, একজন সাঁওতাল রমণী, যিনি শোষিত বঞ্চিতদের পক্ষে অস্ত্র তুলে নিয়ে এলাকার জমিদার, মহাজন, পুলিশ এবং সরকারের ত্রাস হয়ে ওঠেন। তিনি হয়ে ওঠেন সমস্ত অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। তিনি ও তাঁর স্বামী পুলিশের খাতায় ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’। স্বামী দুলনের হত্যার পরেও নাছোড় দোপদী একাই তাঁর লড়াই জারি রাখেন। কিন্তু সহকর্মীদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে একদিন তিনিও ধরা পড়ে যান। তাঁর গ্রেপ্তারে সেনারা উল্লসিত। সেনানায়ক নির্দেশ দেয়, ওকে বানিয়ে নিয়ে এসো, ডু দ্য নিডফুল। দোপদীকে রাতভর বানানো হয়, একের পর এক সেনা তার অসহায় শরীর নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। তিনি বুঝতে পারেন তাঁর স্তনদু’টি ক্ষত বিক্ষত, বৃন্ত ছিন্নভিন্ন। তিনি মনে করতে পারেন না কত জন, কারণ তাঁর আর জ্ঞান ছিল না। তবুও দোপদী অনমনীয়, অদম্য। সকালে সেনানায়ক যখন তাঁকে ডেকে পাঠায়, তখন তিনি হেসে ওঠেন, ঠোঁট দিয়ে চুইঁয়ে পড়া রক্ত জিভ দিয়ে চাটেন, কালো আবলুশ এক জীবন্ত প্রেতাত্মার মতো তিনি অফিসারের দিকে এগিয়ে যান। এরপর লেখিকার বর্ণনা শিহরণ জাগায়, ভারতীয় সাহিত্যে তা অমর হয়ে গেছে। “…হেথা কেউ পুরুষ নেই যে লাজ করব। কাপড় মোরে পরাতে দিব না। আর কী করবি? লেঃ কাউন্টার কর, লেঃ কাউন্টার কর? দ্রৌপদী দুই মর্দিত স্তনে সেনানায়ককে ঠেলতে থাকে এবং এই প্রথম সেনানায়ক নিরস্ত্র টার্গেটের সামনে দাঁড়াতে ভয় পান, ভীষণ ভয়।”
মহাশ্বেতা দেবীর অনন্য, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী গল্প ‘দ্রৌপদী’ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজি পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে দ্রোহকালের এই গল্পটিতে নকশাল আমলের চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের সময় আদিবাসী ও নারীদের ওপর অত্যাচারের বর্ণনা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে লেখিকা তুলে ধরেছেন। এর পরিবর্তে লেখিকার অন্য কোনও গল্পও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। একইসঙ্গে তামিল দলিত লেখিকা বামা ফাউস্তিনা সুসাইরাজ এবং সুকীর্থরানির লেখার ওপরেও কোপ পড়েছে। অ্যাকেডেমিক কাউন্সিলের পনেরো জন সদস্যের বিরোধিতা সত্ত্বেও এই সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়। অভিযোগ যে ওভারসাইট কমিটি এই অনুমোদন দিয়েছে, তাতে ইংরাজি বিভাগের কোনও প্রতিনিধি নেই। বিভাগীয় প্রধান শুধু একজন আমন্ত্রিত সদস্য। কাউন্সিল সদস্য মিথুরাজ ধুসিয়া অভিযোগ করেন যে, এই লেখাগুলি ছেঁটে দেওয়ার পিছনে রাজনৈতিক কারণ আছে। তারা আপত্তি করা সত্ত্বেও এই পরিবর্তনগুলি অনুমোদন করা হয়। দ্রৌপদী গল্পটি 1999 সাল থেকে পাঠ্যক্রমে আছে। বিরোধীরা তাঁদের প্রতিবাদপত্রে এটাও উল্লেখ করেন যে, ‘চন্দ্রাবতী রামায়ণ’-এর পরিবর্তে তুলসীদাসের রামায়ণ আনা হয়েছে এবং এটা করে মহাকাব্যের নারীবাদী ব্যাখ্যাকে ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। 2019-এও সিলেবাস পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। তখন ইংরাজি রচনায় গুজরাট ও মুজফফরনগর দাঙ্গার কিছু অংশ সংশোধন অথবা বিলোপ করা হয়েছিল। ইতিহাসের সিলেবাসে নকশালবাদ পড়ানো নিয়েও বিরোধিতা করা হয়েছিল।
আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যখন স্রেফ জিনস্ পরার জন্য একটি মেয়েকে মেরে ফেলা হচ্ছে। দলিত মেয়ে ধর্ষিতা হওয়ার পরে সে যাতে জবানবন্দি না দিতে পারে তার জন্য তার পরিবারের অনুমতি ছাড়াই, পরিবারের কোনও সদস্যর উপস্থিতি ছাড়াই, প্রশাসন নিজে তাঁর মৃতদেহ চুপিসারে দাহ করে ফেলছে। এরপরেও ধর্ষিতার পরিবার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা শাসক দলের মদতে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা দেখেছি আট বছরের বালিকাকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। পুলিশ অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার পর শাসক দলের কর্মীরা তাদের মুক্তির জন্য মিছিল করেছে, পরে তাদের গলায় মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। ইদানীং নারী-বিদ্বেষের যাবতীয় যা ঘটনা প্রত্যহ ঘটে চলেছে সেটা সম্পূর্ণ লিপিবদ্ধ করতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। সুকীর্থরানি, যাঁর ‘DEBT’ এবং ‘MY BODY’ নামক দু’টি কবিতা সিলেবাস থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে, তিনি বলেন- তিনি একেবারেই এতে আশ্চর্য নন, কারণ এখন আমরা এমন একটা সরকারের অধীনে আছি যারা সনাতন চিন্তায় বিশ্বাস করে। যখন তারা আমার, বামার বা মহাশ্বেতা দেবীর লেখার নিখাদ সত্যটার মুখোমুখি হতে পারে না, তখন তারা আমাদের কাজ আটকে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের রচনাই আমাদের হয়ে কথা বলে এবং তা এখনও বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছে। বামা, যাঁর ‘সংগতি’ উপন্যাসের কিছু অধ্যায় পাঠ্যক্রমে ছিল এবং এখন বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে, তিনিও বলেন, "‘আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার 2000 বছর পিছনে পড়ে আছে, আমরা আছি বর্তমানে। তারা মনে করে নারীর কথা বলা উচিত নয়, কোনও সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়া উচিত নয়; আমার ‘সংগতি’ তো এই সব নিয়েই।''
সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে 1976 সালে লেখা দ্রৌপদী গল্পটি শাসকদের মনে এত ভীতি জাগায় করণ, এই গল্পটি রাষ্ট্রের তাঁবেদারদের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেয়। তাই তারা বারবার এটাকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করে। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা এই গল্পটির ওপর খড়্গহস্ত। 2016 সালে সদ্য প্রয়াত লেখিকার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হরিয়ানার মহেন্দ্রগড়ের সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির কিছু অধ্যাপক এই গল্পটির ওপর ভিত্তি করে একটি নাটক মঞ্চস্থ করেন। নাটকটির পরে স্নেহসাতা, অন্যতম সংগঠক, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনাবাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রদর্শন নিয়ে অভিযোগ করেন। এরপর প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে সংঘের ছাত্র সংগঠন এবিভিপির ছাত্ররা লাগাতার বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তাদের বক্তব্য একটি বিশেষ দৃশ্যে যেখানে ধর্ষণ দেখানো হয়েছে, সেটি রাষ্ট্র-বিরোধী এবং সেনাবাহিনীর পক্ষে অপমানজনক। এদের চাপে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, যাঁরা নাটকটি মঞ্চস্থ করার অনুমতি দিয়েছিলেন, তাঁরা দু’জন শিক্ষককে শোকজ় করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। শিক্ষকরা অভিযোগ করেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কালচার অফ সাইলেন্স’ কায়েম করা হচ্ছে। স্নেহসাতা অভিযোগ করেন যে, ক্যাম্পাসে ফেসবুক ব্লক করে দেওয়া হয়েছে, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে শিক্ষকদের কথা বলার কোনও উপায় নেই। তিনি বলেন এটা তো অ্যাকাডেমিক্স এবং গবেষণার জায়গা যেখানে সবাই নানা বিষয় আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক করতে পারবে। আমরা যদি প্রান্তিক মানুষদের সমস্যা নিয়ে কথা না বলি, তো কে বলবে?
আরও পড়ুন: স্কুল খোলা আর তারপর
2000 সালে মণিপুরের প্রবাদপ্রতিম নাট্যকার হেইসনাম কানহাইয়ালাল ইম্ফলে মহাশ্বেতা দেবীর গল্প থেকে ‘দ্রৌপদী’ নাটক মঞ্চস্থ করেন। তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী, যিনি নিজেও একইভাবে প্রবাদপ্রতিম অভিনেত্রী ও নাট্যকার, তিনি মঞ্চে নগ্ন শরীরে সেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে তাঁকে ‘কাউন্টার’ করতে বলেন। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও ছি ছি করে ওঠেন এবং মাত্র দু’টি শো-এর পর অশ্লীলতার অভিযোগে নাটকটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। নাট্যকারকে বলা হয় বিকৃতমনস্ক; সাবিত্রীকে নির্লজ্জ, কলঙ্কিনী! নাটকটি এত বিতর্কিত হয়েছিল যে, পরবর্তী কয়েক মাস ওই ছোট্ট পাহাড়ি শহরে এটা নিয়ে বিতর্ক চলেছিল। কিন্তু দেখা গেল কানহাইয়ালাল ভবিষ্যতদ্রষ্টা! আংশিক সামরিক শাসনের কারণে রাজ্যবাসীর ক্ষোভ ফেটে পড়ে। চার বছর পরে 2004 সালে বারো জন মণিপুরি মহিলা নগ্ন হয়ে ইম্ফলের কাংলা দুর্গের সম্মুখে মনোরমা নামক এক নিরীহ মেয়ের হত্যা এবং ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। তাঁদের অভিনব প্রতিবাদে যেখানে তাঁরা বলছেন, ‘আমরা সবাই মনোরমার মা, এসো আমাদের ধর্ষণ করো’, সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সেটা এমন একটা সময় যখন মণিপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ‘আর্মড ফোর্সেস স্পেশ্যাল পাওয়ারস অ্যাক্ট’ (আফস্পা)-এর অধীনে।
কয়েক বছর আগে এই প্রতিবেদকের কলকাতায় এই নাটকটি দেখার সুযোগ হয়েছিল। কানহাইয়ালাল তখন গত হয়েছেন। কিন্তু গল্পের দ্রৌপদীর মতো সাবিত্রী দেবী তখনও নাছোড়, অদম্য, বয়স তাঁর উদ্যমে আঁচড় কাটতে পারেনি। তাঁর অদম্য শক্তি, আবেগ প্রতিটি মুহূর্তে দর্শকদের শিহরিত করে। পুরো অডিটোরিয়াম মন্ত্রমুগ্ধ, মঞ্চের ঘনীভূত আবেগ যেন স্পর্শ করা যায়। অন্তিম দৃশ্যের পর পুরো দল নিয়ে তিনি যখন দর্শকের সম্মুখীন হন, তখন তিনি নিঃশেষিত। অশ্রুসজল চোখ নিয়ে তিনি সবাইকে অভিবাদন জানান।
কোনও বিশ্ববিদ্যালয়, বা হিন্দুত্ববাদী কোনও পেয়াদার কি এই শিল্পকে ধ্বংস করার ক্ষমতা আছে?
রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী এখন রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
UAPA প্রয়োগ করে রাষ্ট্র যে বিচারের নামে যা খুশি করতে পারে, তার উদাহরণ ভারভারা রাও
দেশ কৃষিতে উদ্বৃত্ত, অথচ ক্রমবর্দ্ধমান অনাহারে থাকা মানুষের সংখ্যা- হিসেবে ভুল হচ্ছে কোথায়?
ভোটমুখী বাংলায় কৃষক আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর কৃষক নেতারা।
মাধুর্যের আড়ালে লুকনো কদর্যতা 60 বছরেও বদলায়নি।
বিচারব্যবস্থার সরকারের অনুগত হয়ে পড়াটাই ভয়ঙ্কর বিপদ